বালিশ-ব্যাংক-বিশ্ববিদ্যালয়ের শোভন ও অশোভন “দুর্নীতি” গুলো কিন্তু ব্যক্তিগত প্রবলেম না। এগুলো হচ্ছে বিদ্যমান রাষ্ট্র-পরিচালনা-প্রণালীর সিস্টেমগত বৈশিষ্ট্য। সিস্টেমের অংশ।সবাই মিলে ভাগবাটোয়ারা করে রাষ্ট্রকে দোহন করে খাওয়ার একটা গণতান্ত্রিক সিস্টেম চালু হয়েছে। এগুলোকে “দুর্নীতি” বললে সংজ্ঞাটা সংকীর্ণ হয়ে যায়। এগুলো স্রেফ “দুর্নীতি”র দৃষ্টান্ত নয়, এসবই এখন রাজনীতি। বর্তমান রাষ্ট্রযন্ত্রের রাজনৈতিক অর্থনীতি। গ্র্যান্ড পলিটিক্যাল ইকোনমি। মুক্তিযুদ্ধের আগের এবং পরের সিস্টেমও প্রাথমিক অর্থে এটাই ছিল।

বর্তমান সরকার বলতে গেলে নতুন যেটা করেছেন সেটা হল, এই সিস্টেমটাকে সম্পূর্ণ সর্বজনীন করে তুলেছেন। বিপুল মাত্রায় বিকেন্দ্রায়িত করে তুলেছেন। পুরোপুরি ‘গণতান্ত্রিক’ করে তুলেছেন পার্টির ভেতরে। নতুন এই সিস্টেমেটিক প্রক্রিয়ায় প্রত্যেকের ভাগ সুনির্দিষ্টভাবে, সুশৃংখলভাবে বন্টন করা আছে।এগুলোর পার্টিগত পদ-পদবিভিত্তিক ‘নিয়ম’ তৈরি করা হয়েছে। ছাত্রলীগের শোভন, রাব্বানী এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারজানা ম্যাডামের নানান কথায় সেরকমই বোঝা যাচ্ছে। গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রের আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় ম্যানেজারদের (মানে সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের) এবং রাজনৈতিক দলের ম্যানেজারদের সমস্ত নেতৃস্থানীয় পদের জন্য এই সিস্টেম সুনির্দিষ্ট ‘নিয়ম’ মেনে পরিচালিত হয় বলে ধারণা করা ছাড়া আর উপায় দেখা যাচ্ছে না।

এই সর্বজনীন, বিকেন্দ্রীভ‚ত হরিলুটের রাজনৈতিক অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে আসার কোনো রাস্তা এই সরকার নিজের জন্য খোলা রাখে নি।এই গোটা রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক লুটপাটের সিস্টেমের প্রধান হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কেমন করে নিজের দায় এড়াবেন সেটা আমি বুঝতে পারি না। তাঁর হুকুমে দল চলে, রাষ্ট্র চলে, আমলাতন্ত্র চলে, পুলিশ-প্রশাসন চলে। তিনি বিদ্যমান সিস্টেমের মধ্যে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। ব্যক্তিগতভাবে তিনি নিজে টাকাপয়সার দুর্নীতির সাথে জড়িত কিনা সেটা মোটেই বড় প্রশ্ন না।

গোটা ব্যাপারটাকে স্রেফ টাকা-পয়সার দুর্নীতি হিসেবে দেখলে ছোট করে দেখা হয়, টুকরা টুকরা করে দেখা হয়, সমগ্র সত্যটা দেখা হয় না। এটা আসলে রাষ্ট্রীয় লুটপাটের সর্বজনীন রাজনৈতিক সিস্টেম।তাঁর একচ্ছত্র নেতৃত্ব এবং সর্বময় ক্ষমতা থাকা অবস্থাতেই এই সিস্টেমটা এরকম সর্বজনীন হয়ে উঠেছে। তিনিও কি এগুলোকে খুচরা “দুর্নীতি” বলে ভাবেন? এটাকে একটা সামগ্রিক লুটপাটের রাজনৈতিক সিস্টেম হিসেবে না দেখার কোনো সুযোগই নাই– এটা কি তিনি জানেন না? বুঝতে পারেন না? সারাদেশে এই পুরো পরিস্থিতিটার খবর কি তিনি রাখেন না? সমস্ত কিছুই কি তাঁর কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা হয়? সেটা কি সম্ভব? কেমন করে সম্ভব!তাঁর নিজের কি কোন ‘নিজস্ব’ মেকানিজম নাই?

সর্বময়, একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি এই গোটা সিস্টেমটাকে অনুমোদন না করেন, তাহলে এই সিস্টেমটা চলে কীভাবে? হু হু করে বিকশিত হয় কীভাবে? এরকম সর্বজনীন হয়ে ওঠে কীভাবে? দেশ কি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চালান না? পরিস্থিতি কি তাঁর নিয়ন্ত্রণে নেই? কে চালান তাহলে দেশ? কারা চালান? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভ‚মিকাটা তাহলে কী?আমার আওয়ামী লীগের সৎ ও বিশ্বাসপ্রবণ বন্ধুদেরকে কথাগুলো ভেবে দেখতে বলি। তাঁরা যদি হাজারে হাজারে মুখ না খোলেন তাহলে তাঁদের দলের ভয়াবহ পতন কেউ আটকাতে পারবে না। নিজেদের দলের মধ্যে শুভ পরিবর্তন আনার জন্য দলের সবচাইতে সৎ, বিশ্বস্ত ও বলিষ্ঠ লোকদেরকেই মুখ খুলতে হয়। আওয়ামী লীগের বর্তমান সরকারের সমর্থক সমস্ত বুদ্ধিজীবীদেরকে অনুগ্রহ করে মুখ খুলতে বলি।

যদি আপনারা আপনাদের প্রিয় প্রধানমন্ত্রীকে ভালোবাসেন, বিশ্বাস করেন এবং সৎ মনে করেন, তাহলে তাঁকে সাহায্য করুন। মুখ খুলুন। তাঁকে বলুন, তাঁকে জানতে দিন যে, তাঁরই সর্বময় ক্ষমতার অধীনে বাংলাদেশে এমন এক সর্বজনীন সিস্টেম চালু হয়েছে যা শুধু আওয়ামী লীগের সর্বনাশ করবে না, গোটা বাংলাদেশের সর্বনাশ করে ফেলবে।যাঁরা দল এবং রাষ্ট্রের ভয়াবহ ও পাইকারি মুশকিলগুলো নিয়ে সুস্পষ্টভাবে কথা বলেন না, বরং ইনিয়ে-বিনিয়ে খুচরা ঘটনার ওপর গুরুত্ব দিয়ে সিস্টেমকে আড়াল করতে চান, তাঁরা দলের মঙ্গল চান না। তাঁরা আসলে বেইমান এবং সুবিধাবাদী।

এই বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর ভেতরে আছেন বিরাট বিরাট যাবতীয় লেখক, অধ্যাপক, সাংবাদিক, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বেসামরিক আমলা এবং রাজনীতিবিদগণ। এঁদের নির্বিচার ও নির্বিকার উৎসাহ, প্ররোচনা এবং অনুমোদনই আজকের আওয়ামী লীগকে একচেটিয়া স্বৈরতন্ত্রী উন্নীত করেছে।লেপ-তোষক-বালিশ-কাঁথা-কম্বল এবং ব্যাংক-বীমা-বিশ্ববিদ্যালয়ের বেপরোয়া ও বেপর্দা লুটপাটের বিদ্যমান সিস্টেমকে যেন আমরা অনুগ্রহ করে রাষ্ট্রীয় হরিলুটের রাজনৈতিক সিস্টেম হিসেবে দেখি, এবং অনুগ্রহ করে যেন আমরা এটাকে বদলানোর কথা জোরেশোরে বলি। নইলে আমরা বাঁচব না, বাংলাদেশ বাঁচবে না, কেউ বাঁচবে না।

সেলিম রেজা নিউটন, সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

Share.

I am an Example Writer. Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipisicing elit, sed do eiusmod tempor incididunt labored et dolore magna aliqua. Ut enim ad minim veniam, quis nostrud exercitation ullamco laboris nisi ut aliquip ex ea commodo consequat.

Leave A Reply