Site icon মুক্তিপত্র

নারী বান্ধব আইন ও প্রশাসন চাই

টংগী পশ্চিম থানার সাব ইনস্পেক্টর আবদুল মালেকের আলাপ শুনে আমার সারা শরীর রাগে কাইপে উঠতেছিল। নিজেরে কি কইয়া থামায় রাখছিলাম আমি বলতে পারব না। পারিবারিক নির্যাতনের সাধারণ ডায়েরি করতে এক ২২ বছর বয়সী তরুণীর সহযোগী হইয়া টংগীর থানায় গেছিলাম। জিডি নেবে না। কারণ জনাব আবদুল মালেকের ভাষ্যমতে, “মেয়ে দোষ করলে জামাই পিটাইতেই পারে! জামাইয়ের অধিকার আছে মেয়েরা পিটানো। ইন্ডিয়ান সিরিয়াল দেইখা আমরা মানবাধিকারকর্মীরা এইসব মেয়েদের থানা পর্যন্ত আনি”!

-তাইলে স্যার দেশে ধর্ষণ নাই, কোন নির্যাতন নাই, মেয়েরা খুব সুখে শান্তিতে আছে?

প্রথমদিকে এস আই আব্দুল মালেকের বক্তব্য ছিল, “যান বাড়িত যান! সংসার যেহেতু মেয়ে করতেই চায়, এইসব জিডি কইরা লাভ নাই। যদি না করতে চায় তাইলে মামলা দিব একবারে।”

তখন উনারে আমরা বুঝাইলাম, “যে মেয়ে সংসার করবে। কিন্তু নিরাপদে সে সংসার করতে চায়। নিরাপত্তার জন্য সে জিডি করতে চাচ্ছে। সে চাচ্ছে জামাইকে বুঝাইতে যে আইন কড়া! আমার গায়ে হাত তুললে তোমারে পুলিশের কাছে নেওয়া হবে সেইটা। তাই জিডির কপি নিয়ে মেয়ে তার সাহস প্রদর্শন করতে পারবে৷ তাছাড়া ব্লাস্ট থেকেই আগে বলা হয়েছিল জিডি হচ্ছে ডকুমেন্টস। ভবিষ্যত যেকোন লিগ্যাল স্টেপে এই ডকুমেন্টস দরকার।”

তাছাড়া সাধারণ নাগরিক নিজের নিরাপত্তার জন্য যেকোন সময় জিডি করতে পারে! তাইলে জনাব আবদুল মালেক কেন জিডি নিবেন না!

ক্রমশ তার কথায় হেনস্থা, তীর্যক মন্তব্য দেখে বুঝা গেছে, সেই এই মেয়ের কথা বা মাইরটারে বিশ্বাস করতেছে না! চার ঘন্টা ধরে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ফিরে সঠিক জিডি কপি লিখতে সক্ষম হইলাম।

এইবার আসল পুরান পালা, ” জামাই মারছে দাগ কোথায়?”

২২ বছরের অপুষ্টির শিকার, ক্ষীণকায়া মেয়েটা প্রবলভাবে যতটুকু পারা যায় চিৎকার করে বলতে চেষ্টা করছে, ” জামাই আমারে মারে, প্রায়ই মারে, এবার ঘুষি দিয়ে মাথায় বাড়ি দিছে”!

আব্দুল মালেক ওসির রুমে যাওয়ার জন্য দাড়ালো! আমিও যাব। উনি দাগ নাই এইজন্য জিডি নিবে না ক্যান, সেই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতেই উঠে দাড়ানো।

-আপনি মানবাধিকারকর্মী, আপনে প্লিজ আসবেন না। আপনের জামাই কি করে?

জনাব আবদুল মালেক, জিডি নিলেন। নিলেন অবশ্য সেই জিদ থেকে যে, মেয়ে মিথ্যা কথা বলছে! সেইটা তদন্ত করে সে দেখতে চায়।

জিডির কপি দিতে গিয়ে বলে, ” নারী নির্যাতন আইনে দেশ ভইরে যাইতেছে, অথচ পুরুষ নির্যাতন আইন দরকার”!

আমি তখন আসলে ক্লান্ত। আমার আর এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে ইচ্ছে করল না।

আজ প্রথম আলোতে আসছে, বাংলাদেশের ২৫% মেয়েরা স্বামীর হাতে মার খায়। পরিসংখ্যান ব্যুরো অনুযায়ী সংখ্যাটি নাকি ৪৩% হবে। কিন্তু এই মাইর খাওয়ার প্রতিবাদ করতে যে পুরুষতান্ত্রিক খচ্চর প্রকৃতির আইন প্রশাসনের পুলসিরাত মেয়েদের পার হইতে হয়, সেই কথা হাজার বার বললেও কি শেষ হবে?

আমার শক্ত নার্ভ বারবার নষ্ট হচ্ছিল! আমি ভাবছিলাম টেম্পার বুঝি এই হারালাম। অথচ মেয়েটা কি সাহসী! কি নির্বিকার চিত্তে পুলসিরাত পার হলো। বাসায় জামাইয়ের কাছে মেয়ে ফিরে গেল জিডি কপি, সাহসী উচ্চারণ, ব্লাস্টের সালিশি আবেদন ইত্যাদি নিয়ে। আমি ছোটখাটো আপোষ করে ক্লান্ত পায়ে যখন বেরিয়ে আসছিলাম ওদের পিচ্ছিল মেঝেটা ধরে, মেয়েটা কেঁদে উঠল এই প্রথম!

আব্দুল মালেকের নোংরা কথায় ও কাঁদেনি!
চার ঘন্টায় তিনবার জিডি কপি লেখার সময় ও কাঁদেনি!
ওর গায়ে দাগ না পাওয়া গেলে ওকে মিথ্যেবাদী বলা হলে ও কাঁদেনি!

কাঁদল কখন? যখন আসলে কাঁদার দরকার নাই! যখন সে জানে, সব বাঁধা সে পার হতে জানে!

আমার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। কিন্তু ইমেজের ফালুদা হবে বলে, কান্নাটা চাপলাম! ওকে রেখে রিকশায় যখন উঠলাম তখন টের পেলাম, নার্ভটা ফেল করেছে! অবশেষে!

টংগীর পশ্চিম থানার জিডি নেবার ঘরটাতে আমি আর মেয়েটার মধ্যে কোন পার্থক্য ছিল না! আমাদের শিক্ষা, অর্থনৈতিক অবস্থান কিংবা সো কল্ড ক্লাসে যোজন দূরত্ব থাকলেও, আমরা একাকার হয়ে গিয়েছিলাম একটা পরিচয়ে, আমরা নারী, শ্রেণীহীনের মধ্যে শ্রেণীহীন!

মারজিয়া প্রভা, লেখিকা, নারীঅধিকার কর্মী, একটিভিষ্ট।

Exit mobile version