শতকের ঘর পেরোলেও হৃদয়ের দৃঢ়তা যে কাউকেই হার মানাবে এখনও। কিউবার ফিদেল ক্যাস্ত্রো থেকে ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাত তারাও হয়ত অবাক চোখে অবলোকন করেন আপনাকে। এই ছোট্ট ব-দ্বীপের রূপ সবাই ভালোবাসলেও এর বঞ্চনাকে উপেক্ষা করে সবাই। শুধু আপনিই ছিলেন ব্যক্তিক্রম। আর তাই দুনিয়াকে আপনি দেখেছেন জালিম আর মজলুমের মঞ্চ হিসেবে। হয়েছেন মজলুমের নেতা। পুরো পৃথিবী জুড়েই বহু ক্ষণজন্মা মানব জন্ম নিয়েছেন। কর্মগুণে মানব থেকে হয়েছেন মহামানব।

আপনাকে মিস করি বঙ্গবন্ধু। যে ব্যক্তিপূজার বিরোধী আপনি ছিলেন। সেই আপনাকে এখন ‘নমস্য’ বলে বিক্রী করে এক গোষ্ঠী। জানেন তো ? মোড়ে মোড়ে বসেছে কাউন্টডাউন ক্লক। একটি ‘এ’ ক্যাটাগরির (সবচেয়ে বড় ঘড়ি) ক্লকের স্থাপন ও ১০০ দিন পর্যন্ত ব্যবস্থাপনায় ব্যয় হবে ৪৯ লাখ ৩০ হাজার ৬০৯ টাকা। আর আর প্রতিটি ‘বি’ ক্যাটাগরির ক্লকের ব্যয় ধরা হয়েছে ২৭ লাখ ৮২ হাজার ৮২৩ টাকা। সারাদেশে এমন ৮৩টি ক্ষণগণনা যন্ত্র বসানো হয়েছে। এছাড়াও সরকারিভাবে পালিত হচ্ছে নানা কর্মসূচি। মুজিববর্ষের থিম সং ও লোগো নির্বাচন। জাতীয় কর্মসূচির পাশাপাশি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দফতর এজন্য পৃথক পৃথক কর্মসূচি পালন করবে।

আওয়ামী লীগ ছাড়াও অন্যান্য অনেক দলও জাঁকজমকপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালনের কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। হাজার কোটির যজ্ঞ তৈরী হয়েছে আপনার জন্মশত বার্ষিকী কেন্দ্র করে। বছরব্যাপী প্রকল্প, হাজারও কর্মসূচী। ভাববার উপায়ই নেই যে আপনি আমাদের মাঝে আর নেই।

তোমার ভাষ্যমতে এ টাকা মুটে আর মজদুরের। যে খেটে খাওয়া মানুষের ঘামের গন্ধ তোমার উত্তরসূরীরা পায় না। অথচ এই আপনিই ৪৭তম জন্মবার্ষিকীর দিনে কারাগারে বসে (১৯৬৭ সালের ১৭ মার্চ) ডায়েরিতে লিখেছিলেন, ‘আমি একজন মানুষ, আমার আবার জন্মদিবস!’ দেশ স্বাধীন হলো। পিতা, আপনার প্রত্যাবর্তনও হলো।

১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি রাজভবনে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় ইন্দিরা গান্ধীকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার জন্মদিন ১৭ মার্চ। আপনি সেদিন বাংলাদেশ সফরে আসবেন এবং আপনার সফরের আগেই আমি চাই—আপনার সেনাবাহিনী বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নেবেন।’ সেই মতে ১৭ মার্চ ইন্দিরা গান্ধী বাংলার মাটি স্পর্শ করার আগেই ১২ মার্চ বিদায়ী কুচকাওয়াজের মধ্যদিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশ ত্যাগ করেছিল। কি অসীম সার্বভৌমত্ব জ্ঞান ছিলো আপনার। কি চমৎকার কুশলতায় আগ্রাসন বিরোধী অবস্থান নিয়েছেন বরাবরের মতো।

আজ আপনার জন্মশতবার্ষিকীর বছরেও আমার স্বাধীন দেশের সীমান্তে মরে মানুষ। বছর বছর সে মৃত্যুর হার বাড়েই, কমে না। আমার স্বাধীনদেশের পররাষ্ট্রনীতি বন্ধুরাষ্ট্রকে কতটা ছাড় দেয় জানি না। কিন্তু জানি আপনি থাকলে এমনটা হতো না হয়ত। হয়ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের রাজু ভাষ্কর্যের সামনে অবস্থানরত নাসির আব্দুল্লাহর পাশে গিয়ে আপনিও বসে পড়তেন। পিতা, আপনার উত্তরসূরীরা কি দেখতে পান। অসুরের মতো জেঁকে ধরা ভারতের আগ্রাসনের খড়্গ? রামপালের মতো ক্ষতিকর প্রকল্প, তিস্তা চুক্তি নিয়ে অবহেলা অথবা গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তিভঙ্গ। বৈষম্যপূর্ণ ট্রানজিট আর ভারসাম্যহীন বাণিজ্য কি চোখে পড়ে পিতা? উলটো ফেণী নদীর পানি নিয়ে যে চুক্তির বিরোধীতা করায় প্রাণ দিতে হয় সহপাঠীর হাতে। যে বাক স্বাধীনতার জন্যে আপনাকে জেল খাটতে হয়েছে জীবনের সিংহভাগ সময়। তাই আপনিই হয়ত বুয়েটে ছাত্রলীগের হত্যা উৎসবে নিহত আবরার ফাহাদের পরিবারের পাশে গিয়ে দাঁড়াতেন। হয়ত তর্জনী উঁচিয়ে বলতেন, ‘আর যদি একটা ছেলেও মরে……’

আজব এক রোগ এসেছে পিতা। নাম তার ‘করোনা’। খুব দ্রুত ছড়ায়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সবাই নিজ উদ্যোগে ঘরে থাকতে বললেও আমাদের ক্ষমতাসীন দল জায়গায় জায়গায় সমাবেশ করছে। রোগ ছড়ানোর প্রধান নিয়ামরে একটি এমন জনসমাগম। অথচ এই যে হাজার কোটির উৎসব প্রকল্প। এই দূর্যোগের সময় এই অর্থে আমরা অনেক অনেক কোয়ারেন্টাইন গড়ে তুলতে পারতাম পিতা। কি করেই বা হবে ! আমার দেশে সবচেয়ে কম বরাদ্দের খাত হলো স্বাস্থ্যখাত। এইতো আমাদের ২০১৯-২০ অর্থবছরেই স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ মোট জাতীয় বাজেটের ৪ দশমিক ৯২% এবং জিডিপির ০ দশমিক ৮৯%। আমরা নেপাল, মালদ্বীপ থেকেও পিছিয়ে রয়েছি। স্বাস্থ্যখাতে গবেষণায় তো আগ্রহ আরও কম।

স্বাস্থ্য শিক্ষা-গবেষণা খাতে সরকারের ব্যয় স্বাস্থ্য বাজেটের মাত্র ৩ শতাংশ। পিতা জানেন তো, আমাদের ব্যাংকগুলো ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। কোন টাকা নেই। ব্যবসা বান্ধব পরিবেশ তৈরীতে সৎ উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে ঋণ নেই। ব্যাংকের কর্ণধার আর উচু কর্মকর্তারাই এখন ভাইভাই। সবাই সবার ঝোলা থেকে টাকা নিয়ে পাড়ি জমাচ্ছেন বিদেশ বিভূঁই। অথচ এরইমাঝে খবর শুনি নানান ব্যাংক আপনার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে কোটি কোটি টাকা ডোনেট করছে। শেয়ার বাজার মুহূর্মুহু ধ্বস সামলে আর কোমরই সোজা করতে পারছে না।

অথচ এসবের কারিগররাই ঠিকই গিয়ে আসন গেড়ে নেন পবিত্র সংসদে। পিতা, উত্তরসূরীরাই তোমায় আজ বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। ধর্মান্ধের মতো ‘ট্যাগ’-এর রাজনীতিতে মিশে গিয়ে বিসর্জন দিয়েছে তোমার ‘ত্যাগ’-এর রাজনীতি। পুরো দেশকে জিডিপির রসগোল্লায় ভাসিয়ে ভুলে গেছে মাটি আর নুনের কথা বলা।

আসিফ আদনান মুক্তিফোরামের ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক

Share.

আসিফ আদনান মুক্তিফোরামের একজন সংগঠক

Leave A Reply