Site icon মুক্তিপত্র

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ধ্বংসের ৪ টি কারণ

রাজনৈতিক ভাবে আমরা যেই নির্বাচনী ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন করি এই ব্যবস্থাকে ইংরেজিতে বলা হয় “ফার্স্ট পাস্ট দা পোস্ট সিস্টেম”। অর্থাৎ এই ব্যবস্থার অধীনে একাধিক প্রাথীর মধ্যে যে সব চেয়ে বেশি ভোট পাবে সেই জয়ী ঘোষিত হবে। এই ব্যবস্থার চারটি বড় বড় সমস্যা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ধ্বংসের অন্যতম কারন (স্বচ্ছ নির্বাচন যদি হয়েও থাকে তারপরেও):

১.) ধরুন আমাদের জাতীয় নির্বাচনে ৪ টি দল প্রার্থী নিয়োগ দিয়েছে: আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামাতি ইসলাম আর জাতীয় পার্টি। ধরুন কোন এক আসনে আওয়ামীলীগ ভোট পেয়েছে ৩২ শতাংশ, বিএনপি ভোট পেয়েছে ৩০ শতাংশ,জাতীয় পার্টি ভোট পেয়েছে ১৮ শতাংশ আর জামাতি ইসলাম ভোট পেয়েছে ২০ শতাংশ। ওই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী কে বিপুল ভোটে জয়ী ঘোষণা করা হয়েছে। জনগণ তাকেই বেছে নিয়েছে। কিন্তু আসলেই কি তাই? লক্ষ করুন যে বেশিরভাগ জনগণই, ৬৮ শতাংশই, কিন্তু তার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিলো, কিন্তু তারপরও সে ওই আসনের জনমতামতের বিরুদ্ধে জয় লাভ করলো। বাংলাদেশে বহু নির্বাচনে বহুবার এরকম হয়েছে।

২.) ফার্স্ট পাস্ট দা পোস্ট সিস্টেমে সব সময় অবশেষে যে কোনো নির্বাচনী আসনে অথবা যে কোন রাষ্ট্রে অবশেষে দুই প্রার্থী অথবা দুই দলের বেশি রাজনৈতিক ভাবে টিকে থাকা সম্ভব না। এই ব্যবস্থার অধীনে কখনোই বহু দলীয় রাজনীতির চর্চা সম্ভব না। আগের উদাহরণের কথাটাই একবার চিন্তা করুন। দ্বিতীয় নির্বাচনটা ঠিক কেমন হবে? ধরুন জাতীয় পার্টির ভোটাররা বেশিরভাগ বিষয়েই আওয়ামীলীগের সাথে সহমত আবার জামাতি ইসলামের ভোটাররা বেশিরভাগ বিষয়েই বিএনপির সাথে সহমত। আবার জাতীয় পার্টির ভোটাররা বিএনপি ক্ষমতায় আসুক এটা একদমই চায় না আর জামাতি ইসলামের ভোটাররা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসুক এটা একদমই চায় না। তারা উভয়ই গত নির্বাচন দেখে এই ধারণাটা পেয়ে গেছে যে তাদের সব চেয়ে পছন্দের দল ক্ষমতায় আসার কোনই সম্ভাবনা নাই, তারা তাদের ভোট অপচয় করতে চায় না তাই জামাতি ইসলামের বেশিরভাগ ভোটাররাই এবার বিএনপি কে ভোট দিয়েছে আর জাতীয় পার্টির বেশিরভাগ ভোটারাই ভোট দিয়েছে আওয়ামীলীগকে। ওই দুই দলই এবার ১০ শতাংশ করে কম ভোট পেয়েছে । জামাতি ইসলামের ভোটাররা জানে যে গতবার অল্পের জন্য বিএনপি হেরেছে। তাদের ভোটটা পেলেই হয়তো বিএনপি জয় লাভ করত। এই ভাবে দ্বিতীয় নির্বাচনে বহুদলীয় রাজনীতি পরিণত হয়েছে দুইদলীও রাজনীতিতে। যদিও কিছুই কিন্তু বদলায় নাই। তৃতীয় শক্তির পক্ষের সমর্থনই কিন্তু এখনো সব চেয়ে বেশি। গণতন্ত্রের চর্চার স্বার্থে বহুদলীয় রাজনীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে জবাবদিহিতা বাড়ে আর রাজনীতিবিদরা তখন যা খুশি তাই করতে পারে না। এই ফার্স্ট পাস্ট দা পোস্ট সিস্টেমের কারণেই বাংলাদেশে এত বছর পরেও বিএনপি আওয়ামীলীগের বাইরে কোন দল জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয় নাই। এই কারণেই কিন্তু বাংলাদেশে স্বচ্ছ নির্বাচনের সময়ও কিন্তু ভোটারদের নির্বাচনী অংশগ্রহণ থাকে তুলনামূলক ভাবে অনেক কম।

৩.) তৃতীয় নির্বাচনে জামাতি ইসলাম আর জাতীয় পার্টি দেখলো যে তাদের নির্বাচন করাটাই বৃথা তাই তারা সিদ্ধান্ত নিলো যে এইবার তারা নির্বাচনে যাবে না। কিন্তু ইসলামিক আন্দোলন বাংলাদেশ ঠিক করলো যে গত নির্বাচনের অনেক ভোটাররাই অসন্তুষ্ট আছে, তৃতীয় শক্তির প্রকৃত ভোটারই বেশি, তাই তারা এবার নির্বাচনে যাবে। এই নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ভোটাররা কিছুতেই চায় না যে ইসলামিক আন্দোলন বাংলাদেশ ক্ষমতায় আসুক। তাদের ১৮ শতাংশ ভোটার ভোট দিলো আওয়ামীলীগকে। আবার বিএনপির কিছু ভোটার দেখলো যে তাদের চিন্তাধারাটা বিএনপির সাথে তো মিলেই, কিন্তু ইসলামিক আন্দোলন বাংলাদেশ সাথে আরো বেশি মিলে। এই নির্বাচনে আওয়ামীলীগের ভোট সংখ্যা হল ৫০ শতাংশ, বিএনপি ৩০ শতাংশ আর ইসলামিক আন্দোলন ২০ শতাংশ। যদিও প্রকৃত পক্ষে বিএনপি আর আওয়ামীলীগের মাঝে রাষ্ট্রীয় সমর্থন প্রায় কাছাকাছি, নির্বাচনে এসে এদের মধ্যকার ব্যবধান হয়ে গেলো অনেক।

৪.) শেষ সমস্যাটা হচ্ছে নির্বাচনী আসন নির্ধারণ নিয়ে। ইংরেজিতে এটাকে বলা হয় “জেরিম্যান্ডারিং”। ধরুন কোনো এক এলাকায় ইসলামিক আন্দোলন বাংলাদেশের সমর্থনে আছে ৬ জন, বিএনপির ৪ জন আর আওয়ামীলীগের ৪ জন। বিএনপি আওয়ামীলীগ উভয়ই জানে যে চতুর্থ নির্বাচনে তারাই প্রধান দুই দল হিসেবে স্বীকৃতি পাবে সুতরাং তারা এই এলাকাকে এমন দুই ভাগে ভাগ করল যে এক আসনে আওয়ামীলীগ ৪ ভোট আর ইসলামিক আন্দোলন বাংলাদেশ ৩ ভোট পেয়ে আওয়ামীলীগ জয়যুক্ত হলো আর অন্য আসনে বিএনপি ৪ ভোট আর ইসলামিক আন্দোলন বাংলাদেশ ৩ ভোট পেয়ে বিএনপি জয়যুক্ত হল। এই এলাকায় ইসলামিক আন্দোলন বাংলাদেশের সমর্থন বেশি এবং আসন একটা তাদের প্রাপ্য ছিল, কিন্তু তারা পেলো না।

আমরা যদি প্রকৃত পক্ষে পরিবর্তন চাই তাহলে আগে সংস্কারের প্রয়োজন। লক্ষ করবেন যে আওয়ামীলীগ হোক আর বিএনপিই হোক তারা দেশের সমস্যার সমাধান হিসেবে নিজেদের ক্ষমতায় আসার কথা ঠিকই বলে কিন্তু তারা কখনোই এইরকম ব্যবস্থার সংস্কারের কথা বলে না। কেন জানেন? কেননা তারাও জানে যে এই ব্যবস্থার অধীনে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যাবহার খুব সহজ। তারা দেশের ভালো চায় না, তারা ক্ষমতা চায়। এই ফার্স্ট পাস্ট দ্যা পোস্ট সিস্টেমের বিকল্প সমাধান হচ্ছে দুটি:

১.) অল্টারনেট ভোটিং সিস্টেম অথবা বিকল্প নির্বাচন ব্যবস্থা
২.) সিঙ্গেল ট্রান্সফারেবেল ভোটিং সিস্টেম অথবা একক হস্তান্তরযোগ্য নির্বাচন ব্যবস্থা

এগুলো নিয়ে না হয় পরবর্তী কোনো পোস্টে আলোচনা হবে।

লেখাঃশামস ইস্তিয়াক রহমান

Exit mobile version