Site icon মুক্তিপত্র

পহেলা বৈশাখঃ সংকোচের বিহ্বলতায় হয়ো না ম্রিয়মান

আলোকচিত্র কৃতজ্ঞতা অঁজনিকাডটকম

পহেলা বৈশাখে রমনার বটমূলে যাওয়া বা পান্তা-ইলিশ খাওয়া ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির’ সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা এই প্রশ্নটাই আসলে একটা ভুল প্রশ্ন। কারণ এখানে ধরে নেয়া হচ্ছে, ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’ বলে কিছুর অস্তিত্ব অতীতে ছিলো, এবং এখনো আছে। বাঙালি জাতির বয়স হাজার বছর, এটা কলোনিয়ালকালে তৈরি করা মিথ, আক্রান্ত জনগোষ্ঠী আক্রমণকারীদের জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের বিরুদ্ধে নিজের ইতিহাস খুঁজতে গিয়েই জাতীয়তাবাদী হয়ে ওঠে। হাজার বছর, বা তারও বেশি সময় ধরে, এই ভূখণ্ডে একটা জনগোষ্ঠী তো আছে। কিন্তু ‘বাঙালি’ বলে কোনো শুদ্ধ জাতি ছিলো না কখনোই, আর্যভাষী থেকে শুরু করে তুর্কি মুঘল অনেকের রক্তই, এখানকার স্থানীয় জনগোষ্ঠীর রক্তে মিশে গেছে। এই মিশ্রণের প্রক্রিয়াটা সবসময় রোম্যান্টিক ছিলো না, আজকে যাকে জাতি গঠন বলা হয়, ধর্ষণও তাতে ভূমিকা রেখেছিলো। এখান থেকে “বাঙালি একটা শঙ্কর জাতি” এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানোও ভুল হবে, কারণ কমবেশি সব জাতিই শঙ্কর, সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত অন্যদের ছোঁয়া বাঁচিয়ে নিজেকে শুদ্ধ রেখেছে এমন কোনো জাতির অস্তিত্ব দুনিয়ায় নাই।

কিন্তু জাতি বলতে আমরা যা বুঝি, এই সময়ে, এই অনুধাবনটা কি হাজার বছরের? না, তাও নয়। ভারতে ঐতিহাসিকভাবে জাতি বলতে বোঝাতো আর্যদের চারটি বর্ণের অধীনে বিন্যস্ত বিভিন্ন পেশাজীবী সম্প্রদায়কে। আধুনিকতাকে আত্মস্থ করেন নি যারা, সুযোগ না পাওয়ায় বা আগ্রহী না হওয়ায়, তাঁরা এখনো ‘জাত’ বা জাতি বলতে সেটাই বুঝিয়ে থাকেন। বলিউড সিনেমা দ্রষ্টব্য। আবার পুরো কলোনিয়ালকালে পশ্চিমী দুনিয়ায় জাতি বলতে বোঝানো হতো বিভিন্ন ‘রেসকে’, নাজিরা ইহুদি গণহত্যার মাধ্যমে রেস থিওরিকে তার যৌক্তিক পরিণতিতে নিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত অলমোস্ট কারো কাছেই এই তত্ত্বটাকে অমানবিক মনে হয় নি। বিশ শতকের তিরিশের দশকে ইওরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবীরা একাডেমিতে বেশ খোলাখুলিই এই তত্ত্বের প্রশংসা করতেন। এই তত্ত্বের পক্ষে ‘বৈজ্ঞানিক যুক্তিও’ পাওয়া যাচ্ছিলো, যা পরে ব্যবহৃত হয় ফ্যাশিস্তদের দ্বারা।

বিজ্ঞানীরা আজকে এই ঘৃণ্য ‘রেস থিওরিকে’ পরিত্যাগ করেছেন, জীববিজ্ঞান আজ আর রেইসে বিশ্বাস করে না, নৃবিজ্ঞানও নয়। এই ‘রেস থিওরি’ উপমহাদেশেও ক্ষতির কারণ হয়েছে। সেটা নিয়ে সংক্ষেপে কিছু আলোচনা করা যাক।

উনিশ শতকের ইওরোপে অভিজাতদের আরইয়ান আর কৃষক-কারিগরদের নন-আরইয়ান হিসেবে দ্যাখা হত, মাঝখানে থাকা ইহুদি মধ্যবিত্তদেরকে দ্যাখা হত সেমেটিক হিসেবে, বিশ শতকের ইহুদি গণহত্যার ভিত্তি ছিলো এই থিওরি। ইওরোপিয়ানরা ভারতে এসে স্থানীয় সমাজেও এই থিওরির পক্ষে ‘প্রমাণ’ খুঁজতে থাকে, এবং, এক জার্মান পণ্ডিত প্রাচীন ভারতের শাস্ত্র ঘেঁটে সেখানে ‘আরইয়া’ আর ‘দাসা’ নামে দুটি শব্দ পান। তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান এই ‘আরইয়া’ হচ্ছে ভারতবর্ষের আরইয়ান অর্থাৎ আর্য আর ‘দাসা’ হচ্ছে নন-আরইয়ান অর্থাৎ অনার্য। কিন্তু ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে সেমেটিক ‘রেস’ তাহলে কারা? মুসলমানরা। ‘আর্যসমাজের’ গরু কোরবানি বিরোধিতার উৎস লুক্কায়িত এখানেই। সাভারকর এই তত্ত্বের তুমুল প্রশংসা করেছেন, এবং আরএসএসের রাজনীতিক দর্শন দাঁড়িয়ে আছে এই রেস থিওরির ওপর, তাই তাদেরকে আক্ষরিক অর্থেই ফ্যাশিস্ত বলা যায়।

জাতির অপেক্ষাকৃত মানবিক একটা ইংরেজি প্রতিশব্দ নেশন। নেশনে প্রাচীন ভারতে ব্যবহৃত জাতি শব্দের আঞ্চলিকতা নেই, কলোনিয়ালকালের ইওরোপে ব্যবহৃত রেস শব্দের জিঘাংসাও নেই, এবং বর্তমানে এই অর্থেই প্রায় সার্বজনীনভাবেই জাতি শব্দটি দুনিয়ার সর্বত্র ব্যবহৃত হয়। জাতীয়তাবাদ বলতেও রেসিজম নয়, ন্যাশনালিজমই বুঝি আমরা। জাতীয়তাবাদ ভালো না খারাপ তা নিয়ে বিতর্ক আছে, আমার মতে, এটা সংশ্লিষ্ট জাতির পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। ব্রিটিশ আমলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিঃসন্দেহে ভালো ছিলো, এটা সূর্যসেন প্রীতিলতাদের লড়াইয়ের প্রেরণা যুগিয়েছিলো। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে বিহারি আর পাহাড়িদের জন্য বাঙালি জাতীয়তাবাদ পরিণত হয়েছে একটা বিভীষিকাময় শব্দে। কারণ ক্ষমতা কাঠামোয় বাঙালিদের অবস্থান পরিবর্তিত হয়েছে।

জাতি/নেশনকে রাষ্ট্র/স্টেটের সাথে মিলিয়ে জাতি-রাষ্ট্র বা নেশন-স্টেট তৈরি করাটা কলোনিয়ালিজমের বিরুদ্ধে সময়ের প্রয়োজনে একটা ন্যাশনালিস্ট রেজিস্ট্যান্স ছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে জাতি-রাষ্ট্র সাম্রাজ্যবাদের সেবাদাস প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, ৪৭-পরবর্তী হিন্দুস্তান আর পাকিস্তানকে দ্যাখেন, পুঁজির মুনাফা আর জাতি-রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে আলাদা করা কঠিন হয়ে পড়বে। এটা ৭১-পরবর্তী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

উপমহাদেশের জাতীয়তাবাদ আবার সাম্প্রদায়িকতার সাথেও যুক্ত বটে। ১৯৭১এ যুদ্ধের মাধ্যমে পূর্ব বাংলায় একটি স্বতন্ত্র জাতি গঠিত হয়েছে, এমনকি পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির মতো একটি বিপ্লবী রাজনৈতিক দলও, এই বিশ্বাসের বলয়ের বাইরে যেতে পারে নি। চুয়াত্তরের বিচিত্রায় জিয়াউর রহমানও, যিনি পরে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা হয়ে উঠবেন, একটি জাতির জন্ম নামে আর্টিকেল লিখেছিলেন। আজকে আয়রনিকাল মনে হতে পারে অনেকের কাছে, কিন্তু সেই আর্টিকেলে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে ব্যাপক সাফাই গাওয়া হয়েছিলো। এখন আপনি যদি ধরে নেন ১৯৭১এ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পূর্ব বাংলায় একটি জাতি ‘গঠিত’ হয়েছে, তাহলে অনিবার্যভাবেই যেই প্রশ্নটা আসে, একাত্তরের আগে এই ভূখণ্ডের মানুষেরা কি জাতি ছিলো? পাকিস্তানি জাতি ছিলো? পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের সাথে তাদের ফারাকটা সম্প্রদায়গতই তো?

ফলে অখণ্ড ভারতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে অসাম্প্রদায়িক সম্ভাবনা ছিলো, আজকে সেটা নস্যাৎ হয়ে গেছে, ভারতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের মানে দাঁড়িয়েছে আঞ্চলিকতা আর বাংলাদেশে সেটা কার্যত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের সমার্থক।

তাহলে কি পহেলা বৈশাখ পালন করবো না? কারো আর্থিক সামর্থ্য থাকলেও পান্তা-ইলিশ খাবো না? বটমূলে যাবো না? অংশ নেবো না আমরা কেউ মঙ্গল শোভাযাত্রায়? গাইবো না রবীন্দ্রসঙ্গীত? মেনে নেবো উলেমা লীগ, হেফাজতে ইসলামের ফতোয়া? অথবা ‘শিরক’ বর্জনের আহবান জানানো ফেসবুক ইভেন্টের?

এই সমূহপ্রশ্নের জবাবটা আসলে খুবই সোজাঃ না।

উৎসবের একটা সার্বজনীনতা আছে, যার উদ্দেশ্য মানুষের হৃদয়কে প্রসারিত করা, সংকুচিত করা নয়। নিঃসন্দেহে শ্রেণীবৈষম্য উদযাপনের সীমানাটা নির্ধারণ করে দেয়, অন্তত ব্যক্তির ক্ষেত্রে, কিন্তু সেটা উৎসব বর্জনের কোনো কারণ নয়। ঈদের দিনেও মসজিদের বাইরে দরিদ্র মানুষেরা থালা হাতে দাঁড়িয়ে থাকে একটু করুণার আশায়, তখন যদি আপনার মনে না পড়ে শ্রেণীবৈষম্যের কথা, পহেলা বৈশাখের দিন মনে পড়বে কেনো?

পাহাড়িদের বৈসাবি উৎসবে বাধা আসে, তাই আমরা পহেলা বৈশাখ উদযাপন করবো না, এই যুক্তিটাও অনেকটা চোরের ওপর রাগ করে মাটিতে ভাত খাওয়ার মতো। আমরা পহেলা বৈশাখ বর্জন করলে পাহাড়িদের কোনো লাভ নেই, লাভ আছে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ও গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নে, যা সকল নাগরিককে সমানভাবে দেখবে এবং পাহাড়িদের জাতিগত পরিচয় ও ভূমিগত অধিকার স্বীকার করে নেবে। যৌন সহিংসতা বা নিপীড়ণের জন্যও পহেলা বৈশাখকে দায়ী করা অসৎ উদ্দেশ্যজনিত অপযুক্তি মাত্র। নারীরা তো এসবের শিকার হন লোকাল বাসেও, বা গলির ভেতরেও, আপনি কি সেইসব জায়গা নিষিদ্ধ করে দেবেন? এতে আখেরে স্রেফ সরকারের উপকার হবে মাত্র। নিরাপত্তার নামে তারা দেশটা ওপেন এয়ার প্রিজন বানাচ্ছে, আর উন্নয়নের নামে চালাচ্ছে লুটপাট, পহেলা বৈশাখে ডিএমপির জারিকৃত বিকেল পাঁচটার পরে বাইরে না-থাকাসংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞা এই প্রতারণাপ্রকল্পেরই অংশ মাত্র। পহেলা বৈশাখ বর্জন নয়, যৌন সহিংসতা-নিপীড়ণের দীর্ঘমেয়াদী সমাধান নিহিত আছে সকল নাগরিককে সমানভাবে দেখা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সকল মানুষের সমান মর্যাদায় বিশ্বাসী মানুষের সমাজ গড়ে তোলায়, তাৎক্ষণিক সমাধান অপরাধীদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসা।

তাই এবারের পহেলা বৈশাখ হোক সর্বজনের উৎসব। রবীন্দ্রনাথও তাঁর বৈশাখসংক্রান্ত গানে “অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা” লিখেছিলেন, বসুন্ধরা শপিংমল ল্যাখেন নাই, এটাও আমাদের বোঝা দরকার। জাতি-রাষ্ট্রের নিগড়ে নয়, পুঁজির মুনাফাতাড়িত উল্লাসেও নয়, পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হোক প্রাণে প্রাণ মেলানোর আবেগতাড়িত অসাধারণ রূপময় একটি উজ্বল উৎসব হিসেবে।

১৩ এপ্রিল ২০১৬য় লেখাটি ইস্টিশনে প্রকাশিত হয়ে। ব্লগে তুলে রাখলাম। এই লেখাটি এখনো অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায় নি, বরং বলা চলে, বিভিন্ন কারণেই এই লেখার প্রাসঙ্গিকতা আরো বেড়েছে।

লেখকঃ ইরফানুর রহমান রাফিন, মুক্তিফোরামের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য

Exit mobile version