Site icon মুক্তিপত্র

মুক্তিফোরাম: বর্তমানের আলাপ ও ভবিষ্যতের প্রস্তাব

 
Muktiforum-এর বেশ খানিকটা বয়েস হয়ে গেলো। ষাট হাজার মানুষ এখন ফেসবুকে আমাদের লেখা পড়েন, আমাদের গ্রুপে রয়েছেন আরো ছয় হাজারেক সদস্য। তবে এই দীর্ঘ সময়টা ধরে মুক্তিফোরামের কেন্দ্রীয় প্রস্তাব নিয়ে বিশেষ ভাবে উচ্চবাচ্য করা হয়নাই। তার একটা অন্যতম কারণ হলো এর ওপরে কারো নিজের মতাদর্শ বা স্বপ্ন চাপায়ে দেয়া থেকে বিরত থাকা। আমাদের স্বাধীনতা পরবর্তী ইতিহাসের একটা বড়ো অংশ জুড়ে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং জাতীয় মুক্তির অর্থকে নিজের সুবিধামতন গড়ে নেয়ার ইতিহাস। রয়েছে জাতিসত্ত্বা সম্পর্কে বাংলাদেশের নাগরিকদের বৈচিত্র্যময় বোঝাপড়াকে একমুখী রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদে রূপায়িত করবার একটা অপচেষ্টা।। মুক্তিফোরামের শুরুর থেকে আমাদের লক্ষ্য ছিলো এর থেকে ভিন্ন কিছু করবার। আমরা চেয়েছিলাম যে আমরা পুরানো উপায়ে না এগিয়ে বরঞ্চ একটু খোলামেলাভাবে আগাবো সকলকে কথা বলবার সুযোগ দিয়ে।
 

আমরা চেয়েছিলাম যে আমরা পুরানো উপায়ে না এগিয়ে বরঞ্চ একটু খোলামেলাভাবে আগাবো সকলকে কথা বলবার সুযোগ দিয়ে।

 
তাই আমরা চেষ্টা করেছি আমরা মুক্তি বলতে কি বুঝি সেটা বলবার আগে আমাদের দেশের মানুষ মুক্তি বলতে কি বোঝেন, কিসের থেকে মুক্তির কথা বোঝেন এবং ঠিক কেমনভাবে সেই মুক্তি চান সেটা বুঝতে। ঠিক এইকারণেই মুক্তিফোরামের গঠনপদ্ধতিটি করা হয়েছিলো একটি পাবলিক ফোরামের মতন, যেখানে সবাই এসে কথা বলতে পারবেন তাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ নিয়ে এবং তা নিয়ে যুক্তিতর্ক করবে বাকি সবাই। এই আলোচনার মধ্যে দিয়েই আমরা জাতীয় মুক্তির একটি রূপরেখা পাবো যেটি কিনা দল-নিরপেক্ষ এবং গোষ্ঠী নিরপেক্ষ। আমরা চেয়েছিলাম যে এমন কিছু নতুন চিন্তা উঠে আসবে যেখান থেকে আমরা আমাদের দলীয়, ধর্মীয় এমনকি জাতীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বেও একমত হতে পারবো। সেই প্রয়াসের থেকেই আমরা ধীরে ধীরে একমত হই এই ব্যাপারে যে আমরা স্বৈরাচারকে এবং কর্তৃত্ববাদকে ঘৃণা করি-সেটি যার কাছে থেকেই আসুক না কেনো, যেভাবেই আসুক না কেনো। সেই চিন্তাধারার থেকেই আমরা একটি ফেসবুক পেইজ খুলি যেখানে কিনা সকল ধরণের কর্তৃত্ববাদবিরোধী লেখালেখির একটা জমজমাট আনাগোনা থাকবে। আপাতত সেইখান থেকে আমরা শুরু করেছি বটে, তবে প্রায়শই আমাদের লেখাঝোকাতে সংস্কার, পরিবর্তন, বদল–মোটকথা মুক্তির একটা আকাঙ্ক্ষা দেখা যায়। সেই আকাঙ্ক্ষাটিকেই আমরা ধারণ করতে চাই। আমরা চাই যে মুক্তিফোরাম হবে বাংলাদেশের সকল দল-মত-গোষ্ঠীর পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষার একটা সেন্ট্রাল রিপোজিটরি।কেনো এই কাজটি করা প্রয়োজন? এই কাজটি করা প্রয়োজন কেননা আমাদের দেশে সিভিল সোসাইটি বা জনসমাজ বলতে তেমন কিছু গড়ে ওঠেনাই। আমাদের দেশের রাজনৈতিক শ্রেণী আর জনগণের মাঝে রয়েছে বিস্তর একটি বিচ্ছেদ। ব্রিটেনে বসে থাকা রাজারানীর সিংহাসনের নামে গড়ে তোলা এই রাজ্যব্যবস্থায় জনগণের সমস্যার কথা রাজনৈতিক মহলের কাছে পৌছায় না আর রাজনীতিবিদেরা যে কথা বলেন, জনগণ তা শুনতে চায়না। রাজনৈতিক ক্ষমতাশালীরা তাদের আপ্ত ম্যানিফেস্টো জনগণের ওপরে থুপতে থাকে আর জনগণ তাদের মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে দেয়ালে মাথা কুটতে থাকে। এই বিশাল বিচ্ছেদটাকে দূরীভুত করবার জন্যে প্রয়োজন হয় একটি মুক্ত ও অনুপ্রাণিত জনসমাজের যেটি কিনা প্রয়োজনমাফিক সরকারকে তাদের দাবিদাওয়া শুনতে বাধ্য করতে পারে। যতদিন না পর্যন্ত আমাদের সরকারযন্ত্র সাধারণ জনগণের এই সমাজের কাছে নিয়মিত জবাবদিহী করছে, ততদিন পর্যন্ত একটি সংবেদনশীল রাষ্ট্রযন্ত্র গড়ে তোলা সম্ভব নয়।

যতদিন না পর্যন্ত আমাদের সরকারযন্ত্র সাধারণ জনগণের এই সমাজের কাছে নিয়মিত জবাবদিহী করছে, ততদিন পর্যন্ত একটি সংবেদনশীল রাষ্ট্রযন্ত্র গড়ে তোলা সম্ভব নয়।

 
সেরকম জবাবদিহীতা করবার মতন জনসমাজ গড়ে তোলবার চেষ্টা যে আমাদের দেশে হয়নি, তেমনটি নয়। আমাদের দেশের শিক্ষিত সমাজের অনেকে মিলে এমন কিছু গবেষণা সংস্থা বা সামাজিক সংগঠন গড়ে তুলেছে যেগুলো সময় সুযোগ অনুযায়ী সরকারের সাথে কথা বলতে পারে, তাদের চাপ প্রয়োগ করতে পারে। তবে খুব উচ্চমানের গবেষণা নির্ভর এবং উচ্চমার্গের আলোচনা নির্ভর হবার প্রচেষ্টার কারণে তাদের মাঝে এক ধরণের উচ্চশ্রেণীয় আচরণের ব্যাপার ঢুকে গিয়েছে। কালের পরিবর্তনের দেখা গিয়েছে যে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ যে কথা বলছে, জনসমাজের সংগঠন হয়েও এই সংস্থাগুলো সেই কথা বলতে পারছেনা। কার নির্দিষ্ট দোষে এই ব্যাপারটি হয়েছে তা বলতে পারিনা, তবে বাংলাদেশের জনসমাজের এই সংগঠনগুলো জনপক্ষে শুরু হয়েও এখন অনেকটাই হয়ে দাড়িয়েছে উচ্চশ্রেণীয়দের একটি প্রচারযন্ত্র যেটিকে জনসমাজ না বলে বরং এখন বলা হয় সুশীল সমাজ। এই সুশীল সমাজ সময়ে সময়ে এতোটাই জনসংযোগহীন হয়ে পড়ে যে জনগণ রাজনীতিবিদদের যতোটা অপছন্দ করে, ততটাই অপছন্দ করতে থাকে এই ভালোমানুষী সংস্থাগুলোকে।মুক্তিফোরামের জনসমাজটিকে আমরা এমনভাবে গড়ে তুলতে চাই যাতে করে এই জনসংযোগহীনতার ফাঁদে আমরা কখনও পড়ে না যাই। সেইজন্যে আমরা যথাসম্ভব কঠিন বা উচ্চমার্গীয় কথাবার্তা থেকে দূরে থাকতে চেষ্টা করি। এমন ভাষায় কথা বলতে চেষ্টা করি যেটা কেবলমাত্র মানুষ সহজে বোঝে, তা-ই নয়, বরং সহজে তার সাথে তর্কও করেওতে পারে। এর সাথে আমরা শ্রেণীবদ্ধতা মুক্ত হবার জন্যে আমরা আরো যা করেছি তার মাঝে অন্যতম হলো যথাসম্ভব সেন্সরশীপ থেকে দূরে থাকা। আমাদের গ্রুপে সাধারণত আমরা ভুয়া খবর বাদে কোন মতামতকে রুদ্ধ করিনা, এমনকি গালিগালাজকেও না। অনেক সময় এই কারণে এমন কিছু মতামত বা লেখালেখি আসে যার সাথে আমি এবং আমাদের অনেক সম্পাদক ব্যক্তিগতভাবে সহমত পোষণ করেননা, এমনকি অনেক সময় ব্যথিতও হন। তবে আমরা যখন সেগুলো দেখি, আমরা ধরে নেই যে এই মতামতটিও আমাদের বাংলাদেশের মানুষের মতামত এবং আমাদের মতের যতটা গুরুত্ব রয়েছে, তাদের মতেরও গুরুত্ব রয়েছে ততটা। আর কিছু না হোক, এই প্রক্রিয়াটি অন্তত আমাদের দেশের সকল অংশের মানুষের মতামতকে যাচাই করতে সাহায্য করে।

আমাদের মঞ্চে এমন অনেক কথা এসেছে যেগুলো পরস্পরের সাথে সাংঘর্ষিক। এই সংঘর্ষটা আমাদের কাছে অবাঞ্ছিত নয়, বরং কাংখিত।

এই মডেলটির কারণে আমাদের মঞ্চে এমন অনেক কথা এসেছে যেগুলো পরস্পরের সাথে সাংঘর্ষিক। এই সংঘর্ষটা আমাদের কাছে অবাঞ্ছিত নয়, বরং কাংখিত। আমাদের মঞ্চে এখনও পর্যন্ত যেমন বাম সংগঠনের নেতাদের লেখা ছাপা হয়েছে, একই সাথে তেমনি ছাপা হয়েছে আওয়ামী লিগ সমর্থনকারী লেখকদের লেখা এবং বিএনপি সমর্থক লেখকদের লেখা। এমনকি আমাদের ফেসবুক পেইজের সম্পাদকমন্ডলীর মাঝেও জেনেশুনেই একটি দলীয় ও মতাদর্শিক বৈচিত্র তৈরি করবার চেষ্টা করা হয়েছে যাতে করে সকল দল ও মতের মুক্তির কথা আমরা সমান ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারি। তবে এই মুক্তির আলোচনাতে সবসময় প্রচেষ্টা থাকবে নতুন দিনের কথা বলবার এবং জনগণের সমস্যার কথা বলবার। এই কাজটি করা আমাদের জন্যে প্রায়ই বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। বিশেষত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নির্ভর একটি মঞ্চ হবার কারণে দেখা যায় যে নানান দলাদলির মাঝে আমাদেরকে ফেলার চেষ্টা করা হয় বা আমরা নিজেরাও জড়িয়ে যাই। যেখানে জাতীয় বদলের স্বার্থে, অনুপনিবেশায়নের (ডিকলোনাইজেশনের) স্বার্থে, মুক্তির সার্থে আমরা সাধারণ মানুষের উপকার হয় এমন কিছু পলিসি নিয়ে আলোচনা করতে চাই, সেখানে আমাদের দিকে প্রায়শই উপনিবেশায়নের গর্ভে জন্মানো কিছু না-প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে আমাদের জাতীয় ঐক্যকে বিভাজিত করবার চেষ্টা করা হয়। ধর্ম ও জাতির দাগে, ভাষা ও বিশ্বাসের দাগে, দল ও মতের দাগে আমাদের পরিবর্তনের স্বপ্নকে দ্বিধা-ত্রিধা-চতুর্ধা বিভক্ত করবার চেষ্টা করা হয়। এগুলো আমাদের উপমহাদেশের পুরোনো রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর রপ্ত হয়ে আসা শতক পুরোনো কূটচাল। জাতীয় স্বার্থের, পরিবর্তনের, সংস্কারের, মুক্তির বহু আন্দোলনকে এই চাল চেলে বিভক্ত করে হয়েছে এবং বিভক্ত জনগোষ্ঠীর একেকটি অংশকে তুলে নিজেদের ভোটব্যাংককে শক্তিশালী করা হয়েছে এর আগেও-বহুবার। মুক্তিফোরাম যেহেতু জাতীয় ঐক্যের, জাতীয় মুক্তির একটি দল-নিরপেক্ষ মঞ্চ, এর বিরুদ্ধেও যে একই রকম তৎপরতা করা হবেনা সেটা আমরা কেউ আশা করিনি।তবে সেসব কূটচালে না ভুলবার চেষ্টা করে যাবো আমরা। আমরা চেষ্টা করতে থাকবো যেন বিভক্তির বিরক্তিকর বিতর্কে না পড়ে বরং আমরা সংস্কারের, পরিবর্তনের, বদলের আর মুক্তির নতুন কিছু প্রশ্ন তুলতে পারি এবং সেইসব প্রশ্নের নতুন কিছু উত্তর দিতে পারি। আমরা যাতে দেশের সকল দল মত ও গোষ্ঠীর পরিবর্তনের আলোচনাকে সমানভাবে জায়গা করে দিতে পারি কোন একটি গোষ্ঠীর রাজনৈতিক ক্রিড়ানকে পরিণত না হয়ে। আমাদের বৈচিত্র্যময় লেখালেখি যেনো বিভাজনের স্বার্থে না হয়ে হয় জনগণের সমস্যা সমাধাণের স্বার্থে। যেনো সামাজিক গণমাধ্যমের ব্যক্তিকেন্দ্রিক দলাদলিতে না জড়িয়ে আমরা গণমুখী সংবাদ ও মতামত তুলে ধরতে পারি জনগণের সামনে–যার ওপর দল-মত নির্বিশেষে আস্থা রাখতে পারবে সকলে। আমরা যাতে নতুন আলোচনা করতে পারি যাতে করি রচিত হবে নতুন দিনের বাংলাদেশের রূপরেখা।
 

যেনো সামাজিক গণমাধ্যমের ব্যক্তিকেন্দ্রিক দলাদলিতে না জড়িয়ে আমরা গণমুখী সংবাদ ও মতামত তুলে ধরতে পারি জনগণের সামনে–যার ওপর দল-মত নির্বিশেষে আস্থা রাখতে পারবে সকলে।

 
আমরা যাতে একপেশে না হয়ে যাই, আমরা যাতে শ্রেণীবদ্ধ হয়ে না যাই, আমরা যাতে জনসংযোগহীন হয়ে না যাই। সেজন্যে আমরা আপনাদের সংগে নিয়ে চেষ্টা করে যাবো অবিরাম।
 
আমরা কেমন করে আরও বেশি গণমুখী ও জনকল্যানকর হতে পারি তা জানাতে কমেন্ট করতে পারেন এই পোস্টে অথবা ইমেইল করতে পারেন muktiforum@gmail.com.
 
আপনাদের উপদেশ ও পরামর্শ শুনতে আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করবো।মুক্তিফোরামের পথচলায় অবদান রাখবার জন্যে আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ।
 
–মুক্তিফোরাম সম্পাদকমণ্ডলী 
Exit mobile version