১১ নভেম্বর মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যার দায়ে একটি ঐতিহাসিক মামলা দায়ের করেছে গাম্বিয়া। এর বেশ কিছুদিন পার হবার পর যখন বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বব্যাপী গাম্বিয়ার প্রশংসা ছড়িয়ে পড়েছে, তখন বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলেছেন যে বাংলাদেশ কৌশল হিসেবে ইসলামী দেশগুলোর জোটে সিদ্ধান্ত নিয়ে গাম্বিয়ার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আদালতের আশ্রয় নিয়েছে।

প্রসঙ্গত গাম্বিয়ার বদলে বাংলাদেশ নিজে মামলা করতে পারবেনা কেননা ১৯৯৮ সালে গণহত্যা বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তির অংশ হবার সময়ে এর ৯নং অনুচ্ছেদে আপত্তি জানিয়েছিলো তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। কেন আপত্তি জানিয়েছিলো, সেই ব্যখ্যা খুঁজে পাওয়া যায়না। বিষয়টি যথেষ্ট রহস্যময়। আর এই মামলাটি বাংলাদেশ করতে পারেনি বলে গাম্বিয়াকে আইসিজেতে বিপাকের মুখেও পড়তে হচ্ছে। মিয়ানমার দাবি করছে যে এই বিষয়ে গাম্বিয়ার সংক্ষুব্ধ হবার কোন কারণ নেই, যদি গাম্বিয়া মানবতাবাদী কারণে ক্ষুব্ধ হবার কথা বলছে।

তবে, এটা ঠিক না যে বাংলাদেশ একেবারে কিছু না করে বসে আছে। গাম্বিয়াকে যথাসাধ্য সহায়তা করার চেষ্টা করছে সরকার। একটা প্রতিনিধি দল গাম্বিয়াকে সহায়তা করছে তথ্য ও উপাত্ত দিয়ে।

বিশেষজ্ঞ ও সরকারের প্রতিনিধি ছাড়াও সেখানে রয়েছেন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতিনিধিরা। কাজেই মিয়ানমার কোন মিথ্যাচার করতে চাইলে সেটি ধরিয়ে দেয়া সহজ হবে কেননা বাংলাদেশের কাছে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মাঝে প্রত্যাবাসনের সমঝোতাসহ নানান বিষয়ে তথ্য রয়েছে এবং শরণার্থীগণ নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে নির্যাতনের বিবরণও ভাগ করে নিতে পারবেন।

বাংলাদেশ সরকারের মতন গাম্বিয়ার পাশে দাড়িয়েছে কানাডা ও নেদারল্যান্ডসের সরকার। ন্যায়ের পাল্লা ক্রমাগত ভারী হচ্ছে। আশা করা যায় আদালত রাখাইনে গণহত্যার স্বীকৃতি দেবে এবং আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমার শরণার্থীদের একটি টেকসই প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করতে বাধ্য হবে।

গাম্বিয়াকে সর্বোতভাবে সহায়তা করবার জন্য সরকারকে অকুন্ঠ সাধুবাদ। তবে কিছু প্রশ্ন আমরা আমাদের সরকারের কাছে ছুড়ে দিতেই পারি।

কেনো ১৯৯৮ সালে কনভেনশনের ৯নং অনুচ্ছেদে আপত্তি জানানো হলো, যেখানে রোহিঙ্গা নির্যাতন চলছে তারও বহু দশক আগের থেকে এবং তখনই আন্দাজ করা যেতে পারতো যে এই চুক্তি আমাদের ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে?

কেন কৌশলগতভাবে গাম্বিয়ার মাধ্যমে মামলা করার ব্যাপারটি শুরু থেকেই জানানো হলোনা? কেন শুরুর থেকেই বাংলাদেশ সহায়ক হিসেবে প্রতিনিধি দল পাঠালো না? পূর্বপ্রস্তুতি যদি থেকেই থাকবে, তবে কেন কালক্ষেপন করা হলো? শুরুর থেকে সমর্থন কি মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার স্বরকে শক্তিশালী করতো না?

কোন কারণে কি আমরা মিয়ানমারকে না চটিয়ে কার্য সমাধা করতে চাইছি? কেন আমাদের গণহত্যাকারী একটি রাষ্ট্রকে ভজিয়ে চলতে হবে? গণহত্যার এই বৈশ্বিক নিন্দার সময়ে কেন আমাদের সেনাবাহীনির প্রধান মিয়ানমার সফরে যাবেন?

আমরা দেখতে পাই যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সরকার দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে এবং এই বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ নির্মাণেও তারা বেশ কিছু কাজ করেছে। কিন্তু কিছু কৌশলগত পদক্ষেপের ক্ষেত্রে দৃঢ়তর হলে এই প্রকল্পটি আরো ভালোভাবে বাস্তবায়িত করা যেতো বলে আমাদের বিশ্বাস।

অনুপম দেবাশীষ রায় মুক্তিফোরামের একজন সম্পাদক

Share.

মুক্তিফোরাম একটি মুক্তিবাদী, বহুত্ববাদী এবং জনপন্থী সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে গড়ে ওঠা সংগঠিত গণমঞ্চ। এর লক্ষ্য হলো নতুন ধরণের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক চর্চা নির্মাণ। নোংরা হিসেবে রাজনীতির যে রূপকল্প এদেশের মানুষের কাছে নির্মাণ করা হয়েছে, সেটিকে চ্যালেঞ্জ করতে চায় মুক্তিফোরাম। আবার যেসব একক আদর্শ (যেমন বামপন্থা-ডানপন্থা) বা পরিচয়ের রাজনীতি (সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, জাতিবাদ) দিয়ে জনগণের সংহতি ও বৈচিত্র্য হুমকির মুখে ফেলা হয়েছে তার একটি এন্টিডোট হয়ে ওঠাও মুক্তিফোরামের প্রকল্প।

Leave A Reply