Site icon মুক্তিপত্র

জঙ্গিকে জঙ্গি নামে ডাকতে পারছি না কেন?

ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন শিক্ষাঙ্গনকে কারাগারের নিকটাত্মীয় বানিয়ে রেখেছে। পরিবারগুলি এর থেকে নিস্তার চায়। ছেলেমেয়েদের শিক্ষাজীবন নিরাপদ থাকবে কি, যেখানে জীবন নিয়ে টানাটানি সেখানে গণতন্ত্র বাঁচলো কি মরলো তা দেখার মন থাকবার কথা না। নেইও। ছাত্রহত্যার মিছিল থামাতে তাই রাজনীতির মিছিলটাই থামিয়ে দেবার প্রস্তাব উঠেছে।

আগে সরকার বা ক্ষমতাসীন দলের সমালোচনা করলে ছাত্রলীগ বা পুলিশ নির্যাতন করতো, বুয়েটের নতুন পরিবেশে আবরারের মতো দেশ সচেতন রাজনৈতিক বক্তব্য দিলে কি প্রশাসন তাকে শাস্তি দেবে? আবরারের মৃত্যু শিক্ষাঙ্গনকে নিরাপদ করার প্রেরণা হোক, জবান আরো টিপে ধরার উসিলা যেন না হয়।

গোলাপকে গোলাপ নামে ডাকতে পারছি না আমরা। হত্যা–সন্ত্রাসের অধিকাংশ ঘটনায় জড়িত সংগঠনটির নাম নিতে পারছি না। বলতে পারছি না যে, তাদের কার্যকলাপ জঙ্গিদের মতো ধ্বংসাত্মক। ক্যাসিনো–মাদক–নির্যাতনে দায়ী যুব সংগঠনটিকে বন্ধ করার কথাই বা কে বলবে? তারা জঙ্গিদের মতোই শুধু লাশই ফেলছে না, নিজেরাও লাশ হচ্ছে আবার দেদারছে তৈরি করছে অনুতাপহীন খুনীর গ্যাং। তারা সংগঠিতভাবে পঞ্চম বাহিনীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।

যারা সংগঠিতভাবে জনগণকে অর্থনৈতিক ক্ষয়ে ও শারীরিক ভয়ে রেখেছে, সেসব সংগঠন জাতীয়ভাবে বহাল রেখে ছাত্রতরুণদের আমরা কীভাবে নিরাপদ রাখব? তনু বা রিফাতের নৃশংস মৃত্যু বন্ধ করতে হলে কোন রাজনীতি বন্ধ করতে হবে, তা বলা যাচ্ছে না। বুয়েটে খুন হয়েছে এক ভাই, এক সন্তান, কিন্তু আরো কতগুলি ভাই, কতজনের সন্তান যে খুনী হয়ে গেল—তাদের এই বিকৃতি বন্ধ করার উপায় কী? কাউকে খুনী বানিয়ে আর কাউকে খুনের শিকার করার এই কারখানা বন্ধ না করা পর্যন্ত ভালমন্দে মেশানো স্বাভাবিক দেশ আমাদের হবে না।

ছাত্র রাজনীতি বন্ধের প্রস্তাব আসায় বুয়েট কৃর্তৃপক্ষ থেকে সরকার উভয়ই হাঁফ ছাড়তে পেরেছে। যে আন্দোলন ছিল ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের টর্চার সেল এবং ভিসি সাহেবদের প্রশাসনিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে, সেটাকে ছাত্র রাজনীতির বিপক্ষে ঠেলে দেয়া গেছে। আড়াল করে ফেলা গেছে আবরারের দেয়া ফেসবুক স্ট্যাটাসের নির্মম সত্যটাকে। হত্যা–সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জাতীয় ছাত্র আন্দোলনের জোয়ারটাকেও বিভক্ত ও নিস্তেজ করা গেছে।

আসলেই তো, ছাত্র রাজনীতির নামে সন্ত্রাসীদের হত্যা–নির্যাতন ও অবৈধ অর্থ কামাইয়ের সুযোগ খোলা রাখা হবে কেন? ছাত্র রাজনীতি বলতে মানুষ আর স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সংগ্রামকে বোঝে না। রাজনীতির খোলের তলায় যা আছে তার নলচে বদলাতে হবেই। কিন্তু তার আগে একে তো সঠিক নামে চিনতে লাগবে, চেনাতে লাগবে। স্বনামে বললে একে বলতে হয় রাজনৈতিক দস্যুতন্ত্র। আমলা–প্রশাসনের বড় অংশই এর সুবিধাভোগী বিধায় সহযোগীও বটে। একে কীভাবে দাঁতনখহীন করা যাবে?

ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শক্তি তো নিজেকে নিষিদ্ধ করবে না! তাহলে কী সমাধান!

সমাধান হয়তো আছে। কিন্তু আমরা যেন জ্বলন্ত উনুনের চাইতে ফুটন্ত কড়াইকে সমাধান ভেবে না বসি। একসময় দলীয়করণ ও হানাহানি বন্ধে এসেছিল সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা। কিন্তু তারপরের রাজনীতি আগের চাইতে নৃশংস ও ধ্বংসাত্মক হয়েছে। বিএনপি–জামাত জোটকে পঙ্গু করে দিয়ে মাইনাস টুয়ের ৫০ শতাংশ সমাপ্তির পথে। বাকি ৫০ ভাগ হলো আওয়ামী লীগের রাজনীতি। এই রাজনীতি নিজেই নিজেকে বাতিল করেছে দুই দফার বিতর্কিত নির্বাচন এবং যাবতীয় প্রতিশ্রুতি ভাঙ্গার মাধ্যমে। রাজনীতিহীনতার এই আকালে ভয়াবহ দুর্নীতি আর নিষ্ঠুরতার ভাইরাস সকলকেই আক্রমণ করছে।

রাজনীতি আসলেই আর নেই। আছে চড়া মূল্যে ক্ষমতা ধরে রেখে সম্পদ বানাবার কারবার। যুবলীগের ক্যাসিনোকাণ্ডে তো দেখা গেল, রাজনীতির মঞ্চ দখল করে আছে পেশাদার অপরাধীরা। রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনের দপ্তরে বসেছে টর্চার সেল। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলিতে চলে নির্যাতন ও হত্যা। এভাবে বিএনপির রাজনীতি ধ্বংস করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের চরিত্রও আমূল বদলে গেছে। পেশাদার রাজনীতিবিদদের জায়গা দখল করে নিয়েছে ভেতর–বাহিরের ক্রিমিনাল ‘কাউয়ারা’। বিএনপির শূন্যতার মতো আওয়ামী লীগের এই বিপর্যয়ও দেশের জন্য ভাল হয়নি।

বিরাজনীতিকৃত করার ফল একদিকে রাজনীতির অপরাধীকরণ, অন্যদিকে জনগণের সঙ্গে নেতাদের বিপদজনক বিচ্ছিন্নতা। এই পরিস্থিতি দুবৃত্তপনা আর চরমপন্থার জন্য দুয়ার খুলে দিয়েছে।

জরুরি অবস্থার সময় তো রাজনীতি শতভাগই বন্ধ ছিল, তাতে করে পরিস্থিতি কি কিছুমাত্র ভাল হয়েছে? ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর বিরোধী রাজনীতি প্রায় বিলুপ্ত, সরকার দলীয় রাজনীতিও নিষ্ফলা নির্বাচন ও দুর্নীতিতে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। দেশে এখন রাজনৈতিক চর্চা নেই, গণপ্রতিনিধিত্ব নেই, সংগঠনে দলের নিষ্ঠাবান সৎ নেতৃত্বের আসন নেই। রাজনীতিহীনতার এই আবহেই চলছে জনগণের কষ্টকর জীবনযাত্রা। এর যেন কোনো শেষ নেই।সুতরাং, বুয়েটে বা সারা দেশে জাতীয় রাজনীতির ক্যাম্পাস–সংস্করণ বন্ধ করলে জীবন নিরাপদ হবে, শিক্ষা সুগম হবে অভিজ্ঞতা তা বলে না। উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্র বন্ধ করার ফল আমরা দেখেছি, শান্তির জন্য রাজনীতি বন্ধ করার ফলও তো হাতেনাতে পাচ্ছি। সমাধান যদি হয় সমস্যারই পেছনের মলাট, সেটারই আরেক মুখোশ, তাহলে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের যে পথ বাতলানো হচ্ছে, তাতে সমস্যা না কমে আরো কঠিন ও করুণই হয়ে উঠবে।

কিন্তু কোনো সন্দেহ নেই যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নেতানেত্রীর নামে স্লোগান, দলের নামে মাস্তানি, ব্যানারের তলে নষ্টামি অবশ্যই বন্ধ করাতে হবে। ক্ষমতামুখী সংগঠনের শাখাপ্রশাখা রাখা যাবেই না। ছাত্রছাত্রীদের আদর্শিক–সাংস্কৃতিক–সমবায়ী চর্চার সুযোগ ও সুরক্ষা দিতে হবে। তবে কিছুতেই কিছু হবে না যদি ডাকসু–জাকসু–রাকুস–চাকসুসহ সকল উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কলেজগুলিতে ছাত্রছাত্রীদের নির্বাচিত কল্যাণ পরিষদ না থাকে। এসব নির্বাচিত পরিষদ শুধু ছাত্রছাত্রীদের অধিকার ও শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশের পক্ষেই কাজ করবে না, তারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের জবাবদিহির জন্য প্রেশার গ্রুপ হিসেবে কাজ করবে। এগুলো খোলা জানালার কাজ করবে।ছাত্রলীগের নৃশংস কার্যকলাপের দায় সমগ্র ছাত্র সমাজ ও ছাত্র রাজনীতি কেন নেবে? বুয়েটের ছাত্র আবরার ফেসবুকে যে সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ দিয়েছিল, তার পেছনে ছিল দেশপ্রেমের রাজনৈতিক অঙ্গীকার। ছাত্রসমাজের এই সুস্থ অঙ্গীকারই ছিল গত ১০০ বছরে এই ভূখণ্ডের অধিকাংশ অর্জনের শক্তি। এই অঙ্গীকারের শক্তির প্রয়োজন বাংলাদেশের মতো আইনের শাসনের উদরাময়ের দেশে এখনো ফুরায়নি। ইউরোপ ও আমেরিকার আজকের সমাজ–রাষ্ট্রকে ষাটের দশকের ছাত্র–যুব আন্দোলন ছাড়া কল্পনাই করা যায় না। চীন দেশে যদি কোনোদিন গণতন্ত্র আসে, আরব বসন্তের ফুল যদি কোনোদিন সত্যিই ফলে, অবশ্যই তা ছাত্র আন্দোলন ছাড়া হবার নয়।ঐসব উন্নত অর্থনীতির গণতান্ত্রিক দেশে হয়তো তরুণদের রাজনৈতিক চর্চার দরকার বর্তমানে আর নেই। কেননা নিকট অতীতেই তারা আন্দোলন–সংগ্রাম–যুদ্ধের মাধ্যমে নাগরিকের অধিকার ও রাষ্ট্রের সার্বভৌম মর্যাদা সুরক্ষিত করেছে। সেখানে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বঞ্চিত বা নির্যাতিত হলে সাধারণত রাষ্ট্র তার পক্ষে দাঁড়ায়, আদালতে তারা শক্ত পায়ে দাঁড়াতে পারে, সংবিধান তাকে ভরসা জোগায়। আমাদের মতো দেশে সেই নাগরিক সাম্য, মানবিক আইনের শাসন এবং বৈষম্যবিরোধী সমাজ এখনো দুরস্ত।

তারচেেয় বড় কথা, সকলে চাইলেও দাপটের রাজনীতিতে তরুণদের ব্যবহার বন্ধ করা অসম্ভব। ক্ষমতা যেখানে জনসম্মতির ভিত্তিতে আসে না, প্রশাসন যেখানে আইনের চাইতে ভয় ও লোভ দ্বারা বেশি চালিত, প্রচুর বেকার যেখানে রাজনীতির খুঁটি ধরে জীবিকা উপার্জনে বাধ্য, সেখানে ছাত্র রাজনীতির বর্তমান ধরন বন্ধ করা যেতে পারে, কিন্তু ছাত্রতরুণদের পদাতিক–লেঠেল হিসেবে ব্যবহার করা, জনবিক্ষোভ দমনের হাতিয়ার করা এবং তলা থেকে ওপরে দুর্নীতির টাকা পাঠানোর পাইপলাইনে তাদের খাটানো ভিন্ন কৌশলে চলবেই। বলপ্রয়োগ, দমন ও প্রলোভনের দাঁিড়য়ে আছে এই ব্যবস্থা। নতুন কোনো সামাজিক শক্তির উত্থানের মাধ্যমে নতুন রাজনীতির প্রতিষ্ঠা ছাড়া বাঁচার কোনো সহজ পথ আমাদের জানা নেই।ক্ষমতাসীনদের জন্য দলীয় ব্যানার ছাড়াও ক্ষমতা প্রদর্শনের বহু উপায় আছে। গলাচিপা ইউনিয়ন কল্যাণ সমিতি কিংবা ভাঙ্গা উন্নয়ন পরিষদের নামে তারা গলা চিপে ধরতে পারবে, হাতুড়ি দিয়ে হাড় ভাংতে পারবে। সন্ত্রাসী সংগঠনগুলিকে নিষিদ্ধ ও বর্জিত করে সুস্থ ধারার সংগঠনগুলিকে বাড়তে দিলে ছাত্ররা নিরাপদও থাকবে আবার জাতিগঠনেও অবদান রাখার সুযোগ পাবে। সমস্যার উৎসে হাত না দিয়ে টোটকা সমাধান বরং সমস্যাকে আরো যন্ত্রণাদায়ক করে তুলবে। মূলজ্ঞান ছাড়া কাণ্ডজ্ঞানে ভরসা করে বেশিদূর যাওয়া যায় না।

আগামী পর্বে: হয় ধারণ করে বদলাও, নয়তো বাতিল হও। রাজনীতির যে কাঠাগোমগত পরিবর্তন জরুরি

তৃতীয় পর্ব: কোটা সংস্কার এবং জাস্টিস আন্দোলনের অর্জন ও ব্যর্থতা

লেখকঃ ফারুক ওয়াসিফ একজন কবি ও লেখক

Exit mobile version