গত ৫ অগাস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে একটি দাবি সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই কমবেশি উঠছে – শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী রাজনীতি নিষিদ্ধ হোক। এই দাবির পক্ষে অবশ্য কিছু আপাত যৌক্তিক কারণও তুলে ধরা হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে, বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ও কলেজ পর্যায়ে, গত কয়েক দশকে গড়ে ওঠা শিক্ষার্থী রাজনীতির সংস্কৃতি। সাধারণ সূত্র অনুযায়ী, রাষ্ট্রক্ষমতায় যখন যে রাজনৈতিক দল থাকে, তখন সেই দলের সহযোগী শিক্ষার্থী সংগঠন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে সবকিছুর ওপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ নেয়। 

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অ্যাকাডেমিক কাজ থেকে শুরু করে দাপ্তরিক কাজে হস্তক্ষেপ ও প্রভাব বিস্তার, ভর্তি বাণিজ্য, অবকাঠামো উন্নয়নের বাজেট থেকে চাঁদাবাজি, হলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সিট বণ্টন, র‍্যাগিং-নিপীড়ন-নির্যাতন, শিক্ষার্থীদের মাঝে ত্রাস তৈরি করা, ক্যাম্পাসে অবস্থিত বিভিন্ন দোকানপাটে বাকি খাওয়া ও চাঁদাবাজি, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও স্থানীয় প্রভাবশালী নেতার হয়ে জমি দখল, অন্তর্দলীয় কোন্দলের জেরে নিজ দলের সদস্যের ওপর হামলা ও হত্যা, প্রতিপক্ষ ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীদের সাথে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ, এমনকি হত্যা-ধর্ষণ ইত্যাদি নানান অপরাধের সাথে ক্ষমতাসীন দলের শিক্ষার্থী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা যুক্ত হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে দানা বেঁধেছে, আমরা তখন দেখেছি কীভাবে ছাত্রলীগকে ব্যবহার করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা করে ও ভয় তৈরি করে আন্দোলন নস্যাৎ করতে চেষ্টা করেছে সদ্য পতিত আওয়ামী লীগ সরকার।

তবে উপরোক্ত কারণগুলো যেমন সত্য তেমনি এটাও সত্য যে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক সচেতনতার কারণেই দেশের ইতিহাস বারবার বড় ধরনের বাঁক নিয়েছে। পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর থেকে অদ্যাবধি, রাজনীতি সচেতন শিক্ষার্থীরাই বেশিরভাগ ইতিবাচক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছে। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের এগার দফা আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং সর্বশেষ বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী আন্দোলন যা রূপ নেয় শিক্ষার্থী-জনতার সম্মিলিত স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে – প্রতিটি আন্দোলনই বাংলাদেশের ইতিহাসে বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। এর পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে ২০১৫ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ‘নো ভ্যাট’ আন্দোলন এবং ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনও শিক্ষার্থীদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে তৈরি হওয়া রাজনৈতিক সচেতনতার সাক্ষ্য দেয়।

যেখানে শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক সচেতনতা রাষ্ট্রের ইতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে, সেখানে তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কলেজ ক্যাম্পাসে রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি কেন উঠছে? এর একটা প্রধান কারণ হিসেবে পূর্বেই উল্লিখিত শিক্ষার্থী রাজনীতির সংস্কৃতিকে ধরা যায়। প্রধানত দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি-আধাসরকারি কলেজগুলোতে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের শিক্ষার্থী সংগঠনের আধিপত্য এতোটাই অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে সাধারণ শিক্ষার্থীদের একটা অংশ হয়তো মনে করছে এসব থেকে মুক্তির উপায় হচ্ছে শিক্ষার্থী রাজনীতি নিষিদ্ধ করে দেওয়া। কিন্তু যে ব্যাপারটি হয়তো আলোচনায় সচরাচর আসে না, তা হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিদ্যমান, সেটি মূলত ক্ষমতাসীনদের দ্বারা সৃষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ‘বিরাজনীতিকরণ’ প্রক্রিয়া ।     

প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে এই বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া কীভাবে কাজ করে? কয়েকটি স্তরে এটা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। একটি স্তরে দেখা যায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করা রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে কেবল ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের শিক্ষার্থী সংগঠনকেই সর্বোচ্চ ক্ষমতা দেওয়া হয়। যদিও তাত্ত্বিকভাবে ক্ষমতা পাওয়া এসব রাজনৈতিক সংগঠনের উদ্দেশ্য হওয়ার কথা না, কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত আইনে শিক্ষার্থীরা ক্ষমতাকাঠামোতে যুক্ত হতে পারে না (স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে আলাপটি ভিন্ন, শিক্ষার্থী সংসদের প্রতিনিধিরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের সদস্য হতে পারেন)। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক সংগঠনের প্রধান কাজ হবে শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া নিয়ে প্রশাসনের সাথে দর-কষাকষি করা। তবে সেটি সচরাচর দেখা যায় না বাংলাদেশের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে; দু-একটি শিক্ষার্থী সংগঠন বাদ দিলে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর শিক্ষার্থী সংগঠনের কাছে ক্যাম্পাস রাজনীতি মানে ক্যাম্পাসে দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা ও সর্বোচ্চ আধিপত্য বিস্তার! ফলে অন্য কোনো রাজনৈতিক সংগঠন সেখানে আর কাজ করার সুযোগ পায় না। এই একচেটিয়া আধিপত্যের মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিরাজনীতিকরণের প্রাথমিক কাজ সম্পন্ন হয়।

সমান্তরালভাবে আরো কয়েকটি স্তরে বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া চলমান থাকে। এর মধ্যে অন্যতম হলো বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের হলগুলোতে আসন বন্টনের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা চলে যায় ক্ষমতাসীন শিক্ষার্থী সংগঠনের নেতাকর্মীদের হাতে। এ অবস্থায় রাজনীতিতে যুক্ত না হওয়া শিক্ষার্থীরা অসহায় হয়ে নেতাকর্মীদের পেছনে ঘুরতে বাধ্য হয়। হলে আসন পাওয়ার ক্ষেত্রে শর্ত থাকে যে ওই শিক্ষার্থীকে ক্ষমতাসীন শিক্ষার্থী সংগঠনের প্রতি আনুগত্য দেখাতে হবে। বিরাজনীতিকরণের আরেকটি উপায় হচ্ছে ক্ষমতাসীন শিক্ষার্থী সংগঠনের মতাদর্শের বাইরে যায় – এমন ধরনের অ্যাকাডেমিক বা সাংগঠনিক আলোচনায় হস্তক্ষেপের পাশাপাশি স্বাধীন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ। এক্ষেত্রে ক্যাম্পাস জুড়ে এক ধরনের ভয়ের সংস্কৃতি তৈরির মাধ্যমে ক্ষমতাসীন শিক্ষার্থী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে সাক্ষাৎ ত্রাস হিসেবে আবির্ভূত হয়। এই ত্রাস টিকিয়ে রাখতে মাঝে-মাঝেই নেতাকর্মীরা দলবদ্ধ হয়ে ক্যাম্পাসে ‘শো-ডাউন’ করে এবং নানান আক্রমণাত্মক স্লোগানের মাধ্যমে নিজেদের শক্তি-সামর্থ্যের জানান দেয়। এর সাথে চলে শ্রেণীকক্ষে, আড্ডায়, সভা-সেমিনারে, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বিরোধী মত দমন। এমনকি অ্যাকাডেমিকভাবে স্বাধীন মত প্রকাশ করা শিক্ষকদেরও রাখা হয় নানান সার্ভেইলেন্স ও ভয়ের মধ্যে।

এই বিরাজনীতিকরণের মাধ্যমে কি হয়? প্রথমত, শিক্ষার্থীরা তাদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া নিয়ে কথা বলতে সাহস পায় না। ফলে বিভিন্নভাবে তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে হয়। দ্বিতীয়ত, শিক্ষার্থীরা রাজনৈতিক বিশ্লেষণে ভয় পায়। তাদের কাছে মনে হয় রাজনীতি নিয়ে কথা বলা ইতিবাচক কিছু নয়। ‘রাজনীতি’ একটি নেতিবাচক প্রপঞ্চ হিসেবে হাজির হয় শিক্ষার্থীদের কাছে। চায়ের দোকানের সাইনবোর্ডে লেখা “এখানে রাজনৈতিক আলাপ করা নিষেধ” বাস্তবতা পায় নিজেদের জীবনেও। এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা নিজেদের ‘অরাজনৈতিক’ বা ‘apolitical’ হিসেবে পরিচিত করায়। তাদের সামাজিক মাধ্যমের পরিচিতিতেও তখন চায়ের দোকানের সাইনবোর্ডের মতন লেখা থাকে – “I hate politics”। এই যে “I hate politics” মনোভাব নিয়ে শিক্ষার্থীরা রাজনীতি থেকে দূরে সরে যায়, তার প্রভাব পড়ে সমাজের সর্বত্র। 

এই রাজনীতিকে ঘৃণা করা শিক্ষার্থীরা পরবর্তীতে সমাজের বৃহত্তর কোনো সমস্যার দায় সহজে নিতে চায় না৷ যেহেতু ‘অরাজনৈতিক’ থাকা মানে সকল রাজনৈতিক সমস্যা থেকে নিজেকে দূরে রাখা, তাই সামাজিক সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রেও একই দূরত্ব মেনে চলা হয়। এই ধরনের মনোভাব পোষণ করা শিক্ষার্থীর যুক্তিবোধ হয় অনেকটা এমন – “সমাজে নানান অনাচার-অন্যায় হয় মূলত রাজনীতিবিদদের কারণে। রাজনীতিবিদরাই সকল সমস্যার মূলে। সম্ভব হলে তাদের বিচার হোক, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।” সামাজিক সমস্যা এড়িয়ে চলা একজন ‘অরাজনৈতিক শিক্ষার্থী’ চায় পড়াশোনা শেষ করে একটা নির্ঝঞ্ঝাট জীবন, এসব উটকো ঝামেলায় কে জড়াবে! 

এই যে ক্রমশ শিক্ষার্থীরা নিজেদের রাজনীতি থেকে দূরে রাখে, এটারই সুযোগ নেয় দুর্জনেরা। রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় এলাকার মাদক কিংবা চোরাকারবারি ব্যবসা করে আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া কারো হাতে। কখনো বাজার সিন্ডিকেটের সদস্য প্রভাবশালী নেতার হাতে কিংবা আদম ব্যবসায়ী কোনো নব্য ধনীর হাতে৷ আবার কর ফাঁকি দেওয়া বড় ব্যবসায়ী অবৈধ টাকার গরমে নির্বাচনে প্রার্থী হন। কখনো কখনো বিনোদন জগত কিংবা ক্রিকেট খেলে সেলিব্রিটি বনে যাওয়া অনেকের শখ হয় সংসদ সদস্য কিংবা পরবর্তীতে মন্ত্রী হওয়ার। সেখানে মাঠপর্যায়ে দীর্ঘদিন কাজ করা দক্ষ ও সৎ রাজনীতিবিদও অনেক ক্ষেত্রে রাজনীতিতে টিকে থাকতে পারে না। আর অন্যদিকে বিরাজনীতিকরণের শিকার শিক্ষার্থীরা সকল ধরনের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখার কারণে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে চুপ থাকে এবং রাষ্ট্রে স্বৈরাচারী ব্যবস্থা বেড়ে ওঠার রসদ যোগাতে থাকে।  

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হওয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা গত সাড়ে ১৫ বছরে একটি রাজনৈতিক দলকেই ক্ষমতায় দেখেছে। ফলে একচেটিয়াভাবে তাদের কাছে শিক্ষার্থী রাজনীতির সমার্থক হিসেবে ছাত্রলীগের নামটি সামনে এসেছে। তারা অতীতে ছাত্রদল কিংবা ছাত্রশিবিরের রাজনীতির ইতিহাস দেখেনি; যদিও সেসব ইতিহাস ছাত্রলীগের গত ১৫ বছরের ইতিহাস থেকে খুব একটা আলাদা ছিল না। এমনকি ক্যাম্পাসভিত্তিক অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মকাণ্ড নিয়েও সকলের খুব বেশি ধারণা নেই। এমন একটা অবস্থায় শিক্ষার্থীদের কাছে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের রাজনীতি কিংবা একেবারে শিক্ষার্থী রাজনীতি নিষিদ্ধ করে দেওয়াই বাস্তব সমাধান মনে হতে পারে; যাতে তারা পরবর্তীতে ক্ষমতাসীন শিক্ষার্থী সংগঠনের হাত থেকে মুক্তি পায়। এক্ষেত্রে তাদের সামনে কখনো কখনো রাজনীতিমুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ধারণাটি অনেক জনপ্রিয় হয়ে দেখা দেয়। কিন্তু হয়তো শিক্ষার্থীদের একটা অংশ এটাও অনুধাবন করতে পারেন না যে ‘রাজনীতিমুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান’-এর ধারণাও বিরাজনীতিকরণের আরেকটি হাতিয়ার।

প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে বিরাজনীতিকরণের এই প্রক্রিয়া থেকে বের হওয়ার উপায় কি? আর শিক্ষার্থী রাজনীতির সমাধানই বা কি? অনেক সমাধানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু সমাধান এখানে প্রস্তাব করা যায়। প্রথমত, শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবার আগে রাজনৈতিক বোধ তৈরি করতে হবে। রাজনীতি করা মানে অপরের সাথে অন্যায় করা না – এই ব্যাপারটা সবার আগে পরিষ্কার হতে হবে। একজন শিক্ষার্থী যখন কোটা সংস্কারের দাবি নিয়ে রাজপথে নামছেন, সেটিই রাজনীতি। অন্যায্য বেতন বা ভ্যাট বৃদ্ধির দাবিতে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে স্লোগান দিচ্ছে, সেটা তাদের রাজনৈতিক মতামত প্রদান। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে একজন শিক্ষার্থী যখন ন্যায্যতার ভিত্তিতে একটি আসন চাইছে কিংবা হলের ডাইনিং-এ সাশ্রয়ী মূল্যে ভালো মানের খাবার চাইছে – সেটা তাদের রাজনৈতিক অধিকার। শিক্ষার্থীরা যখন নিরাপদ সড়কের জন্য রাস্তায় নেমে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছে ও নিয়ম-নীতি ঠিক করে দিচ্ছে, সেটিই বাস মালিক সমিতির নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে দেওয়া তাদের রাজনৈতিক ইশতেহার।

রাজনীতির এই বোধ তখনই তৈরি হবে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের রাজনৈতিক মতামত প্রদান করতে শিখবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষে, আড্ডায়, সেমিনারে যখন সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ে পড়াশোনা ও আলাপ হবে। যখন শিক্ষার্থীরা নানান সংগঠনে যুক্ত হবে, তখন তারা রাজনীতি বুঝবে। কীভাবে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলন করা যায়, এটি যখন শিখবে তখন শিক্ষার্থীরাও সমাজে প্রচলিত নানান দুর্নীতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা শিখবে। সিন্ডিকেট ভেঙে বাজারে ন্যায্যমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনার অধিকার নিশ্চিত করতে পারবে। এলাকার উন্নয়ন কাজের জন্য বররাদ্দ অর্থের লুটপাট বন্ধ করতে পারবে।

তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি বন্ধের দাবি না জানিয়ে বরং ক্ষমতাসীন দলের শিক্ষার্থী সংগঠনের একচেটিয়া রাজনীতি করার লাইসেন্স ও চর্চাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই রাজনৈতিক দলের সহযোগী শিক্ষার্থী সংগঠন আছে, তবে তারা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কুক্ষিগত করতে পারে না। এভাবে বিভিন্ন মতাদর্শের রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারলে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ কেউ পাবে না৷ শিক্ষার্থীরাও নানান রাজনৈতিক মতাদর্শের সাথে পরিচিত হয়ে নিজেদের বোঝাপড়াকে আরো ঝালাই করতে পারবে। পরিশীলিত উপায়ে কীভাবে শিক্ষার্থীরা রাজনীতি করতে পারে তার অসংখ্য নমুনা দেখতে পাওয়া যায় পৃথিবীর নানান দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে ‘কলেজ ডেমোক্র্যাটস’ ও ‘কলেজ রিপাবলিকানস’-এর মতন সংগঠনগুলো সক্রিয়। সেগুলো থেকে অনুপ্রেরণা নেওয়া যেতে পারে। তবে কেউ পেশীশক্তির প্রয়োগ করতে চাইলে তাকে অবাঞ্চিত করার সাহসও রাখতে হবে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীরা সম্মিলিত উপায়ে তা করে দেখিয়েছেন, তাদের সেই যূথবদ্ধ শক্তি আছে।  

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিরাজনীতিকরণ বন্ধ হোক। একই সাথে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি না জানিয়ে বরং ‘শিক্ষার্থী সংসদ’ চালুর দাবি জানানো হোক। শিক্ষার্থী সংসদই পারবে শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি নিয়ে কাজ করা নেতৃত্বকে যোগ্য স্থানে নির্বাচিত করতে। একই সাথে এই ধরনের সংসদে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের ‘লিটমাস্ট টেস্ট’ হবে। যে সংগঠনের নেতাকর্মীরা শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি নিয়ে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারবে না, শিক্ষার্থী সংসদ নির্বাচনে তাদের কাজের ফলাফল হাতেনাতে পাবে তারা। ফলে রাজনৈতিক সংগঠনের সরাসরি যুক্ত না হওয়া শিক্ষার্থীরাও রাজনৈতিক ব্যাপারে অংশগ্রহণ যেমন করতে পারবে, তেমনি গভীর এক রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নিয়ে বের হবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পরবর্তীতে তাদের রাজনৈতিক চিন্তার প্রতিফলন ঘটবে বিভিন্ন স্থানীয় বা জাতীয় ইস্যুতে। আর এই চর্চা না থাকলে বিরাজনীতিকরণের সুযোগ নিয়ে আবার ছোট ও মাঝারি স্বৈরাচারী শাসক তৈরি হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই। 

লেখকঃ আরাফাত রহমান, পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অফ ডেলাওয়্যার, যুক্তরাষ্ট্র এবং শিক্ষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ

Share.

মুক্তিফোরাম একটি মুক্তিবাদী, বহুত্ববাদী এবং জনপন্থী সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে গড়ে ওঠা সংগঠিত গণমঞ্চ। এর লক্ষ্য হলো নতুন ধরণের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক চর্চা নির্মাণ। নোংরা হিসেবে রাজনীতির যে রূপকল্প এদেশের মানুষের কাছে নির্মাণ করা হয়েছে, সেটিকে চ্যালেঞ্জ করতে চায় মুক্তিফোরাম। আবার যেসব একক আদর্শ (যেমন বামপন্থা-ডানপন্থা) বা পরিচয়ের রাজনীতি (সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, জাতিবাদ) দিয়ে জনগণের সংহতি ও বৈচিত্র্য হুমকির মুখে ফেলা হয়েছে তার একটি এন্টিডোট হয়ে ওঠাও মুক্তিফোরামের প্রকল্প।

Leave A Reply