স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতন হয়েছে। যতবারই চিন্তা করি… নিজেরই বিশ্বাস হয় না।

তবে, স্বৈরাচার হাসিনার পতনের পরবর্তী সময় পরে চলছে লুটতরাজ আর নৈরাজ্য। এই নৈরাজ্যে বসেই, বিগত স্বৈরাচারের ব্যবচ্ছেদ করা দরকার।
>>প্রথম প্রশ্ন, আপনারা কি দেখছেন….? বাংলাদেশ হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক বিএনপি ও জামায়াত, উভয় দলকে ধন্যবাদ দিয়েছেন।

দল দুটি হিন্দুদের সম্পদ ও জীবন রক্ষায় যদি সাহায্য করে থাকে, তাহলে অবশ্যই তারা ধন্যবাদ প্রাপ্য। তবে শুধু বিএনপি আর জামায়াত কেনো ধন্যবাদ পাবে?

সংখ্যালঘুদের সম্পদ ও জীবন রক্ষায়, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছাত্র-ছাত্রীরাও ধন্যবাদ প্রাপ্য…

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট, শেখ মুজিব খুন হওয়ার পর, ট্যাঙ্কের উপরে উঠে নৃত্য করেছিলেন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের নেতা হাসানুল হক ইনু। যাকে ২০১২ সালের দিকে করা হলো, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের তথ্যমন্ত্রী! এই রহস্যগুলো জট খেলা দরকার।

১৯৯৪ সালে বাংলাদেশের প্রবাদপ্রতিম নারী, শহীদ রুমীর মা, জাহানারা ইমাম মারা যান। এর দুই বছর পর আওয়ামী লীগে যোগদান করেন মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী। ১৯৯৬ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এর দুই বছর আগে ১৯৯২ সালে, দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের অন্য আরেকটি অংশ বাকশাল নামে পরিচিত (যেটা স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার দলের মতন এতটা ফ্লেক্সিবল ছিলো না, নিজেদেরকে সমাজতন্ত্রী) চালিয়ে নিয়ে যাওয়া আব্দুর রাজ্জাকও আওয়ামী লীগে পুরা বাকশালসহ যোগ দেন।

এর মাঝের সময়টায়, জাহানার ইমাম মারা যাওয়ার পর, হুমায়ুন আহমেদ, হুমায়ূন আজাদ, আসিফ নজরুল, আহমদ শরীফের মতন মানুষজন ছাড়া ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির বাকিরা যোগ দেয় আওয়ামী লীগে। কেউ পদ নেয়, আর কেউ যোগ দেয় প্রকাশ্যে। কিন্তু এরপর আওয়ামী লীগে বেশ কিছু অদ্ভুত পরিবর্তন আসে, পরিবর্তন আসে বিএনপিতেও।

>শেখ হাসিনার লেখা সামরিকতন্ত্র বনাম গণতন্ত্র বইতে সে দাবী করছে, সে এরশাদের বিরুদ্ধে ১৯৮৬ সালে ভাষণ দিছিলো, “পুলিশ, বিডিআর, সেনাবাহিনীকে বলতে চাই – আপনারা জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন না। জনগণের বিরুদ্ধে বন্দুক তুলে ধরবেন না। বাংলার জনগণ তাহলে আপনাদের রেহাই দেবে না … আর যদি এদেশের মানুষের বুকের উপর গুলি চালান হয়, আর যদি এদেশের মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়, আপনাদের প্রতি আমার আহ্বান – প্রতিশোধ নেবেন”। অথচ, এই ভাষণ যে সে দিছে, এর সপক্ষে নাই কোনো প্রমাণ (কোনো পত্রিকায় রেফারেন্স নাই, নাথিং এট অল, স্রেফ উনার নিজের মুখের কথা)। উল্টা এরকমটাও ঘটছে যে, ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনা বলছিলো, “এরশাদের এই নির্বাচনে যে যাবে, সে জাতীয় বেঈমান”।

এর কিছুদিনের মধ্যেই, ১৯৮৬ সালের ৭ই মে, শেখ হাসিনা এরশাদের অধীনে নির্বাচনে যায়। যেখানে আওয়ামী লীগ পায় ৭৬ আসন, আর এরশাদের সদ্য সৃষ্ট জাতীয় পার্টি পায় ১৫৩ আসন। ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারী, এরশাদ সরকারের পতনের পর, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে কেনো খালেদা জিয়া জিতলো, আর শেখ হাসিনা হারলো?

এরশাদবিরোধী আন্দোলনে খালেদা জিয়া কখনো আপোষের দিকে যায়নি। যে কারণে খালেদা জিয়ার পরিচিত হয়ে ওঠে আপোষহীন নেত্রী হিসেবে। শেখ হাসিনা তখন এক অদ্ভুত চরিত্র। পরিচিতি পায় জাতীয় বেঈমান হিসেবে। শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে জামায়াতের সঙ্গে আন্দোলন করতেও কুন্ঠাবোধ করেনি। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি (ঘাদানিক), বাকশাল, কাদের সিদ্দিকী আওয়ামী লীগে জোট করার পর শেখ হাসিনার ফ্লেক্সিবল থাকার অপশন কমে আসে অনেকটাই।

>> কিন্তু এর প্রভাব পড়ে বিএনপির উপর। যে বিএনপি এক সময় বলেছে, কস্মিনকালেও এরশাদের কাছে যাবে না। সে দলটিও কাছে টেনে নেয়, এরশাদের জাতীয় পার্টিকে। অথচ এর আগে পরে এরশাদ ছিলো শেখ হাসিনার সহচর। ১৯৯৬ সালেও হাসিনা- এরশাদ একত্রে জোট সরকার গঠন করে।

২০০৮ সালের নির্বাচনে এরশাদের দল অংশ নেয়ার মধ্য দিয়ে, হাসিনার জোট পরিণত হয় মহাজোটে। এমনকি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শেখ হাসিনাকে তার বোন ডেকে গেছে স্বৈরশাসক এরশাদ। কিন্তু ২০০১ সালে, ঘাদানিক আওয়ামী লীগে মিশে গেছে টের পেয়ে বিএনপি চলে যায় প্যানিক মোডে, সে চলে যায় জাতীয় পার্টির সাথে চার দলীয় জোট করতে। এখানেই শেষ না, চার দলীয় জোটে আরো আসে মুফতি ফজলুল হক আমিনীর ইসলামী ঐক্যজোট, যারা আশির দশকেও নারী নেতৃত্ব হারামে বিশ্বাসী ছিলো, আসে জামাত, শেখ হাসিনার জান-ই-জিগর, যাদের ছাত্র উইং ছাত্রশিবির নিজেরা উত্তাল আশি আর নব্বইয়ের দশকটায় রক্তের লড়াইয়ে লিপ্ত ছিলো বিএনপির ছাত্রদলের সাথে (জনশ্রুতি আছে যে এককালের ছাত্রদল নেতা জুনায়েদ আহমেদ পলক রাজশাহীতে শিবিরের এক সদস্যকে খুন করার পর বিএনপি তাকে আশ্রয় দেয় নাই)।ঠিক এই সময়টাতেই, ফলে তাকে আওয়ামী লীগে যোগ দিতে হয় পলককে।

ছাত্রদল আর ছাত্র মৈত্রী উভয় সংগঠনের দাবী, শিবিরের হামলায় সবচেশে বেশি মারা গেছে তাদের কর্মীরা। ছাত্রলীগ এমন কোনো দাবী করে না। বিএনপির চার দলীয় জোট গড়ার একমাত্র কারণ ছিলো, ঘাদানিক আর আওয়ামী লীগের মিশ্রণটা আটকানো।

কারণ ঘাদানিক আওয়ামী লীগের মিশ্রণ এতটাই দ্বিমুখী, একই সাথে তার আছে ক্যাডার আর আদর্শ। ২০২৪ সালের ছাত্র- জনতার অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে পতন হয়েছে তাদের।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ যে অনেক ভোট পায়। এটার আসল কারণ মেরুদণ্ডহীন পরজীবী ঘাদানিক মেজরিটির এনে দেয়া ভোট। যার অন্যতম অস্ত্র ছিলো মুহম্মদ জাফর ইকবালের কাটছাঁট করা লেখা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।

>> আমরা দেখতে পাই, বিএনপি ক্রমাগত হাসিনার আওয়ামী লীগের মতো ফ্লেক্সিবল হয়েছে। নাহলে তার পক্ষে জামায়াত বা জাতীয় পার্টির সাথে জোট করা সম্ভব হতো না। বিএনপির একটা দুর্নাম বা সুনাম আছে, তারা নাকি এন্টি-ইন্ডিয়া রাজনীতি করে। এইটাও পুরোপুরি সত্য না।

২০০৪ সালে, বিএনপি তৈরী করে বাংলাদেশের ইতিহাসে রক্ষী বাহিনীর চেয়ে বেশি রহস্য সৃষ্টি করা ‍র‍্যাব। এই র‍্যাবের শুরু অপারেশন ক্লিনহার্ট নামের এক অপারেশন (২০০২-২০০৩) সালের দিকে। বিএনপি বিশেষ দায়মুক্তি আইনের মাধ্যমে র‍্যাবকে মানুষ মারার বৈধতা দেয়। অপারেশন ক্লিন হার্টে মারা যায় আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির (!) অনেক নেতা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সুন্দরবনে লুকিয়ে থাকা মাওবাদীরা। যারা পরিচিত ছিলো পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি নামে।

বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির লোকাল পরিচিতি ছিলো লাল পতাকা বাহিনী, সর্বহারা পার্টি, ইত্যাদি নামে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, যাদের নেতারই যোগাযোগ ছিলো নকশাল-মাওবাদীদের সাথে। সেই মারা পড়ছে।

যারা খুলনা, রাজশাহী বা বরিশাল ফরিদপুর অঞ্চলে নব্বইয়ের দশকে বড় হয়েছেন। অনেকের হয়তো এই মাওবাদীদের কথা, তাদের কিডন্যাপ আর খুনাখুনির ফিরিস্তি, মনে পড়ে থাকতে পারে।

তো যেটা হয়, এই মাওবাদীদের অনেককে অপারেশন ক্লিনহার্টে মেরে ফেলা হয়। এতে সবচেয়ে বেশি লাভবান কে হয়? এতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয় ভারত। কারণ ভারতের সশস্ত্র নকশাল/মাওবাদীরা, যারা একটা লম্বা সময় ছিলো দিল্লীর নাম্বার ওয়ান সমস্য। বাংলাদেশে বর্ডার পার হয়ে লুকাতো তারা। এটা কোনো গোপন সংবাদও না। এটা এমন কি ২০২০ সালেও পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লেখালেখি হয়েছে।

অপারেশন ক্লিন হার্টের পর পশ্চিমবঙ্গে মাওবাদীরা অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে। কারণ তাদের আর ইন্টারন্যাশনাল বর্ডার দিয়ে অতি সহজে পালানোর পথ ছিলো না।

>> বিএনপি মূলত ভারতকে অনেকবার বাজায়ে দেখছে। অনুপ চেটিয়াকে বাংলাদেশ করিডোর হিসেবে ব্যবহার করতে দেয়া, দশ ট্রাক অস্ত্রের সেই ঘটনা, ইত্যাদি। বলা যেতে পারে, বিএনপি ভারতের সাথে খেলছে মাথায় মাথায়।

আওয়ামী লীগের মতন অর্থনৈতিকভাবে কোলে চড়ে বসে নাই। কিন্তু এই বিএনপিই ভারতের এমন এক উদ্দেশ্য করেছে, মাওবাদী নিধনের মধ্য দিয়ে, যা এখনো পর্যন্ত ভারতের স্বস্তি ও নিরাপত্তার অন্যতম কারণ। আর তাই, বাংলাদেশ হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব যখন বিএনপিকে ধন্যবাদ দেয়, তখন ভাবতে হয়, এটা ভারতের সাথে বিএনপির সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা না তো আবার।

কারণ বিএনপি নির্বাচনী প্রচারণায় এন্টি ইন্ডিয়া বক্তব্য দিলেও সামরিক ক্ষেত্রে বা অন্যান্য বহু ক্ষেত্রে যে, ভারতকে তার ‘পারপাস সার্ভ’ করে দিবে না, এর নিশ্চয়তা বা অভয় পাওয়া যায় না।

বিএনপি একটা সেয়ানা দল। সে ঘাদানিককে ঠেকানোর জন্য গিয়েছিলো তার জাতশত্রু এরশাদের কাছে। সেয়ানা হওয়া সমস্যা না। কিন্তু আরেকটু ক্লিয়ার পলিসিওয়ালা দল হইলে, তার গতিবিধি বুঝতে সুবিধা হয়। বিএনপির গতিবিধি বোঝা কঠিন। দলটি ওই অর্থে পপুলিস্ট বা জাতীয়তাবাদীও না।

>> আপনারা যাকে ভোট দিবেন, সেই যেনো জয় লাভ করে। কারণ গণতন্ত্রের প্রথম শর্ত, জনগণের অনিচ্ছায় ক্ষমতায় চেপে বসে থাকা যাবে না। আপনার ভোটই যেনো হয় বাংলাদেশের ভবিষ্যতের ম্যান্ডেট

লেখকঃ মীম আরাফাত মানব

Share.

মুক্তিফোরাম একটি মুক্তিবাদী, বহুত্ববাদী এবং জনপন্থী সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে গড়ে ওঠা সংগঠিত গণমঞ্চ। এর লক্ষ্য হলো নতুন ধরণের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক চর্চা নির্মাণ। নোংরা হিসেবে রাজনীতির যে রূপকল্প এদেশের মানুষের কাছে নির্মাণ করা হয়েছে, সেটিকে চ্যালেঞ্জ করতে চায় মুক্তিফোরাম। আবার যেসব একক আদর্শ (যেমন বামপন্থা-ডানপন্থা) বা পরিচয়ের রাজনীতি (সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, জাতিবাদ) দিয়ে জনগণের সংহতি ও বৈচিত্র্য হুমকির মুখে ফেলা হয়েছে তার একটি এন্টিডোট হয়ে ওঠাও মুক্তিফোরামের প্রকল্প।

Leave A Reply