ভূমিকা
বন্ধুরা,
আজকে সময়ের প্রয়োজনে আমরা একত্রিত হয়েছি।
বাংলাদেশের মানুষ আজ তার ন্যায্য অধিকার চায়।
সেই চাহিদা মেটাবার সর্বজনের সংগ্রামের মঞ্চ গঠন করবার তাগিদে আজকে আমরা একত্রিত হয়েছি।
দীর্ঘ শোষণ ও বঞ্চনার ইতিহাস বুকে নিয়ে বারংবার বিদ্রোহ, বিপ্লব ও আন্দোলনের পরও এই ভূখণ্ডের মানুষ আজও মুক্তির জন্যে সংগ্রাম করে চলেছে। পরপর একটি ঔপনিবেশিক ও একটি নব্য ঔপনিবেশিক শক্তিকে পরাজিত করে ভৌগলিক স্বাধীনতার লড়াইয়ে বিজয়ী হয়ে এদেশের মানুষ প্রকৃত মুক্তির স্বাদ পায়নি। ঔপনিবেশিক কায়দায় আজও তাদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে পদদলিত করে রেখেছে শাসক গোষ্ঠী।
এই কাঠামোগত শোষণের পেছনে যেমনটি রয়েছে গণতন্ত্রকে পরিবারতান্ত্রিকতায় পর্যবসিত করার কৌশল, তেমনি রয়েছে আইনগত ও সংস্কৃতিগতভাবে স্বাধীন চিন্তার টুঁটি চেপে ধরার ফাঁদ।
এমন একটি সময়ে দাঁড়িয়ে, আমরা, এদেশের জনগণ অনুভব করছি যে আমাদের সামগ্রিক মুক্তির জন্য একটি সংগঠিত গণমঞ্চ তৈরি করতে হবে, যেটি কিনা ক্ষমতার দম্ভ ছিন্ন করে একটি গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র স্থাপনের মাধ্যমে মানুষের কাছে তার আকাঙ্ক্ষিত মুক্তিটিকে পৌঁছে দেবে। সেই লক্ষ্য সামনে রেখে আমরা মুক্তিফোরাম নামের একটি পরিবর্তনকামী সংগঠন গড়ে তুলছি।
সংগঠনের গুণগত রূপ
মুক্তিফোরামকে একটি রাজনৈতিক দল বললে ভূল বলা হবে, আবার একটি সাংস্কৃতিক সংঘ হিসেবে কল্পনা করলেও সেটা সঠিক হবেনা। মুক্তিফোরামের অবস্থান হবে একটি সংগঠনের সংগঠন–অর্থাৎ গ্রুপ অব অর্গানাইজেশন্সের মতন। এর মাঝে ভোটের রাজনীতিতে অংশ নেবার মতন নেতৃত্ব যেমন তৈরি করা হবে, এবং প্রয়োজনে সশরীরে ভোটের রাজনীতিতে প্রবেশ করে হবে, তেমনি সমগ্র ভোটের রাজনীতি থেকে দূরে থেকে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, রাষ্ট্রচিন্তা, গান, কবিতা, নাটক, ছবির চর্চাও চলবে।
তবে নিশ্চিতভাবেই মুক্তিফোরামের একটি রাজনৈতিক সংগঠন সত্ত্বা রয়েছে এবং সেই পরিচয়কে এটি আপন করে নেয়। আমরা স্বীকার করি যে নাগরিক হিসেবে আমাদের যেকোন কার্যক্রমই অবিসংবাদিতভাবে রাজনৈতিক এবং সর্বোত মুক্তির সংগ্রাম ব্যতীত সামগ্রিক এই শোষণের থেকে মুক্তি সম্ভব নয়।
সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে, মুক্তিফোরামের লক্ষ্য হলো নতুন ধরণের রাজনৈতিক চর্চা নির্মাণ। নোংরা হিসেবে রাজনীতির যে রূপকল্প এদেশের মানুষের কাছে নির্মাণ করা হয়েছে, সেটিকে চ্যালেঞ্জ করতে চায় মুক্তিফোরাম। আবার একক আদর্শ বা পরিচয়ের রাজনীতি দিয়ে জনগণের সংহতি ও বৈচিত্রকে হুমকির মুখে ফেলা হয়েছে তার একটি এন্টিডোট হয়ে ওঠাও মুক্তিফোরামের রাজনৈতিক প্রকল্প। অতএব মুক্তিফোরামের মুল কাজ হলো যে কোন উপায়ে নতুনধারার রাজনীতি নির্মান যেটি একটি মুক্ত ও বৈচিত্র্যময় সমাজ গঠন করতে পারবে।
অতএব মোটাদাগে মুক্তিফোরামের সাংগঠনিক উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য বিবৃতি দাঁড়াবে এরকম
উদ্দেশ্য বিবৃতি (মিশন স্টেটমেন্ট)
বর্তমান রাষ্ট্রের পরিবারতান্ত্রিক, অনুদার, শোষণ ও সহিংসতানির্ভর রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও চর্চাকে ভেঙ্গে একটি বিকল্প রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও চর্চার নজির স্থাপন করা যেটি কিনা সকল আদর্শ, দল, মত, ধর্ম ও পরিচয়ের মানুষের অংশগ্রহণে একটি মুক্তিবাদী, বহুত্ববাদী ও জনপন্থী সমাজ এবং রাষ্ট্র নির্মানে কাজ করবে।
লক্ষ্য বিবৃতি (ভিশন স্টেটমেন্ট)
ভোটের রাজনীতি এবং তার বাইরের রাজনীতিতে সবল অংশগ্রহণের মাধ্যমে এদেশের মৌলিক রাষ্ট্রনৈতিক কাঠামো এবং সামগ্রিক সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক চর্চাকে পরিবর্তন করে একটি মুক্তিবাদী, বহুত্ববাদী ও জনপন্থী সমাজ এবং রাষ্ট্র গঠন।
আদর্শিক ভিত্তি
আমরা কোন নির্দিষ্ট দল, মত, পক্ষ, গোষ্ঠী ইত্যাদির ধ্বজাধারী হিসেবে এই সংগঠনটিকে গড়ে তুলি নাই। কোন নির্দিষ্ট বাঁধা ধরা চেতনা বা আদর্শকে সামনে রেখেও আমরা আগাতে চাই না। আমরা পরিষ্কার করে বলতে চাই, আমরা — সাংগঠনিকভাবে — প্রচলিত অর্থে বামপন্থী বা ডানপন্থী নই। অনেকে আমাদেরকে সংস্কারপন্থী বা মধ্যপন্থী বলতে পারেন, যদিও সে ধরণের নামকরণের প্রতিও আমরা পূর্ণ আস্থা স্থাপন করি না।
সব চেতনা, আদর্শ ও চিন্তাধারার মানুষের গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত-গ্রহণের প্রক্রিয়ায় আমরা বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও অপরাপর বিবিধ সমস্যার সমাধান খুঁজবো। এই অনুসন্ধানে বামপন্থী বা ডানপন্থী যে কেউ আমাদের সাথে যুক্ত হতে পারেন, যদি তার মধ্যে আদর্শিক গোঁড়ামি না থাকে, যদি তিনি বাংলাদেশের সব মানুষের জন্য একটি গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী হন। আমরা সকল ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হব এবং সামাজিক সুবিচারের জন্যে কাজ করবো। তবে সকল কর্মকান্ডের মূল লক্ষ্য হবে মুক্ত, বহুত্ববাদী ও জনপন্থী সমাজ ও রাষ্ট্রকাঠামো নির্মাণ।
অন্ধ আদর্শবাদের ঊর্ধ্বে উঠে আমরা গণতান্ত্রিক উপায়ে বহুজনের স্বার্থে সময়ের প্রয়োজন এক একটি সমস্যা নিয়ে কাজ করবো। এবং, আমরা দৃঢ়ভাবে এই আশা রাখি যে, বাংলাদেশকে ভালোবাসেন এমন সবাইকে নিয়ে আমরা প্রতিটি সমস্যার সমাধানও বের করে ফেলতে পারবো।
কিছু মূলনীতি ছাড়া কোনো সংগঠন হয় না। আদর্শিক গোঁড়ামিতে বিশ্বাস না করলেও আমরা নিজেদের ন্যূনতম কয়েকটি মূলনীতি স্থির করতে চাই যাতে কোনোভাবেই আমাদের এই গণমঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী কর্তৃত্ববাদী অবস্থানে চলে যেতে না পারে। এই মূলনীতিগুলো হলো —
১) মুক্তিবাদ — আমরা সাম্য, ন্যায়বিচার, ও মানবিক মর্যাদায় বিশ্বাসী। এর অন্তর্গত– ব্যক্তি অধিকার, নাগরিক অধিকার, মানবাধিকার, আইনের দৃষ্টিতে সাম্য, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, আদর্শিক মুক্তিবাদী গণতন্ত্র, ধর্মীয় সম্প্রীতি, লিঙ্গ সমতা, বর্ণ সমতা, বৈশ্বিক সচেতনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, তথ্য অধিকার, গণযোগাযোগমাধ্যম ও প্রকাশনার স্বাধীনতা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা। যে-কোনো পরিস্থিতিতে হেফাজতে নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরোধিতা।
২) বহুত্ববাদ — আমরা রাজনৈতিক চর্চায় বহু জাতি, লিঙ্গ, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, শ্রেণী ও অপরাপর পরিচয়ের মানুষের সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে চাই। রাষ্ট্রতান্ত্রিক ক্ষেত্রে এর রূপ হয় বহুজনবাদী ব্যবস্থা যেখানে সকল মতের, আদর্শের ও চেতনার গোষ্ঠী নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রভাবক হিসেবে কাজ করতে পারে, তবে কোন একটি গোষ্ঠীর হাতে সমগ্র নীতিনির্ধারনী ক্ষমতা চলে না যায়। আইনী বহুত্ববাদ, সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ, অর্থনৈতিক বহুত্ববাদ, সামাজিক বহুত্ববাদ এবং রাজনৈতিক বহুত্ববাদকে সাংগঠনিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্থাপন করাই হবে আমাদের লক্ষ্য।
এর ঠিক বিপরীত অবস্থানে আছে পরিচয়বাদ। পরিচয়বাদী রাজনীতিতে কোনো একটি পরিচয়কে প্রধান করে তুলে বাকি সব পরিচয়কে অপর করে তোলা হয়। ডানপন্থীদের মধ্যে জার্মানির নাৎসি পার্টি আর বামপন্থীদের মধ্যে কম্বোডিয়ার খেমার রুজরা বিভিন্ন ধরণের এই পরিচয়বাদী রাজনীতি করেছে, যার শেষ পরিণতি ছিলো গণহত্যা। আমাদের দেশে কোন নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে প্রান্তিকতায় ঠেলে দিয়ে তার অস্তিত্বকে বিপন্ন করার এই ধরণের যে-কোনো পরিচয়বাদী রাজনীতিকে আমরা সর্বক্ষেত্রে সর্বশক্তিতে প্রতিহত করবো।
৩) জনপন্থা– সংগঠনের সকল কর্মকান্ড হবে সাধারণ জনগণের স্বার্থে এবং কোন নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা শ্রেণীর স্বার্থে সংগঠন কাজ করবে না। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক সকল ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান হবে বাংলাদেশপন্থী। অর্থাৎ আমরা অন্য কোন বৈশ্বিক বা আঞ্চলিক পরাশক্তির বশবর্তী না হয়ে দেশের স্বার্থ রক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেব। যুদ্ধ প্রশ্নে আমরা সর্বোচ্চ সংযম নীতির পক্ষপাতী। অর্থাৎ যে-কোনো সংকট সমাধানে আমরা সামরিক সমাধানের চেয়ে কূটনৈতিক সমাধানকে প্রাধান্য দেব। একমাত্র দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার মতো চূড়ান্ত সংকটে সামরিক অবস্থানকে সমর্থন দেয়া হবে। যেকোন রাষ্ট্রনৈতিক বা অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ মানুষের সর্বোচ্চ পরিমাণ স্বার্থরক্ষাকে নিশ্চিত করা হবে।
এই তিনটি মূলনীতিকে সামনে রেখে নিয়ে আমরা গণতান্ত্রিক উপায়ে আমাদের সাংগঠনিক সকল সিদ্ধান্ত নিবো এবং বিবেচনা করে নেবো যে সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত আমাদের মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক কি না। যদিবা আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মত আমাদের মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক হয়, তবে তা জনপ্রিয় হলেও বাতিল করা হবে। এই প্রক্রিয়ার জন্য একটি গঠনতান্ত্রিক রিভিউ বোর্ড তৈরি করা হবে এবং তাদের দায়িত্ব হবে সংগঠনের সিদ্ধান্তসমূহকে গঠনতন্ত্রের আলোকে পুনর্বিবেচনা করা। রিভিউ বোর্ডের রায়কে সাধারণ নতুন বিতর্ক ও সংশোধনের পরে সদস্যরা দুই তৃতীয়াংশ ভোটে ওভাররাইড করতে পারবেন অথবা নতুন উপায়ে সংশোধিত নীতি প্রণয়ন করতে পারবেন।
সাংগঠনিক কাঠামো
একটি মুক্তিবাদী, বহুত্ববাদী ও জনপন্থী সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাবো। এবং এই কাজের থাকবে নানান মাত্রা ও ধারা। যেহেতু আমাদের সমাজের বর্তমান পচনটি ঘটেছে সর্বোতভাবে–অর্থাৎ কিনা শোষণ আমাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও তাত্ত্বিক ধারায় প্রবেশ করেছে–সেহেতু আমাদের প্রতিরোধের প্রকল্পটিকেও হতে হবে সর্বোত। সেই প্রকল্পে আমাদের সংগঠনের কয়েকটি ধারা বা উইং আমরা প্রতিষ্ঠান করবো। এই উইংগুলোর মাঝে এখনও পর্যন্ত পরিকল্পনায় রয়েছে একটি ক্রীড়া উইং, এক্টিভিজম উইং, সামাজিক উইং, সাংস্কৃতিক উইং, রাষ্ট্রনৈতিক উইং, এবং গণমাধ্যম উইং। এছাড়াও নানান স্বাধীন সংগঠনের সাথে আমরা সভ্যদের সম্মতিক্রমে বন্ধুত্ব এবং কৌশলগত সংযোগ বজায় রাখবো।
প্রতিটি উইং পরিচালিত হবে তাদের নিজস্ব সাংগঠনিক কাঠামো দ্বারা ও মূলনীতি অনুসারে তাদের কর্মপদ্ধতি আর কার্যক্রম স্বাধীনভাবে নির্ধারণ করবে। উইংসমূহ আবার আবার মূল সংগঠনের সাথে মিলিত হবে তার কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারনী কমিটি বা স্টিয়ারিং কমিটিতে। প্রতিটি উইং-এর কর্মকর্তারা স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য হবেন। স্টিয়ারিং কমিটিতে কেন্দ্রীয় সংগঠনের কাজে সাহায্য করবার জন্যে কিছু কর্মী থাকবেন যারা কেন্দ্রকে তার কর্মকান্ড পরিচালনায় সাহায্য করবে।
স্টিয়ারিং কমিটির সদস্যদের ভোটে তিন সদস্যের একটি প্রেসিডিয়াম কমিটি বা সভাপতিমন্ডলী নির্বাচিত হবে। এই কমিটির দায়িত্ব হবে সংগঠনে গণতান্ত্রিকভাবে গৃহীত সিদ্ধান্ত মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক কিনা তার বিবেচনা করা। প্রেসিডিয়াম কমিটি কোন নির্দেশনা বা আদেশ জারি করবেনা। কেবলমাত্র একটি জুরি হিসেবে কাজ করবে। দলীয় কৌশল নির্মানের একটি গোষ্ঠী হিসেবে তারা কাজ করতে পারে, তবে তাদের প্রস্তাবিত কৌশল সংগঠনের মধ্যবর্তী অন্য যেকোন গোষ্ঠী বা ব্যক্তি কর্তৃক প্রস্তাবিত কৌশল হতে কিছুমাত্র প্রাধান্য পাবেনা এবং দলীয় গণতান্ত্রিক নির্বাচনে অংশ নেবে।
কোন অবস্থাতেই সংগঠনের কোন একক প্রধান বা সভাপতি নির্বাচিত করা হবেনা। দলের প্রতীকি সভাপতি হবেন দলের সকল সদস্যের সামষ্টিক একটি সত্ত্বা। স্টিয়ারিং কমিটি প্রয়োজন সাপেক্ষে অস্থায়ী মুখপাত্র নিয়োগ দিতে পারেন। যদি স্থায়ী মুখপাত্রের প্রয়োজন পড়ে তবে মুখপাত্র নির্বাচন নিয়মিতভাবে পরিবর্তন করে বাই রোটেশন আকারে নির্ধারণ করতে হবে। মুখপাত্র যদি নীতিনির্ধারনী সভার দুই তৃতীয়াংশের অনাস্থার মুখোমুখি হন তবে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হবেন।
সেক্ষেত্রে স্টিয়ারিং কমিটি তিনজন মুখপাত্রের নাম প্রস্তাব করবেন এবং গণতান্ত্রিক ভাবে সত্তর শতাংশের বেশি ভোটে নতুন মুখপাত্র নির্বাচিত করা হবে। যদি কখনও মুখপাত্র দলীয় আলোচনা ব্যতিত দলীয় মতকে প্রকাশ করেন অথবা নিজের ব্যখ্যাকে বা মতকে দলীয় মত হিসেবে প্রকাশ করেন অথবা এমন কোন আচরণ করেন যাতে দলীয় ভাবমূর্তি হুমকির সম্মুখীন হয়, তবে স্টিয়ারিং কমিটির এখতিয়ারে তার অবস্থানটি তাৎক্ষনিকভাবে শূণ্য ঘোষণা করা হবে এবং নতুন মুখপাত্র নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নীতিনির্ধারনী কমিটির সদস্যরা প্রয়োজন অনুযায়ী একটি প্রেসিডিয়াম কমিটি, বা সমগ্র সমন্বয়ক কমিটি নির্বাচিত করতে পারবেন, যাদের স্টিয়ারিং কমিটিতে সর্বোত সমন্বয় ছাড়া অন্য দায়িত্ব থাকবে না, এবং সেই কমিটির সদস্যরা মুখপাত্র হতে পারবেন না।
স্টিয়ারিং কমিটিতে উইংসমূহের সমন্বয়ক ও সহ সমন্বয়ক ব্যতীত আরও থাকবেন সাংগঠনিক সম্পাদক, কোষাধ্যক্ষ, প্রচার সম্পাদক, দপ্তর সম্পাদক এবং উদ্যোগ সমন্বয়ক। প্রয়োজনে অপরাপর পদ সৃষ্টি করবার এখতিয়ার থাকবে স্টিয়ারিং কমিটির হাতে। সাংগঠনিক সম্পাদকের কাজ হবে জনসংযোগ ও আয়োজনের কেন্দ্রীয় দায়িত্ব পালন করা। কোষাধ্যক্ষ ও সহ কোষাধ্যক্ষ সংগঠনের আয়ব্যয়ের হিসেব রাখবেন, অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবেন এবং আর্থিক উন্নয়নের পরিকল্পনায় তথা সংগঠনের বাৎসরিক বাজেট ও পরিকল্পনা প্রণয়নে উদ্যোগ সমন্বয়কের সাথে কাজ করবেন। প্রচার সম্পাদক সংগঠনের অনলাইন উপস্থিতি, বিজ্ঞাপন, নতুন সদস্য সংগ্রহ, জনপ্রিয়করণ ইত্যাদি কাজ করবেন। উদ্যোগ সমন্বয়ক অনুদান সংগ্রহ, চাঁদা সংগ্রহ, ব্যবসায় প্রকল্প ইত্যাদির মাধ্যমে সংগঠনের আর্থিক সদ্গতি নিশ্চিত করবেন। দপ্তর সম্পাদক সকল সভার আলোচনার দস্তাবেজ সংরক্ষন করবেন এবং সংগঠনের সকল প্রকার ডকুমেন্টেশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।
অতএব স্টিয়ারিং কমিটিতে নিম্নোক্ত সদস্যগণ থাকবেন–
অনধিক তিনজন প্রেসিডিয়াম সদস্য, মুখপাত্র, সাংগঠনিক সম্পাদক, কোষাধ্যক্ষ, প্রচার সম্পাদক, দপ্তর সম্পাদক, উদ্যোগ সমন্বয়ক, ক্রীড়া উইং সমন্বয়ক, এক্টিভিজম উইং সমন্বয়ক, সামাজিক উইং সমন্বয়ক, সাংস্কৃতিক উইং সমন্বয়ক, রাষ্ট্রনৈতিক উইং সমন্বয়ক এবং গণমাধ্যম উইং সমন্বয়ক।
সংগঠনের ব্যপ্তি অনুযায়ী এমন কাঠামো অনুসরণ করে প্রতিটি বিভাগে, জেলায়, থানায়, ইউনিয়নে এইরূপ সংগঠন গড়ে তোলা হবে যারা স্বাধীনভাবে কাজ করবে, কিন্তু কেন্দ্রীয় স্টিয়ারিং কমিটির দ্বারা সম্ন্বিত হবে এবং বিচারিক ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় রিভিউ বোর্ডের কাছে ন্যস্ত হবে।
কর্মকর্তা নির্বাচন ও নীতিনির্ধারনী পদ্ধতি
প্রেসিডিয়াম কমিটি ও স্টিয়ারিং বডির নির্বাচন হবে প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক উপায়ে। সর্বপ্রথমে সকল উৎসাহী প্রার্থীগণের মধ্য থেকে সকল সভ্যগন ব্যলট পেপারে যেকোন তিনজন সদস্যের নাম লিখবেন এবং ক্রমান্বয়ে সর্বোচ্চ ভোট প্রাপ্ত তিন সদস্য প্রেসিডিয়াম কমিটিতে স্থান পাবেন। স্থিতির লক্ষ্যে প্রেসিডিয়াম কমিটিকে এক বছরের মেয়াদ দেয়া হবে, যদিও এর মধ্যে যেকোন সময়ে যেকোন সদস্য কর্তৃক আনিত অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষে সত্তর শতাংশ ভোটে কমিটির যেকোন সদস্য বা সমগ্র কমিটি অভিশংসিত হতে পারে।
একইভাবে র্যাংকিং পদ্ধতিতে উইং কর্মকর্তাসহ স্টিয়ারিং বডির সকল কর্মকর্তারা নির্বাচিত হবেন। তবে প্রার্থীর সংখ্যা অতিরিক্ত হয়ে দাঁড়ালে প্রেসিডিয়াম কমিটি কেবল যোগ্যতম ব্যক্তিদেরকে নিয়ে একটি ক্যান্ডিডেট পুল গঠন করবেন এবং সেখান থেকেই গণতান্ত্রিক র্যাংকিং পদ্ধতির নির্বাচনে কর্মকর্তারা নির্বাচিত হবেন। সভ্যগণ চাইলে মনোনিত প্রার্থীদের বাইরে কারো নাম ব্যালটে যোগ করতে পারবেন (রাইট-ইন)। সেই প্রার্থী বেশি ভোট পেলে তাকেই নিয়োগ দেয়া হবে।
স্টিয়ারিং বডির কর্মকর্তাগণ সত্তর শতাংশ অনাস্থা ভোটে অভিশংসিত হতে পারবেন। অভিশংসনের ক্ষেত্রে প্রেসিডিয়াম কমিটি পদগুলোর জন্য নতুন প্রার্থী প্রস্তাব করবেন এবং গণতান্ত্রিক উপায়ে নতুন কর্মকর্তা নির্বাচিত হবেন। প্রেসিডিয়াম কমিটি নিজে সত্তর শতাংশ অনাস্থা ভোটে অভিশংসিত হলে পূনরায় উন্মুক্ত র্যাংকিং পদ্ধতিতে প্রেসিডিয়াম কমিটি গঠন করা হবে।
যেকোন ধরণের নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে স্টিয়ারিং কমিটির প্রত্যেক সদস্য পরিবর্তনশীল ক্রমান্বয়ে বক্তব্য রাখার সুযোগ পাবেন। কোন সদস্য চাইলে তার বক্তব্যের সময় ইল্ড বা ছেড়ে দিতে পারবেন। সকল স্টিয়ারিং কমিটি মেম্বারের বক্তব্য শেষে সভায় উপস্থিত যে কোন সাধারণ সদস্য তাদের বক্তব্য রাখতে পারবেন। বক্তব্যের শেষে হ্যাঁ-না ভোট অথবা গ্রেডিং পদ্ধতিতে ভোটপ্রদানের মাধ্যমে চূড়ান্ত নীতি নির্ধারণ করা হবে। নীতি নির্ধারিত হবার পরে সেই নীতিতে চূড়ান্ত স্বাক্ষরের জন্য সংগঠনের সভাপতি-তথা সকল সাধারণ সদস্যের কাছে পাঠানো হবে এবং একটি উন্মুক্ত সাংগঠনিক গণভোটের জন্য চব্বিশ ঘন্টা সময় বেধে দেয়া হবে। এর মাঝে যদি সত্তর শতাংশ বিপক্ষে ভোট আসে তবে নীতিটি বাতিল করা হবে এবং পুনর্বিবেচনার জন্য সভায় ফিরে যাবে। তা না এলে প্রস্তাবটি গৃহীত হবে। তার পরে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে যে কোন সদস্য প্রস্তাবটির বিরুদ্ধে রিভিউ কমিটির কাছে আপিল করতে পারবেন। তৎপরবর্তী প্রক্রিয়া উপরিউক্ত অংশে বিবরণ করা হয়েছে।
সতর্কতা
আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পথ থেকে যাতে আমরা কোনভাবেই বিচ্যুত না হই, সেজন্যে আমরা কিছু সতর্কতা অবলম্বন করবো। বন্ধু সংগঠন রাষ্ট্রচিন্তার সহায়তায় নিচে দেয়া এই সতর্কতা সনদটি গঠন করা হলো। কোন নীতির বা চর্চার গঠন্তান্ত্রিক বৈধতা বিচারে প্রেসিডিয়াম কমিটি এই সতর্কতাটির ব্যত্যয় ঘটেছে কিনা, তা বিবেচনা করবে। সতর্কতা সনদটি নিম্নরুপ –
ধর্ম-বর্ণ-জাতি-শ্রেণী-অঞ্চল বা বিশ্বাস-অবিশ্বাস ইত্যাদির ভিত্তিতে সমাজে যেসব বিরোধ বা দ্বন্দ্ব ক্রিয়াশীল আছে সেইসব দ্বন্দ্বকে শাসকগোষ্ঠী তাদের সংকীর্ণ রাজনীতির স্বার্থে যেভাবে ব্যবহার করে, জিইয়ে রাখে বা উস্কে দেয়, আমরা তার ফাঁদে পড়বো না। যা-কিছু মানুষের বৃহত্তর স্বার্থের বিপরীতে বিভক্তি সৃষ্টি ক’রে তার মূল সমস্যা থেকে দৃষ্টি অন্য দিকে সরিয়ে দেয়, সেসব বিভক্তির ষড়যন্ত্রে আমরা কোনো পক্ষ হবো না। আমরা এইসব বিভক্তির মূল কারণ উদ্ঘাটন করবো এবং এসবের অংশ না হয়ে বৃহত্তর ঐক্য সৃষ্টির লক্ষ্যে সকল মানুষ ও প্রকৃতির স্বাভাবিক বিকাশ ও ন্যায্য অধিকারের পক্ষে সোচ্চার থাকবো।
আমরা রাষ্ট্রনৈতিক পরিবর্তনের জন্য শুধুমাত্র ঐক্যবদ্ধ মানুষের জাগরণের শক্তি ও ন্যায্যতার পক্ষে বলবো।
আমরা কোনো বিশেষ শ্রেণী, পেশা, গোষ্ঠী বা খাতের রাজনীতির কথা বলবো না। আমরা দেশের সকল শ্রেণী-পেশা-গোষ্ঠী-খাতসমূহের সুস্থ, স্বাভাবিক ও ন্যায্য বিকাশের পক্ষে বলবো। আমাদের রাজনীতি হবে বিভাজনের বিরুদ্ধে, ঐক্যের পক্ষে।
কোনো ইস্যু বা সম্প্রদায় বা কোনো জাতি-গোষ্ঠীর কথা বলতে গিয়ে, কিংবা কোনো শ্রেণী-পেশা বা সেক্টরের কথা কথা বলতে গিয়ে আমরা কখনো রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিবর্তনের রাজনীতি থেকে বা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক সংকট-মুক্তির রাজনীতি থেকে নিজেদের বিযুক্ত করবো না। আমরা বিদ্যমান সকল ধরনের রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন এবং বৈষম্যবিরোধী অবস্থান ও আন্দোলনকে একটি মানবিক-গণক্ষমতাতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের বৃহত্তর আন্দোলনের সাথে যুক্ত করবো। এই লক্ষ্যে আমরা সাধ্য অনুযায়ী তৎপর থাকবো।
আমরা কোনো গোষ্ঠীর বা দলের বা কোনো ব্যক্তির বক্তব্যের সারবস্তুকে বিবেচনা না করে তার বা তাদের উচ্চারিত বা লিখিত কোনো শব্দ বা বাক্যকে প্রধান বিবেচনা করে বিতর্ক করবো না, এভাবে দূরত্ব বাড়িয়ে তুলবো না, বিভাজনকে উস্কে দেবো না। আমরা সবসময় বক্তার মূল বক্তব্যকে বোঝার চেষ্টা করবো। না বুঝতে পারলে তার বা তাদের প্রতি সম্মান রেখে ব্যাখ্যা জানতে চাইবো, যদি সেই ব্যাখ্যা আমাদের চিন্তার বিরুদ্ধে যায়, তার বা তাদের প্রতি সম্মান রেখে আমাদের চিন্তাটুকু তাকে বা তাদেরকে জানাবো।
আমরা সবার কথা শুনবো এবং সবাইকে বলার সুযোগ দেবো, আগে অপরের কথা শুনবো, পরে নিজের কথা বলবো। ব্যক্তির আচরণগত, প্রবণতাগত বা বিশ্বাসগত ছোট ছোট বিষয়কে কখনোই তার সমগ্র রাজনৈতিক অঙ্গীকারের বিপরীতে দাঁড় করাবো না। ব্যক্তির সংকট, সীমাবদ্ধতা ও ভুলভ্রান্তির সমালোচনা করবো, তবে কর্কশভাবে নয়, যথাসম্ভব মানবিকতা ও সহমর্মিতার সাথে।
গণতান্ত্রিকতার চর্চায় সংখ্যাগরিষ্ঠের মত বা ঐক্যমত্য কিংবা ঔচিত্য, যৌক্তিকতা বা যোগ্যতা এগুলোর কোনোটাকে কখনোই একমাত্র মানদণ্ড করে তুলবো না। সংখ্যালঘিষ্ঠের মতকে কখনোই উপেক্ষা করবো না। সিদ্ধান্ত গ্রহণে বোঝাপড়ার নীতি গ্রহণ করা হবে, সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংখ্যালঘিষ্ঠ সব মত নিয়ে, আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেবো।
রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা
রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখার ক্ষেত্রে আমরা বন্ধু সংগঠন রাষ্ট্রচিন্তার সাথে মোটাদাগে একমত বলে তাদের রাষ্ট্র সংস্কার প্রস্তাবনাকে একটি খসড়া প্রস্তাবনা হিসেবে আমরাও তুলে ধরছি। কাউন্সিল ও আলোচনা সাপেক্ষে এর পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জন ও সংযোজন করা হবে।
উপসংহার
আশা করছি এই প্রস্তাবনা ও খসড়া গঠনতন্ত্রের মাধ্যমে আমরা একটি মুক্ত ও বিচিত্র সমাজ গঠনের প্রকল্পের জন্য যোগ্য একটি সংগঠন গড়ে তোলার পথে প্রথম ধাপটি রাখবো। পূর্ণাঙ্গ রূপ পাওয়া পর্যন্ত সাপ্তাহিক বৈঠকে এই গঠনতন্ত্রের সংশোধন, পরিমার্জন, পরিবর্ধন চলতে থাকবে এর পূর্ণাঙ্গ অনুমোদন বা র্যাটিফিকেশনের আগে পর্যন্ত। র্যাটিফিকেশনের পরে মূলনীতি ব্যতিত যে কোন অংশকে সত্তর শতাংশ ভোটে পরিবর্তিত করা যাবে। তবে একই সাথে মুক্তিফোরামের কাজ চলতে থাকবে। সংগ্রামে, সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে, রচনায় আর গবেষণায় মুক্তিফোরাম কাজ করে যাবে তার স্বপ্নের সমাজের লক্ষ্যে।
আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ আমরা একদিন গড়ে তুলবোই।
সূর্যের দিন আসবেই।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ এটি একটি খসড়া দস্তাবেজ। মুক্তিফোরামের র্যাটিকিফিকেশন কাউন্সিলের আগ পর্যন্ত এটিকে কোন দলিল হিসেবে ধরে নেয়া যাবে না। মুক্তিফোরামের বর্তমান সদস্য ও শুভাকাংখীরা এতে পরিবর্তন আনতে পারবেন। পরিবর্তনের পরামর্শ দিতে পারেন । সকল পরিবর্তন পরবর্তী সভায় আলোচনা করা হবে এবং খসড়া দস্তাবেজে স্থান দেয়া হবে।
2 Comments
I think this is very well thought out. My only addition would be to have a Economic Development wing. The current model of Economic model is hijacking future generation of all the resources required for the future generation to sustain. In line with vision of Muktiforum Economic thinking also need to be more broadbased, inclusive and ethical.
Pingback: আমরা কি? আমরা কেন? | MUKTIFORUM