জানি, উইকিপিডিয়ার তথ্য সব সময় সত্য হয় না, কিন্তু এটাতে বাংলাদেশের সেক্যুলারিজমের প্রেক্ষাপটে একটা লাইন দেখে এখন হাসব, না কাঁদব, তা বুঝে উঠতে পারছিনা!
‘‘Bangladesh was the first and only Muslim-majority country in South Asia to enshrine (সুউচ্চে বা সিংহাসনে স্থাপন করা) secularism in its constitution’’. যার অর্থ অনেকটা এমন যে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম এবং একমাত্র মুসলিম প্রধান দেশ ছিল যা সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধানের উচ্চ আসনে স্থাপন করেছে।
মোর বোধ হয় না এই ভেবে, এখনও কিভাবে একটা দেশের সরকার (১৯৮৮ সাল থেকে বর্তমানকাল অব্দি) এবং অধিকাংশ মুসলিম লোক মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে বা করতে চায় যে বাংলাদেশ মুসলিম প্রধান দেশ; আবার তলে তলে তারাই বলে কিনা ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক দেশ, আমাদের বাংলাদেশ! এরা পুরোই দু’মুখো কেউটে!
অবিসংবাদী ভাবে, যে জায়গা বা এলাকায় একটি সুনির্দিষ্ট বিষয় বা বস্তুকে সর্বোচ্চ বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়, সেইখানে কি করে অন্য বাকি সব বিষয় অথবা বস্তুকেও কে মান্য করা যায় বা এর গ্রহণযোগ্যতা সবাই স্বীকার করে নিবে?! তাই, ঐ এলাকায় ওই সুনির্দিষ্ট ও সর্বশ্রেষ্ঠ বলে স্বীকৃত বিষয়বস্তুকে আরও সুউচ্চে পৌঁছানোর লক্ষ্যে আরও কাজ করে যাওয়া হয়; প্রয়োজন হলে ঐটা বাদে বাকি সব বিষয়কে দুমড়ে- মুচড়ে দিতেও কোন কুণ্ঠিত বোধ হয় না! এটা একটি পাতি সহজ কথা। এটা না বুঝার কিছুই নেই।
আর এর একদম সঠিক ও সুযোগ্য উদাহরণ হলো বর্তমান বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতা, অসম্প্রদায়িকতা; যেখানে একটি ধর্ম, ইসলামকে প্রধান করে রাখা হয়েছে এবং এটাকে মানা হচ্ছে! তো, এই ধর্মকে যেকোন ভাবে রক্ষার্থে অনৈতিকভাবে মুমিনগণ অ-মুসলিমদের ওপর জোরছে চিল্লাইয়া ঝাপিয়ে পড়েছে আর এখনও পড়ছে!
এবং এর জের ধরেই দেখা যায় যে অধিকাংশ বাংলাদেশি মুমিন, মোডারেট মুসলিম সকল ধর্মনিরপেক্ষতা আর অসম্প্রদায়িকতার এই সহজ ব্যাপারটাকে বুঝতেই নারাজ! এর কারণটা হলো, বাংলাদেশের ‘রাষ্ট্রধর্ম’ থেকে শুধুমাত্র তাদের নিজেদের দেয়া স্বীকৃতিস্বরূপ ‘‘মহান ধর্ম (!), ইসলাম’’ যদি খারিজ হয়ে যায়, আর তখন বাংলাদেশি অ- মুসলিমদের ওপর তারা তাফালিং চালাতে পারবে না, সেই সন্দেহে !
অথচ, এইসব গুণধর মুমিন ওরফে আল্লার ওলিরাই আবার জোর গলায় দাবি তোলে যে পার্শ্ববর্তী ইন্ডিয়া বা আরও ধর্মনিরপেক্ষ দেশ, যেখানে হিন্দু সম্প্রদায় বা অ-মুসলিমের সংখ্যা বেশি, মুসলিমরা সংখ্যায় কম সেখানেও তারা শরীয়াহ মোতাবেক মানে ইসলামপ্রধান দেশ তৈরি করতে অধিক সম্মতি জানায়, চেষ্টা চালাচ্ছে! আর তাই এই মোডারেট- মুমিন মুসুল্লিরাই হলো প্রকৃতপক্ষে ভণ্ড! আবার, অন্য ধর্মের লোকেরদের কষ্ট, অশান্তি দিয়ে তারা বলে কিনা ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম’! বলি, ভণ্ডামির তো একটা সীমা রয়েছে; এখন এরা দেখি সীমা ছাড়িয়ে বহুদূর চলে গিয়েছে!
এই যে প্রত্যেকটা বছর বাংলাদেশে সংখ্যালঘু বলে অভিহিত করা, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদেরকে শারীরিক- মানসিক ভাবে অত্যাচার করা হচ্ছে, অথচ এসবের তেমন কোনই বিচার হচ্ছে না! আবার কিছুক্ষেত্রে দিনশেষে যখন অপরাধীকে (তবে সাংঘাতিক মুমিন মুসলমান!) আটক করাও হয়, কিন্তু তখন সেই অপরাধী নাকি মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত ছিলেন— এই কথাটা বলে সংখ্যাগুরুরা (!) তাদের লালিত- পালিত অপরাধী মুমিনদের বারংবার পার পায়িয়ে দিচ্ছে!
দেশের সংবিধান (একটা দেশের পবিত্র বিধিমালা) অনুসারে ধর্মনিরপেক্ষ, অসম্প্রদায়িক বলে ঘোষিত বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া সহ অন্যান্য সকল দেশগুলোর প্রেক্ষাপটে ‘‘সংখ্যালঘু’’ শব্দটা পুরোটাই অহেতুক, অবান্তর, সাংঘর্ষিক! এই শব্দটা ঐসব দেশে এখনও চর্চা করা হচ্ছে বলেই ‘সংখ্যালঘু’ খ্যাত মানুষগুলোর কপালে দুঃখের ভার দিন দিন তুমুল জোরে বেড়েই চলেছে! ধর্মনিরপেক্ষ ও অসম্প্রদায়িক যেকোন দেশে ‘সংখ্যাগুরু/ লঘু’ বলে কিছু নেই, বা এর মত অবাঞ্ছনীয় কোন কিছু থাকতেও পারে না; সব মানুষ সমান।
তা এখন বলি, বাংলাদেশ কি শুধু মুসলিম মুমিনদের, নাকি অন্য ধর্মের মানুষদেরও?! প্রশ্নটা কিরকম দিন দিন একমুখী হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু (ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীয় হওয়া সত্ত্বেও) এর সুনির্দিষ্ট কোন উত্তর মুমিনেরা দিতে একদমই চায় না!
তাছাড়া, বাংলাদেশি মুসলিমরা কথায় কথায় যখন বিশেষ করে হিন্দুদের ইন্ডিয়ায় চলে যেতে বলে এই বলে যে ইন্ডিয়া নাকি হিন্দুদের আদি নিবাস! তা সেইসব ইসলামপন্থীরা কি একবারও ভাবে না যে তাদের আদি পুরুষেরা সেই মধ্যপ্রাচ্য, ইরাক প্রভৃতি এলাকা থেকে এই উপমহাদেশে এসে কিভাবে রক্তক্ষয়ী হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে এই এলাকার বিভিন্ন স্থানে বসতি স্থাপন করেছিল?!অতীত ইতিহাস কিন্তু এর চরম পর্যায়ের সাক্ষী। তাহলে যুক্তি অনুযায়ী, এসব মুসলিমদের তো সবার আগে উপমহাদেশ বা বাংলাদেশ ছেড়ে তাদের আদি স্থানে চলে যাওয়া এখনই উচিত!
কিন্তু কথা ছিল, একজন সুস্থ, স্বাভাবিক ও মানবতাবোধ সম্পন্ন মানুষ এই ধরনের কোন কথা তুলে অন্য ধর্মের অনুসারীদের মনে কষ্ট দিবে না। অথচ বাস্তবে কি হচ্ছে? বাস্তবে হচ্ছে, মুমিন মুসলিমরা প্রতিনিয়তই হিন্দুদেরকে ওসব বলে বেড়াচ্ছে, এই দেশ ছাড়ার জন্য জোর করছে!
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে কিন্তু সব ধর্মের লোকজন সহ অনেক বিদেশিরা নিজেদের জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিয়েছিলেন। কোথায়, ঐসময় তো একবারের জন্যেও খুঁজে দেখা হয় নি যে/ যারা অ-মুসলিম, তারা ঐ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারবে না, বা তখনকার ‘পূর্ব পাকিস্থানকে’ আজকের ‘বাংলাদেশ’-এ রূপান্তরিত করতে পারবে না।
তাহলে স্বাধীনতার এতো বছর পর এসে কেন বাংলাদেশের লোকেরদেরকে ধর্মীয় বিচারে ভাগ করার বিভিন্ন অমানুষিক, জ্বালাও- পোড়াও কার্যক্রম চালানো হচ্ছে?! কেন, বাংলাদেশের অমুসলিমদেরকে প্রত্যক্ষ, পরোক্ষভাবে জোর-জবরদস্তি করা হচ্ছে নিজ জন্মভূমি ছেড়ে অন্য কোনো নিরাপদ দেশে চিরতরে চলে যাওয়ার জন্য?!
‘বাংলাদেশ’, এমন পরিস্থিতিতে তোমার জন্য বড়ই মায়া হয়, কষ্ট হয়!
লেখকঃ কনাদ সরকার