Site icon মুক্তিপত্র

প্রশাসন কি সুকৌশলে দায় এড়িয়ে যাচ্ছে?

প্রায় ১৪ মাস পর গত ১ নভেম্বর ২০১৯ থেকে কার্যকর করা হয়েছে বহুল আলোচিত ” সড়ক পরিবহন আইন,২০১৮ ” গত বছর ঢাকার “শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীর বাসচাপায় প্রাণ হারানোর ঘটনায় সারাদেশের শিক্ষার্থীদের প্রবল আন্দোলনের মুখে ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে বাংলাদেশ সরকার, চালক ও পথচারী উভয়ের জন্য কঠোর বিধান যুক্ত করে ” বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ ” পাস করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৫৫ জন ব্যক্তির সড়ক দূর্ঘটনায় প্রাণহানি হচ্ছে। আর বাংলাদেশ রিসার্চ ইন্সটিটিউট এর গবেষণায় দেখা যায়, দেশে প্রতিবছর সড়ক দূর্ঘটনায় গড়ে ১২০০০ মানুষ নিহত ও ৩৫০০০ আহত হন।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানান, “আমাদের দেশ দীর্ঘদিন যাবত যেখানে আইনের শাসন অনুপস্থিত ছিল। সেখানে এই আইনে অপরাধ ও দণ্ডের পরিমাণটা যুগোপযোগী করা হয়েছে। তবে যাত্রী স্বার্থে দিকটা এখানে নজরে আনা হয়নি। তাই বলবো মন্দের ভাল আইন হয়েছে
তিনি আরও বলেন,”এই আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করা গেলে এই আইনটি সড়ক পরিবহনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হতে পারে।”
এই বহুল আলোচিত আইন এর কিছু উল্লেখযোগ্য ধারা সম্পর্কে জানা দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে আমাদের অবশ্য কর্তব্য যা নিম্নরুপঃ-

√সড়কে গাড়ি চালিয়ে উদ্দেশ্য প্রনোদিতভাবে হত্যা করলে ৩০২ অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

√সড়কে বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালালে বা প্রতিযোগিতা করার ফলে দুর্ঘটনা ঘটলে তিন বছরের কারাদণ্ড অথবা তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। আদালত অর্থদণ্ডের সম্পূর্ণ বা অংশবিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে দেয়ার নির্দেশ দিতে পারবে।

√মোটরযান দুর্ঘটনায় কোন ব্যক্তি গুরুতর আহত বা প্রাণহানি হলে চালকের শাস্তি দেয়া হয়েছে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের জেল ও সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা।

√ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া মোটরযান বা গণপরিবহন চালানোর দায়ে ছয় মাসের জেল বা ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেয়া হয়েছে।

√নিবন্ধন ছাড়া মোটরযান চালালে ছয় মাসের কারাদণ্ড এবং পঞ্চাশ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রয়েছে।

√ভুয়া রেজিস্ট্রেশন নম্বর ব্যবহার এবং প্রদর্শন করলে ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদণ্ড অথবা এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছে।

√ফিটনেসবিহীন ঝুঁকিপূর্ণ মোটরযান চালালে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেয়া হয়েছে।

√ট্রাফিক সংকেত মেনে না চললে এক মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দণ্ডিত করা হবে।

√সঠিক স্থানে মোটর যান পার্কিং না করলে বা নির্ধারিত স্থানে যাত্রী বা পণ্য ওঠানামা না করলে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে।

√গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোনে কথা বললে এক মাসের কারাদণ্ড এবং ২৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।

√একজন চালক প্রতিবার আইন অমান্য করলে তার পয়েন্ট বিয়োগ হবে এবং এক পর্যায়ে লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে।

√কোন গণপরিবহন সহজে দৃশ্যমান স্থানে ভাড়ার চার্ট প্রদর্শন ব্যতীত যাত্রী পরিবহন করতে পারবে না এবং নির্ধারিত ভাড়ার চাইতে অতিরিক্ত ভাড়া, দাবী বা আদায় করলে এক মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দণ্ডিত করা হবে।

√আইন অনুযায়ী ড্রাইভিং লাইসেন্সে পেতে হলে চালককে অষ্টম শ্রেনি পাস এবং চালকের সহকারীকে পঞ্চম শ্রেণি পাস হতে হবে হবে। আগে শিক্ষাগত যোগ্যতার কোন প্রয়োজন ছিল না।গাড়ি চালানোর জন্য বয়স অন্তত ১৮ বছর হতে হবে। এই বিধান আগেও ছিল।

√বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে পরিবহন চালক,কন্ডাকটর, হেলপার,ক্লিনারগণের কর্মঘণ্টা ও বিরতিকাল নির্ধারণ করতে হবে।

√ধারা ৪২ এর উপধারা ৩ অনুযায়ী প্রত্যেক সড়ক পারাপারকারীকে সড়ক বা মহাসড়ক পারাপারের ক্ষেত্রে জেব্রা ক্রসিং, ফুটওভার ব্রিজ বা আন্ডারপাস যদি থাকে ব্যবহার করতে হবে। অন্যথায় ১ মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড কিংবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ সেন্টারের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক শামসুল হক মনে করেন এ আইনে সড়কের শৃঙ্খলা ফিরবে না। তিনি বলেন,”গণ-পরিবহনে কোন আইন দরকার নাই। এটা একটা পরিকল্পনা। বিজ্ঞান বলে পরিকল্পনাটা এমন হতে হবে যাতে সেটি হয় স্ব-নিয়ন্ত্রিত এবং বেশিরভাগই মানতে বাধ্য হবে। এবং বাকি কেউ যদি অপরচুনিস্ট (সুযোগ সন্ধানী) হয়, তাহলে আইন দিয়ে তাকে শাসন করতে হবে।”


অধ্যাপক হক বলেন, “পরিকল্পনাতেই আসল ‘গলদ’ রয়েছে।” তিনি বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা এবং নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনার জন্য আইন প্রণয়নের চেয়ে দৃষ্টিভঙ্গি বদল বেশি প্রয়োজন।বাংলাদেশে বর্তমান সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা ‘বিশৃঙ্খল এবং উচ্ছৃঙ্খল’ অবস্থায় রয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।


উদাহরণস্বরূপ, ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে হলে চালককে কমপক্ষে অষ্টম শ্রেণী পাস এবং তার সহকারীকে পঞ্চম শ্রেণী পাস হতে হবে; এই আইনের প্রয়োগে সবথেকে বড় অন্তরায় হচ্ছে এই যে আমাদের দেশের পরিবহন শ্রমিকদের একটা বড় অংশই নিরক্ষর কিংবা শুধু নিজেদের নাম স্বাক্ষর করতে পারে এমন।


√এদের পড়াশোনার কোনরকম সুবিধার ব্যবস্থা কি করা হয়েছে?
আইনানুসারে মোটর‍যান চালনার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানের অনুমতি রয়েছে কর্তৃপক্ষের। এছাড়াও চালকের বয়স নূন্যতম ১৮ হতে হবে এবং জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদর্শন করতে হবে নির্ধারিত কর্তৃপক্ষের নিকট। অথচ বাংলাদেশের পরিবহন ক্ষেত্রে দেখা যায় অল্পবয়সী (অনূর্ধ্ব ১৮) শিশুরাও চালকের আসনে বসে বাস চালাচ্ছে। আবার হেলপার কিংবা কন্ডাকটর এর ভূমিকায়ও এদের দেখা যায়। এছাড়াও ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানেও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা লক্ষনীয়। পর্যাপ্ত লাইসেন্সধারী ড্রাইভিং স্কুল অবর্তমান।


√প্রশাসন এ ব্যপারে কি কোন পদক্ষেপ নিয়েছে?
পথচারী পারাপার বাড়ির বসার ঘরের সো-পিসের মতো পড়ে থাকছে।
√মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি করার দায়িত্ব কি তবে এড়িয়ে যাচ্ছে প্রশাসন?আইনে বলা আছে, “সঠিক স্থানে মোটর যান পার্কিং না করলে বা নির্ধারিত স্থানে যাত্রী বা পণ্য ওঠানামা না করলে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে।” সেক্ষেত্রে চিহ্নিত স্টপেজ ও পর্যাপ্ত পার্কিং এর ব্যবস্থা প্রয়োজন। এসকল ব্যবস্থার দিকে কতটা নজর দিচ্ছে প্রশাসন? তবে কি, সরকার শুধু আইন প্রণয়ন করেই দায় এড়াচ্ছেন? জনসচেতনতা ব্যতীত এবং জরুরি ব্যবস্থাপনা না করে শুধু আইন প্রণয়ন করলে সড়ক পুরোপুরি নিরাপদ হবে না। তবে এই আইনের প্রণয়ন সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আশাকরি এই আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং সঠিক ব্যবস্থাপনার দিকে প্রশাসন দ্রুত নজর দিবেন।

সম্পাদক, মুক্তিফোরাম

Exit mobile version