ইভিএম ভোটের প্রবক্তারা বলছেন এর ফলে সুষ্ঠ নির্বাচন নিশ্চিত হবে, বিরোধীদের দাবি ইভিএম এর মাধ্যমে ফলাফল ‘পূর্ব-নির্ধারিত’ হয়ে যাবার আশংকা থাকে ।

মুক্তি ফোরাম প্রতিবেদন

২০১৮ এর জাতীয় নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশন (ইসি) যখন ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবহারের প্রস্তাব উত্থাপন করলো, তখন থেকেই বিএনপি এর তীব্র বিরোধিতা করে আসছে। বিএনপির ভাষ্য “সরকারের উদ্দেশ্য পূরণের” জন্যই ইভিএম ব্যাবহারে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার সেসময় বলেছিলেন সব রাজনৈতিক দল একমত হলেই ইভিএম ব্যবহার করা হবে।

কিন্তু প্রায় তিন বছরেও এ বিষয়ে কোনো ঐকমত্য তৈরী হওনি। ফলত: তীব্র আপত্তির মধ্যেই ইসি ঢাকার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ইভিএম এ সম্পূর্ণ ভোট গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এটাই হবে বাংলাদেশে প্রথম কাগজের ব্যালট বিহীন ভোট।

ইভিএম এ ভোট গ্রহণের আপত্তি হিসেবে বিএনপি বারংবার একি যুক্তি দিয়েছে। তাদের দাবি, ইভিএম ভোটে ইসি “নিজেদের পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে” যেয়ে ফলাফল পরিবর্তন করে দিতে পারে।

ইভিএম দিয়ে ভোট গ্রহণ না করতে আবেদন জানিয়ে জানুয়ারিতে বিএনপি আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়েছে নির্বাচন কমিশনকে। ইভিএম প্রযুক্তির “দুর্বলতা” বিবেচনায় কাগজের ভোটে ফিরে যাবার আহবান জানানো হয়েছে সে পত্রে।

ইসি বলছে ইভিএম এ ভুয়া ভোট দেয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। কিন্তু ইসির আশ্বাসে ইভিএম বিরোধীরা নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। নির্বাচনের ঠিক আগেই সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) বলেছে মানুষের ইভিএম ব্যাবস্থার উপর কোনো আস্থা নেই, কারন, সুজন বলছে, নির্বাচনী কর্মকর্তারা ইভিএম এর ফলাফল পরিবর্তন করতে সমর্থ হবেন এমন আশংকা রয়েছে।

ক্ষমতাসীন দলের নেতারা, বিশেষত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়েদুল কাদের বিএনপির বক্তব্যকে প্রোপাগান্ডা বলে নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন “অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যাবহারের ফলে” সুষ্ঠ নির্বাচন নিশ্চিত হবে।

সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ব্যাবহৃত ইভিএম গুলো তৈরী হয়েছে বাংলাদেশ আর্মির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি-তে। যন্ত্রগুলো তৈরির জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে যন্ত্রাংশ আমদানি করা হয়েছে, এবং বাংলাদেশে বানানো হয়েছে।

ইভিএম এ প্রযুক্তির মাধ্যমে কারচুপি হতে পারে বিরোধীদের এমন আশংকার কতখানি বাস্তব ভিত্তি রয়েছে? ড. মাহফুজুল ইসলাম এর মতে এমন আশংকা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।

‘বর্তমান ইভিএম পদ্ধতির ফলে কারচুপির সকল পথ রুদ্ধ হয়েছে’

“হার্ডওয়্যার বা সফটওয়্যার এ হস্তক্ষেপ করে ইভিএম পদ্ধতিকে প্রভাবিত করা কোন ভাবেই সম্ভব নয়,” ড. মাহফুজুল ইসলাম বলেন। বুয়েটের কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এর ফ্যাকাল্টি ড. মাহফুজুল ইসলাম ইসি গঠিত ১৯ সদস্য বিশিষ্ঠ টেকনিক্যাল এক্সপার্ট দলের একজন সদস্য ছিলেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে গঠিত এ দলটি ইভিএম এর ডিজাইন ও পরীক্ষায় ইসিকে সহায়তা করেছে।

ড. মাহফুজুল ইসলাম বলেন ইভিএম পদ্ধতিটি তৈরী করার সময় প্রথাগত কারচুপির সব রাস্তা বন্ধ করার দিকে মনোযোগ দেয়া হয়। ফলে সে সকল পথ ইভিএম এর মাধ্যমে বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

“যেভাবে সাধারণত কারচুপি হয় তারমধ্যে একটা হলো আগেই ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখা। সে উপায় এখন আর নেই। মেশিনগুলো এমনভাবে প্রোগ্রাম করা আছে যেন ভোট শুরুর সময় শূন্য ভোট দিয়ে শুরু হয়। আগে থেকে এখানে কেউ ভোট দিয়ে রাখলেও কোনো কাজ হবেনা। নির্বাচন আরম্ভের যে সময় দেয়া আছে মেশিনে ঠিক তখন ভোট শূন্য হয়ে যাবে। প্রিসাইডিং অফিসার বা অন্য কারো এখানে কিছু করার ক্ষমতাই নেই,” তিনি মুক্তি ফোরাম কে বলেন।

তিনি আরো জানান একজনের ভোট আরেকজন দিয়ে দেয়া এবং ভোট গণনার সময় ফলাফল পরিবর্তিত করে দেয়া হলো কারচুপির আরো দুটি পন্থা। এ দুটি রাস্তাও এখন আর নেই।

“অতঃপর যে তিনটি পদ্ধতিতে ভোট কারচুপি হয় তা ইভিএম ব্যবহার করার কারনে এখন আর হবে না,” তিনি বলেন।

“আঙুলের ছাপ না মিললে কেউই ভোট দিতে পারবেনা। মেশিন সে ভোট নিবে না।“

এছাড়া ভোট গণনা থেকে শুরু করে সকল প্রক্রিয়া মেশিনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পাদিত হবে। সেখানে হস্তক্ষেপ করা অসম্ভব, ড. মাহফুজুল ইসলাম বলেন।

তিনি আরো জানান যে বাংলাদেশের ইভিএম মেশিন পৃথিবীতে একমাত্র ইভিএম পদ্ধতি যা ভোটার এর পরিচয় শনাক্ত করতে পারে। “দুনিয়ার অন্য সব ইভিএম শুধুমাত্র কাউন্টিং মেশিন। সেগুলো শুধু দেখে কতবার বোতাম চাপা হয়েছে। কাজেই আন্তর্জাতিক মানদন্ডে উন্নীত হবার কোনো প্রশ্নই এখানে নেই,” বলেন ড মাহফুজুল ইসলাম।

‘পেপার অডিট ট্রেইল না থাকলে মেশিনের ফলাফল যাচাই করার কোনো উপায় থাকেনা’
কিন্তু বিএনপির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক রিয়াজুল ইসলাম রিজু বলেন ভোটার শনাক্তের পদ্ধতি থাকবার ফলে ভোট সুষ্ঠ কিভাবে হবে যদি প্রিজাইডিং অফিসার ভোট দিয়ে দিতে পারে এবং ইভিমে ব্যাবহৃত প্রযুক্তির শুদ্ধতা নিরুপনের জন্য কোনো নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক নেই।

রিজু বলছেন প্রিসাইডিং অফিসারের হাতে ভোট দেবার ক্ষমতা ইভিএম সিস্টেমের একটি মারাত্মক ত্রুটি।

“কখনো তারা বলছেন ৫ পার্সেন্ট ভোট প্রিসাইডিং অফিসার দিতে পারবে। আরেকসময় বলছে ২৫ পার্সেন্ট। আবার একসময় শুনছি তারা বলছে ২ পার্সেন্ট,” আঙুলের ছাপ না মিললে প্রিসাইডিং অফিসারের ভোট দেবার বিষয় নিয়ে মন্তব্য করেন রিজু।

বিএনপির এই প্রতিনিধি ইভিএম মেশিনে ব্যাবহৃত টেকনোলজি নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

“আমরা ইসির কাছে ইভিএম এর সোর্সকোড চেয়েছিলাম। আমরা বলেছি আমরা পরীক্ষা করে দেখাই যে ইভিএম এর প্রোগ্রামিং এ হস্তক্ষেপ করা সম্ভব,” বলেন রিজু।

তিনি তার দলের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে বলেন বর্তমান নির্বাচন কমিশন এর অধীনে সুষ্ঠ নির্বাচন সম্ভব নয় এবং সেকারণেই তাদের অধীনে ইভিএম যে সঠিকভাবে ফলাফল দেবে তাও বিশ্বাসযোগ্য নয়।

“যারা মেশিনগুলো বানিয়েছে তাদের কাছে সোর্সকোড আছে। এ মেশিনগুলো যে ফলাফল পরিবর্তিত করবেনা তার কি নিশ্চয়তা আছে?” বলেন রিজু।

বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০১৮ এর জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ৯৬ শতাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়ী হয়। এ নির্বাচন মারাত্মক অনিয়মের জন্য সমালোচিত হয়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ৫০ টি নির্বাচনী এলাকা পর্যবেক্ষণ করে ৬৬% স্থানে আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি করা হয়েছে বলে পেয়েছে।

রিজু বলছেন ইসি যদি সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো নিরপেক্ষ তৃতীয় পক্ষ নিয়োগ করে যারা ইভিএম যন্ত্রের বিশুদ্ধতা যাচাই করবে সেক্ষেত্রে ইভিএম গ্রহণযোগ্য হতে শুরু করবে।

রিজু পেপার অডিট ট্রেইল না থাকার সমালোচনা করে বলেন এর ফলে নির্বাচনের ফলাফল চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব হবেনা। ইসির ১৯ সদস্য বিশিষ্ঠ টেকনিক্যাল এক্সপার্ট দল তাদের সুপারিশের সময় পেপার অডিট ট্রেইল এর পদ্ধতি নাকচ করে দিয়েছিল।

“তারা যদি পেপার অডিট ট্রেইল এর পদ্ধতিটা রাখতো তাহলে রেজাল্টটা চ্যালেঞ্জ করা যেত। কাগজে থাকা রেকর্ড মেশিনের রেকর্ডের সাথে মিলিয়ে দেখা যেত। এখন আর তার কোনো উপায় নেই,” রিজু বলেন।

পেপার অডিট ট্রেইল, যা ভোটার ভেরিফায়েবল পেপার অডিট ট্রেইল (ভিভিপিএটি) ও ভেরিফায়েবল পেপার রেকর্ড (ভিপিএর) হিসেবে পরিচিত, একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে ইভিএম মেশিনের হিসাব কাগজে সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা থাকে। সেক্ষেত্রে প্রত্যেক ভোটার ভোট দেবার পর একটি কাগজের ব্যালট প্রিন্ট আউট হয়ে বের হয় এবং জমা হয়ে থাকে। এতে প্রত্যেক ভোটার কোন প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন তার লিখিত থাকে।

ফলস্বরূপ, ভোট গণনার সময় মেশিনের ফলাফল এবং কাগজের ফলাফল মিলিয়ে দেখা যায়। যদি কেউ মেশিনের ফলাফল পরিবর্তন করে থাকে, তবে কাগজের সাথে গরমিল দেখে তা ধরা পরে যাবে।

‘পেপার অডিট ট্রেইল অপ্রয়োজনীয়’

কিন্তু ড মুহাম্মদ মাহফুজুল ইসলাম বলছেন বর্তমান ইভিএম সিস্টেমের অধীনে পেপার অডিট ট্রেইল এর কোনো প্রয়োজন নেই।

ইসির ১৯ সদস্য বিশিষ্ঠ টেকনিক্যাল এক্সপার্ট দলের চেয়ারম্যান প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরী পেপার অডিট ট্রেইল পদ্ধতি রাখবার সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু তার প্রস্তাব গ্রহন করা হয়নি এটি ‘বাস্তবসম্মত’ না হবার ফলে, মাহফুজুল ইসলাম জানান।

“ভোটার এর ভোট একটি গোপন বিষয়। কিন্তু ইভিএম এ ভোট দেবার পর যদি তা প্রিন্টআউট হয়ে বের হয়ে আসে তাহলে তা আর গোপন থাকলো না। এছাড়াও ইভিএম ব্যাটারী চালিত। প্রিন্ট করলে ব্যাটারী শেষ হয়ে যাবে, সেটাও একটা সমস্যা। এসব কারনেই পেপার অডিট ট্রেইল রাখা হয়নি, এবং আমরা সেটা স্যারকে (প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরী) বুঝিয়ে বলেছি,” বলেন ড মাহফুজুল ইসলাম।

প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরী সম্প্রতি ডেইলি ষ্টার পত্রিকাকে বলেন এ বিষয়ে নেয়া সিদ্ধান্তের কথা তাকে জানানো হয়নি, যদিও তিনি টেকনিক্যাল কমিটির চেয়ারম্যান।

ড মাহফুজুল ইসলাম বলেন পেপার অডিট ট্রেইল ছাড়াই সুষ্ঠ নির্বাচন নিশ্চিত হবে ইভিএম এ। “এ মেশিনগুলো রি-প্রোগ্রামেবল না। এ মেশিনগুলোতে কারচুপি করা যায় না। এ কারনেই পেপার ট্রেইল এর ডিবেটাটা একটি অপ্রয়োজনীয় ডিবেট,” তিনি বলেন।

যেকারণে আগে ভোট অডিট করা প্রয়োজন ছিল, তা হলো কাগজের ব্যালট নকল করা যেত। এখন তার কোনো উপায় নেই, ফলে ইলেকশনের রেজাল্ট পরিবর্তনেরও কোনো উপায় নেই। “কাজেই নিরপেক্ষ অডিট এর প্রশ্নটাই অযৌক্তিক,” ড মাহফুজুল ইসলাম বলেন।

Share.

I am an Example Writer. Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipisicing elit, sed do eiusmod tempor incididunt labored et dolore magna aliqua. Ut enim ad minim veniam, quis nostrud exercitation ullamco laboris nisi ut aliquip ex ea commodo consequat.

Leave A Reply