অনেকেই আমাদের বর্তমান সরকারকে হিটলারের শাসনের সাথে তুলনা করে। কিন্তু আওয়ামীলীগের স্বৈরশ্বাসন কি আসলেই হিটলারের সমতুল্য? অল্পের মধ্যে বলতে গেলে, না। আমি যে নির্দ্বিধায় এই প্রতিবেদনটি লিখতে পারছি আর আপনি যে নির্বিঘ্নে তা পড়তে পারছেন এটাই তার প্রমাণ। কিন্তু তার মানে কি আমাদের সরকারের কি হিটলারের শাসনের পর্যায়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই? অবশ্যই আছে।

আসলে আমার মতে বাস্তবতাটা হচ্ছে এই যে, কোনো স্বৈরশ্বাসকই একদিনে অথবা একবছরে চরম পর্যায়ে প্রজাপীড়ক হয়ে যায় না। স্বৈরশ্বাসনের ৫টি স্তর আছে এবং হিটলার ও আমাদের বর্তমান সরকার স্বৈরশ্বাসনের ভিন্ন স্তরে মাত্র। এই ৫টি স্তরের ঠিক ৪ নম্বর স্তরে আমরা আছি, আওয়ামীলীগের জন্য এই স্তরটার মানেই হচ্ছে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের উপর চড়াও হওয়া। 

স্তর ১: দিনবদলের শপথ

যে কোনো স্বৈরশ্বাসক ক্ষমতায় আসার আগে আপনাকে দিনবদলের স্বপ্ন দেখাবে, আপনার দেশের বিভিন্ন জটিল সমস্যার সৃজনশীল সমাধান না দিয়ে সকল সমস্যার জন্য কিছু নির্দিষ্ট গোষ্ঠী, কিছু নির্দিষ্ট ব্যক্তি, অথবা কিছু নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলকে দোষারোপ করবে এবং আপনাকে তারা দিবে যে সুদূর ভবিষ্যতে আপনার দেশ বিশ্বের অন্যতম উন্নত ও প্রভাবশালী দেশের কাতারে গিয়ে পৌঁছাবে।

আওয়ামীলীগের ২০০৮ এর নির্বাচনী প্রচারণাটাও অনেকটা এরকমই ছিল। তাদের নির্বাচনী ইশতেহারের বাণীই ছিল “দিন বদলের সনদ”। আমাদের দেশের যত সমস্যা, সেই সকল সমস্যার জন্য তারা দোষারোপ করলো বিএনপি-জামাত জোটকে যদিও এই সমস্যাগুলোর কোনোটাই ২০০১ এ নতুন উৎপত্তি হয়নি। এই সমস্যা গুলোর উৎপত্তি সেই ১৯৭১ সালেই। বিএনপি-জামাত জোট ছিল বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিভিন্ন মৌলিক সমস্যার লক্ষন, কারণ না। তাদের ইশতেহারের মূল লক্ষ ছিল “ভিশন ২০২১”, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি ব্যাপক উন্নয়নশীল, ডিজিটাল রাষ্ট্রে পরিণত করা।

উন্নয়নের স্বপ্ন দেখিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলো হিটলারও। দোষারোপ করার জন্য সে বেছে নিয়েছিল ইহুদিধর্মালম্বীদের।

স্তর ২: পোষা সামরিক বাহিনী নির্মান

যে কোনো স্বৈরশ্বাসকের মূল হুমকির কারণ হচ্ছে একটি নিরপেক্ষ সামরিক অবকাঠামো। ক্ষমতায় এসেই স্বৈরশ্বাসকের প্রথম লক্ষ্য থাকে সামরিক অবকাঠামো ভেঙে দিয়ে তার জায়গায় ওই স্বৈরশ্বাসক পন্থী  সামরিক অবকাঠামো দাঁড় করানো। ২০০৮ এর নির্বাচনের কয়েক মাসের মধ্যেই হয়ে বিডিআর বিদ্রোহ। ভেঙে দেওয়া হয় দেশের সামরিক অবকাঠামো।

এই বিদ্রোহের পিছে ঠিক কার হাত ছিল তা আমার জানা নেই, কিন্তু এই বিদ্রোহের পর আমাদের সরকারের জন্য সামরিক অবকাঠামোটা নিজেদের মতন করে সাজিয়ে নেওয়া খুব সহজ হয়ে যায়।  উদয় হয় শীর্ষ সন্ত্রাসী তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফের ভাই জেনারেল আজিজ আহমেদের। ক্ষমতায় আসার এক বছরের মাথায় হিটলার তার কাছের লোকদের নিয়ে তৈরী করে “এস এস ” যা মোটামোটি সব দিক থেকেই জার্মান আর্মির সমতুল্য ছিল।

স্তর ৩: অর্থনৈতিক উন্নয়নের রূপকথা নির্মাণ 

দারিদ্রের হার, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ও বেকারত্বের হার, এই তিনটি পরিসংখ্যান যে কোনো স্বৈরশ্বাসকের কাছে খুব পছন্দনীয়। এর দুটি কারণ আছেঃ প্রথম কারণ এই যে, যে কোনো সরকারের কাছে এই দুটি পরিসংখ্যানকে নিজের ইচ্ছা মতন করে পরিবেশন করা খুব সহজ। আমাদের সরকার কিন্তু তাই করছে। কথায় কথায় তারা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কথা বলছে।

হিটলারও তাই করতো। অনেক অর্থনীতিবিদরাই এখন মনে করে যে হিটলারের নাৎসি সরকার যেই প্রবৃদ্ধির হারের কথা জনগণকে বলতো, তার অনেকটাই বানোয়াট ছিল। স্বৈরশাসকরা চাই যে তাদের শ্বাসন অন্তত স্বৈরাচারির পূর্ণাঙ্গরূপ ধারণ করার আগ পর্যন্ত জনগণের সমর্থন ধরে রাখতে। এটা করার খুব সহজ উপায় হচ্ছে ব্যাপক পরিমানে ঋণ নিয়ে, রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ব্যাপক পরিমানে ঘারতি করে, অবকাঠামোর উন্নয়ন করা।

এই উন্নয়ন খুবই দৃশ্যমান, এই উন্নয়ন দিয়ে খুব সহজেই জনগণের মন জয় করা যায়। আমাদের বর্তমান সরকার যে তা করছে তা তো সবাই দেখতেই পাচ্ছি কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, হিটলার, এমনকি ভেনিজুয়েলার হুগো চাভেজও কিন্তু এই একই কাজ করেছিল।

স্তর ৪: পালা গুন্ডার মিলিশিয়া নির্মান

যে কোনো স্বৈরশ্বাসকের শ্বাসনামলের প্রথম দিকে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য দরকার হয়ে কিছু পালা গুন্ডা। নিজেদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মেরে পিটিয়ে দমন করার কাজে আসে তারা। আবার প্রতিপক্ষকে সম্পূর্ণভাবে দমন করা হয়ে গেলে এই গুন্ডা বাহিনীই হয়ে ওঠে বোঝার কারণ। সেই সময় আইন প্রণয়নকারী বাহিনী দিয়ে এদের দমন করাটাও খুব কঠিন কিছু না।

হিটলারের এই গুন্ডা বাহিনীর নাম ছিলি “এস এ”। তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের পূর্ণাঙ্গ ভাবে দমন করার সাথে সাথেই এই এস এ বাহিনীর উপর চড়াও হয় হিটলার। গ্রেফতার করা হয় এস এ বাহিনীর সব শীর্ষ নেতাদের। হত্যা করা হয় আরো অনেক নেতাদের। ছাত্রলীগ আর যুবলীগের সাথে আওয়ামীলীগও ঠিক এই কাজটাই করছে এখন।

স্তর ৫: বিরুদ্ধমত দমন 

এই স্তর হচ্ছে স্বৈরশ্বাসনের শেষ ও সব চেয়ে চরম স্তর। এই স্তরে পৌঁছানোর সাথে সাথে স্বৈরশ্বাসক হয়ে ওঠে চরম পরিমানে অসহিষ্ণু। গ্রেফতার করে সাংবাদিকদের। সামান্য ফেসবুক স্ট্যাটাসের কারণে হতে পারে যাবৎ জীবন কারাদন্ড এমনকি মৃত্যুদন্ডও।

হতে পারে এই মুহূর্তে এটা অতিরঞ্জিত ও অবাস্তব মনে হচ্ছে, কিন্তু এক বছর আগে বলেছিলাম যে খুব শীঘ্রই যুবলীগ ও ছাত্রলীগের উপর চড়াও হবে আওয়ামীলীগ, তখন সেটাও অতিরঞ্জিত ও অবাস্তব মনে হয়েছিল অনেকেরই। সেই পর্যায়ে আমরা এখনো পৌছাইনি। কিন্তু চার নম্বর স্তরের থেকে পাঁচ নম্বর স্তরের দূরত্ব খুব বেশি দিনেরও না।

(চলবে) 

শামস রহমান মুক্তিফোরামের একজন নিয়মিত কলামিস্ট

Share.

মুক্তিফোরাম একটি মুক্তিবাদী, বহুত্ববাদী এবং জনপন্থী সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে গড়ে ওঠা সংগঠিত গণমঞ্চ। এর লক্ষ্য হলো নতুন ধরণের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক চর্চা নির্মাণ। নোংরা হিসেবে রাজনীতির যে রূপকল্প এদেশের মানুষের কাছে নির্মাণ করা হয়েছে, সেটিকে চ্যালেঞ্জ করতে চায় মুক্তিফোরাম। আবার যেসব একক আদর্শ (যেমন বামপন্থা-ডানপন্থা) বা পরিচয়ের রাজনীতি (সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, জাতিবাদ) দিয়ে জনগণের সংহতি ও বৈচিত্র্য হুমকির মুখে ফেলা হয়েছে তার একটি এন্টিডোট হয়ে ওঠাও মুক্তিফোরামের প্রকল্প।

1 Comment

  1. যতদূর আমার মনে হয়, পরবর্তী “নাটক” নির্বাচনে জয়ী হবার পরপরই ৫ম স্তরে পৌঁছে যাবে বাংলাদেশ। দেরী নেই খুব একটা…

Leave A Reply