বাংলাদেশের রাজনীতি এদেশের সাধারণ মানুষের অপছন্দের তালিকায় শীর্ষে থাকা একটি বিষয়ের নাম। এদেশের রাজনীতি অনেকটাই “কমেডি অফ এরোরস” এর মতো। রাজনীতির ক্যানভাসটা মনে হয় কোনো “যেমন কিছু তেমন করো” টাইপের কর্মকান্ড করার আখড়া। সেখানে  আমাদের নেতামন্ত্রীরা সঙ সেজে বিজ্ঞের ভঙ ধরে যেমন খুশি তেমন করে ছবি এঁকে সাধারণ মানুষের কাছে প্রদর্শনী করেন। এসব প্রদর্শনী কোনো হাস্যকৌতুক কিংবা রম্যগল্প থেকে কোনো অংশে কম যায় না।

আজকে আমাদের রাজনীতির সবচাইতে অযৌক্তিক একটা বিষয় নিয়ে কথা বলি, যা হলো “ছাত্র রাজনীতি।”

বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর আদর্শের দেশ, একুশের অহংকারের দেশ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দেশ। কিন্তু আমাদের দেশের রাজনীতির আনাচে-কানাচে, বিশেষ করে ছাত্র রাজনীতির কোথাও কোনো কোণাতেও, এর বিন্দুমাত্র কিছু আছে কিনা সেটা এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। “ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে ভবিষ্যতে দেশ সঞ্চালনার নেতা ও সুপুরুষ তৈরি হয়” – জানিনা কথাটা কে বলেছিলেন, কিন্তু এখন তো দেখছি এসব ডাহা মিথ্যে কথা এবং প্রত্যেকটা আদর্শ কেন্দ্রিক বক্তব্য একেকটা “আষাঢ়ে গল্প।”

ঊনিশ শতকের হাত ধরে বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির অনুসূচনা হয়। ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যূত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে দেশের বৈপ্লবিক পরিবর্তনে ছাত্রদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু এখনকার ছাত্র রাজনীতি বলতে বোঝায় ছুরি-চাপাতি নিয়ে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ, সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি, গেস্টরুম-কমন রুমের নোংরামি, ক্যাম্পাস বনাম ক্যাম্পাস দ্বন্দ্ব, মন্ত্রীদের ছায়াতলে বেড়ে ওঠা ছাত্র রাজনীতির “বড় ভাইদের” হাতে নিরুপায় শিক্ষার্থীদের শোষণ, রাজনীতির নোংরা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে অনেক মেধাবী হলপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের হয়রানি-প্রাণহানি, যৌন নিপীড়ন, ইত্যাদি। আরো বহু কিছু এখন ছাত্র রাজনীতির রন্ধ্রে-রন্ধ্রে এমনভাবে মিশে গেছে যেভাবে খঁড়ের গাদায় সুঁই মিশে যায়। খুঁজে বের করে নির্মূল সম্ভব হয় না, আর প্রতিবাদ করতে নামলে প্রতিবাদকারীকে আর খুঁজেই পাওয়া যায় না।

এদেশের প্রতিটা মধ্যবিত্ত ছেলেই জীবনের বারোটা বছরে মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক টপকে, একটা ভালো ফলাফল নিয়ে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। এরপর পড়াশোনা শেষ করে চাকরিতে জড়িয়ে পড়ে একটা সুন্দর ভবিষ্যত গড়ার স্বপ্ন দেখে থাকে। এদের বেশিরভাগই ঢাকার বাইরে থেকে এসে নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে শেষমেশ ছাত্র রাজনীতির মতো বিষাক্ত সাপের ছোবলে পড়ে। অযথা আন্দোলন, সভা-সংসদ, নির্বাচন, তোষামোদি, চাটুকারিতা, আর পদের লোভে যতোটা সম্ভব নিচে নামতে পারার প্রতিযোগীতায় দেশের ছাত্রদের মেধা অকালে নষ্টের দিকে হাঁটতে থাকে।

এদেশে ছাত্রদের নৈতিক মূল্যবোধ অবক্ষয়ের জন্যে মাদকের চাইতে এই রাজনীতির প্রভাবই বেশি। এদেশের জোটদলীয় নেতা ও মন্ত্রীরা নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের জন্যে ছাত্রদের পতিতার মতো ব্যবহার করে। পতিতাবৃত্তিতেও এখন বোধহয় একটা লাগাম কিংবা নিয়ম থাকে, কিন্তু ছাত্র রাজনীতি তো পুরোটাই ছন্নছাড়া। 

বিশ্বজিৎ দাস থেকে আবরার ফাহাদ, নাম না জানা অজ্ঞাত আরো বহু প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই ছাত্র রাজনীতির নোংরা ছোবলে। ক্যাম্পাসে রামদা নিয়ে মহড়া দেয়া তো এখন একটা শিল্প! হলপড়ুয়া মেয়েদের নিরুপায় করে বড়ভাইদের বিছানা অব্দি নিয়ে যাওয়া তো এখন ছাত্র রাজনীতির ঐতিহ্য। ছিঃ! লজ্জায় ডুবে মারা উচিত যারা রাজনীতির আদর্শের কথা বলে।

ছাত্রদের কাজ পড়াশোনা করা। পড়াশোনা করে নিজেকে একটা যোগ্য পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে নিজের কাজগুলো সঠিকভাবে করা। দেশের মঙ্গল ওখানেই নিহিত। একজন ছাত্র তখনই দেশের কাজে আসতে পারে যদি সে নিজের বিবেক ও তার আশেপাশের মানুষের কাছে উপযুক্ত বলে বিবেচিত হয়। নয়তো ক্যাম্পাস মহড়া, দাঙ্গা-মিছিল করে, দলীয় নেতাকে প্রিয় অভিভাবক বানিয়ে, ছবি তুলে ফেসবুকে ঝড় তুলে কেউ নেতা হয় না। দেশের রাজনীতির এখনকার যে অবস্থা, নেতার চাটুকারিতা করে দেশের মেধা নষ্ট হয় আর নেতার ছেলে বিদেশ থেকে পড়াশোনা করে এসে নেতার গদিতে বসে পরবর্তী নেতা হয়।

দেশের ছাত্রদের ভবিষ্যত যদি ছাত্র রাজনীতির শেকল থেকে মুক্ত হয়, তবেই তাদের মঙ্গল হবে আশা করি।

লেখক পরিচিতি: তাসিন আহমেদ স্বরণ

Share.

I am an Example Writer. Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipisicing elit, sed do eiusmod tempor incididunt labored et dolore magna aliqua. Ut enim ad minim veniam, quis nostrud exercitation ullamco laboris nisi ut aliquip ex ea commodo consequat.

Leave A Reply