বাংলাদেশের বই বাজের এই দফায় মোটিভেশনাল বা আত্মোন্নয়ন ধরণের বইয়ের এক ধরণের কাটতি দেখা যাচ্ছে। অনেকেই এই বিষয় নিয়ে নিন্দা করছেন, অনেকে করছেন প্রশংসা। প্রশংসাকারীদের একটি ব্যাখ্যা হলো এই যে এর মাধ্যমে বাজারে নতুন লেখক আসছে। যদিও সব লেখকের লেখা মানসম্মত নয়, তবে মুক্তবাজারে, বা পারফেক্ট কম্পিটিশনে খারাপ লেখকেরা শেষ অবধি টিকবেন না। ভালো লেখকদের সাথে প্রতিযোগিতায় তারা ছিটকে যাবেন। রেস্টুরেন্ট মার্কেটের যে নবজন্ম হয়েছিলো কিছুবছর আগে, যখন শত শত ভালোমানের রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠলো অলিতে গলিতে–আর খারাপ রেস্টুরেন্ট ছিটকে গেলো, তেমনি খারাপ বইও ভালো বইয়ের সামনে টিকবে না–এমন একটি ব্যাখ্যা শোনা যায়।

এই ব্যাখ্যাটিতে মূলধারা অর্থনীতির বাজারের উদাহরণ দিয়ে বলা হচ্ছে যে বাজারে কেবল ভালো পণ্যই টিকে থাকে। তবে এই ব্যাখ্যাদানকারীদের প্রতি সম্মান রেখেই আমি এর সাথে দ্বিমত পোষণ করি–এবং দ্বিমতটি করি মূলধারা অর্থনীতির ভাষাতেই।

আমাদের যে বইবাজার, সেটি কোনভাবেই উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার বাজার বা পারফেক্ট কম্পিটিশনের বাজার নয়, বরং এটি একটি বিকৃত বাজার, যে বাজারে বিক্রেতা আর ক্রেতার কাছে সমান তথ্য থাকেনা–মূলধারা অর্থনিতির ভাষাতেই যাকে বলে ইনফমেশন এসিমেট্রি। এই বাজার বিকৃত হবার বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে, কিন্তু তাতে আসার আগে আমরা দেখি কেনো রেস্টুরেন্টের বাজারের থেকে বইয়ের বাজার আলাদা।

প্রথমত বলে রাখি যে রেস্টুরেন্টের বাজারও আসলে খোলামেলা কিছু না। সেখানে প্রবেশ করতেও একটা আর্থক পুঁজি লাগে, একটা সামাজিক পুঁজি বা নূন্যতম এক ধরণের সামাজিক যোগাযোগ লাগে। কিন্তু তবু ধরে নেই যে এই বাজারটিতে কিছুটা হলেও উন্মুক্ত প্রবেশ বা ফ্রি এন্ট্রি আছে। কিন্তু বই বিক্রির বাজারটা আসলে এমন না। বাংলাদেশে এখন বই বের করতে যেটা লাগে, মূলত নতুন লেখকদের ক্ষেত্রে, সেটা হলো সোশ্যাল ক্যাপিটাল বা সামাজিক পুঁজি।

নয়া সামাজিক পুঁজি কিভাবে এখানে তৈরি হচ্ছে? আগে যেমন পত্রিকায় লিখে লিখে ঘষে পিটে লেখক হতে হতো, এখন তেমন লাগেনা। এখন ফেসবুকে লিখে বা ইউটিউবে ভিডিও বানিয়েই সামাজিক পুঁজি বানানো যায়। এটার ভালো এবং মন্দ দুই দিকই অবশ্যই আছে। ভালো দিক হলো যে ফেসবুকের বা ইউটিউবের বাজারে প্রবেশাধিকার কমবেশি উন্মুক্ত, যদিও এই ক্ষেত্রে আর্থিক পুঁজির একটা ব্যাপার থেকেই যায়। তবু আগের চেয়ে এই পদ্ধতিতে লেখক হওয়া সহজতর। তবে এই পদ্ধতিতে কি আসলে মানুষ লিখে সামাজিক পুঁজি পাচ্ছে, নাকি অন্যভাবে পুঁজি পাচ্ছে?

মনে হতে পারে এই সামাজিক পুঁজি আসলে ভোক্তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, কেননা ভোক্তা ঠিক করবে যে কোন ভিডিও সে দেখবে বা কোন লেখা শেয়ার দেবে। তবু বলবো যে এখানেও আসলে বিকৃত ভাবটি রয়েছে। এখানে ভোক্তার কাছে পর্যন্ত কি পৌঁছাবে, বা পৌঁছাবে না তার ওপরে রাষ্ট্রের একটা গভীর প্রভার রয়ে যায়। ধাপে ধাপে এর ব্যাখ্যা করি। প্রথমত, দেখা যায় ফেসবুকে অনেকেই বেশ গভীর লেখেন, এবং ভালো সাহিত্য করেন–কিন্তু তাদের সবার বইও আসেনা বা চলেনা।

অনেক সময়ে তাদের বই করতে দেয়া হয় না, তাদের বইয়ের পরিবেশনা করতে দেয়া হয়না, বিজ্ঞাপন করতে দেয়া হয়না, আটকে দেয়া হয়, প্রকাশক চাপের মুখে পড়েন–এমন ঘটনা ঘটছেই অহরহ। এসব ছাপিয়েও যখন নানান ঝুঁকি নিয়ে প্রকাশকেরা বই করেন, তখন দেখা যায় তার পসার সেভাবে ঘটছে না–তবে কিছু ফেসবুক লেখকের বইয়ের পসার ঘটছে। কাদের বইয়ের পসার ঘটছে? যারা আসলে মোটিভেশনাল বা আত্মোন্নয়ন গোছের বই লেখেন তারা।

এই লেখকেরা কারা? যাদের সামাজিক পুঁজি সর্বোতভাবে ধনাত্মক বা পজিটিভ, তারা। এই সামাজিক পুঁজির ধণাত্মকতা বা ঋণাত্মকতা কে নির্ধারণ করে? অবশ্যই শাসকশ্রেণী। ডমিন্যান্ট ন্যারেটিভ বা মূলধারা বিচারের পক্ষপাতী হলেই সহজভাবে এই ধণাত্মক সামাজিক পুঁজি গড়ে তোলা সম্ভব। কাজেই চিন্তার জগতে যে একটি মুক্ত প্রতিযোগিতা ঘটবে, সেই সুযোগ এখানে থাকছে না। এমন বাজার বিকৃতিকরণের ব্যাপারটি সারা পৃথিবীতেই ঘটে থাকে, তবে উপরে বর্ণিত নানাবিধ কারণে বাংলাদেশে সেটা হয় খুব বেশি। আপনি কতখানি মূলধারার কাছাকাছি, সেটি নির্ধারণ করে দেবে আপনি বইবাজারে কতোটুকু স্থান পাবেন–আর এই মূলধারাও কোন দ্বান্দিক মূলধারা নয়, বরঞ্চ একপ্রকার চাপানো মূলধারাই।

কাজেই বইয়ের বাজার আসলে রেস্টুরেন্টের বাজার থেকে ঢের আলাদা। এই বাজারে এসিমেট্রি অফ ইনফরমেশন বা তথ্যের অসাম্য অনেক বেশি। কারণ আমি যখন বার্গার খাই, তখন আমি সরাসরি সেটার স্বাদ নিতে পারি কারণ আমার জিহ্বার নার্ভের মাধ্যমে, সেখানে মতাদর্শের বা শিক্ষাকাঠামোর প্রভাব কম। কিন্তু কোন বই আমার ভালো লাগবে সেটা অনেকাংশে আমার শিক্ষা নির্ধারণ করে দেয়, বিশেষত যদি সেই শিক্ষায় বিশ্লেষণী ক্ষমতার প্রশিক্ষণ না থাকে। আর আমার শিক্ষাকে আমার রাষ্ট্র বা সরকার নির্ধারণ করে দেয়, আর সেই সরকারকে আসলে কে নির্ধারণ করে? যারা আসলে নির্ধারণ করে, তারাই খানিকটা নির্ধারণ করে যে বইয়ের বাজারে কি কাটতি হবে, আর কি কাটতি হবেনা।

আমার শিক্ষা যখন আমাকে ইতিহাসের একটা একসুতা ব্যাখ্যা শিখায়, তখন সেটার বাইরে যায় এমন কোন বিশ্লেষণ আমার নিতে কষ্ট হবে–এমনই স্বাভাবিক। কাজেই সেই আলাপটা কাজের হইলেও সেটা আমি গ্রহণ করতে পারবো না। কাজেই বইয়ের মার্কেটে যে বিক্রেতা, অর্থাৎ লেখক, সে একটা চাপধারী বয়ান বা ডমিন্যান্ট ন্যারেটিভে যখন লিখবে তখন সে ওই তথ্যগত অসাম্যকে কাজে লাগাতে পারবে, কিন্তু যেই সে একটু গভীর ব্যাখ্যা দেবে বা মূলধারা বিশ্লেষের বাইরে যাবে, তখনই সে সামাজিক পুঁজি বা সোশ্যাল ক্যাপিটাল হারাবে এবং সাথে সাথে ভোক্তা হারাবে।

আর এই যে ভোক্তা, সে বইয়ের বাজারে সবসময় অপ্রধান ধারার কাজ সবসময় পাবেও না যে তুলনা করে দেখবে–এটাই তথ্যগত অসাম্যকে আরও গভীর করবে। ফেসবুকের লেখা বা কলাম হয়তো সে পড়বে, কিন্তু বইয়ের সুঠাম গভীরতা আর পরিসর থেকে সে বঞ্চিতই রয়ে যাবে। আবার দেশের কলামেও রয়ে যায় সেলফ-সেন্সরশিপ বা আত্মরোধ, এদিকে ফেসবুকে আছে গণরিপোর্টের ভয়।

এরকম একটা সময়ে সেলফ হেল্প লেখা আসলে আমাদের জন্য ক্ষতিকরই, কারণ এটা উদ্ভাবনকে রোধ করে। যেহেতু চিন্তার বাজারে মুক্ত প্রতিযোগিতা নেই, যেহেতু ভোক্তার দিক থেকে তথ্যগত অসাম্য আছে আছে, সেহেতু সে ভেজালযুক্ত পণ্যকেই জাতের পণ্যজ্ঞানে গ্রহণ করে। আর এখানে যারা পণ্যের মাননিয়ন্ত্রক সংস্থা, তারাই বরং ভেজালকে এগিয়ে দেয় আর প্রকাশকরাও ভেজাল বেচে বেশি কারণ ভেজাল বিকায়, আর নির্ভেজাল বা খাঁটি বা অপরপক্ষীয় ভেজাল তার ব্যবসায় ভেজাল লাগায়। এই ক্ষেত্রে সেলফ হেল্পের ভূমিকা দাঁড়ায় আসলে মূলধারা চিন্তাকে বা শাসকের সাহায্যকারী বিশ্লেষকে উপরে তুলে আনা।

হতে পারে যে সে সফলতার একটা নতুন মাপকাঠি সামনে নিয়ে আসছে। আগে হয়তো বিজ্ঞান নিয়ে একপ্রকার মাতামাতি ছিলো, আর এখন মাতামাতি হচ্ছে ব্যবসায় উদ্যোগ নিয়ে–কিন্তু প্রথা ভাঙ্গার কথা, বিশেষত সামাজিক চিন্তার স্থলে গুমরেই মরছে। নতুন চিন্তার স্থান হচ্ছে লিটলম্যাগ চত্বরে, বা ছোট স্টলের প্রকাশনীকে (যাকে ছোট স্টলও দেয়া হয় এমনতর বই বের করার “অপরাধে”), বা দেখা যাচ্ছে সেই বইয়ের প্রচার-প্রসার হচ্ছে মোটিভেশনাল বইয়ের থেকে কম।

যদি বলেন ই-কমার্স সাইটের বাজার মুক্ত, সেই ধারণাও পুরোপুরি সঠিক বলে মনে করিনা। সেসব সাইট বা প্রকাশকেরা নির্দিষ্ট কিছু বইয়ের ব্রান্ডিং এ টাকা ঢালে, আর কোনো কোনো বইতে ঢালে না। অনেক ভালো বই প্রকাশকেরা স্টলের ডিসপ্লেতেই রাখতে পারেন না–চোরাগোপ্তা ভাবে কিনতে হয়, বিশেষত যদি বই হয় সমাজ বা রাজনীতির ভিন্নধারা নিয়ে।

এর ফলে কি হয়? ফলে দেখা যায় যারা মূলধারা বিশ্লেষকেই টেনে নিয়ে যাচ্ছে তাদেরই লেখক হিসেবে সামাজিক পুঁজি বাড়তে থাকে। বাড়তে বাড়তে একসময়ে তারা তাদের লেখার ক্ষেত্র অতিক্রম করে এক ফাঁকে সামাজিক আর রাজনৈতিক কথা লেখা শুরু করে। এভাবে একসময়ে তারা বুদ্ধিজীবি হয়ে যায় আর মূলধারা বিশ্লেষ নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করে। এরকম হাতুড়ে পক্বকেশী বুদ্ধিজীবিরা অগভীর বা অসৎ বিশ্লেষণ দিয়ে এমন একটা বয়ান দাঁড়া করায় যেটা একটা অন্যায্য ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতেই সাহায্য করে।

আমার চোখে এইসব সেলফ হেল্প বুকের রাইটাররা, বিশেষত যারা সর্বোতভাবে ধণাত্মক সামাজিক পুঁজিধারী–তারা সেসব পক্বকেশী সৌখিন বুদ্ধিজীবিদের আদর্শিক উত্তরসূরি। তারা একসময়ে তাদের অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রকে অতিক্রম করে সমাজ আর রাজনীতিতে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন–আগেও উঠেছেন, আবার উঠবেন। তাদের যে সামাজিক পুঁজি তৈরি হয়, তাতে তারা কিসে তালি দিলো বা ফেসবুকে লাইক দিলো, সেটাও মূলধারা বিশ্লেষণকে দাঁড়া করিয়ে ফেলে।

এটা একটা ভয়াবহ ব্যাপার।

কারণ তারা জ্ঞানতাপস বাহাসী জ্ঞানের চর্চা করে হয়না, নিজের সাফল্যকে বেচে হয় বা নিজের ধণাত্মক সামাজিক পুঁজিকে বেচে হয়, যেটা তারা দাক্ষিণ্য হিসেবে পায় শাসনকাঠামোর কাছে থেকে। তারা আদতে সমালোচনা করে আলোচক হয় না, সমালোচনার ঊর্ধ্বে থেকে সমালোচক হয়ে ওঠে। তারা দ্বান্দিক এক্টিভিজম করে এক্টিভিস্ট হয়না, ভালোমানুষ সেজে এক্টিভিস্ট হয়।

এইসব সেলফ হেল্প বইয়ের বাজারের পরিবেশনা দেখলেই দেখবেন যে এরা একটা ব্যক্তিক পুঁজিবাদ খাড়া করছে, একটা পারসোনালিটি কাল্ট তৈরি করছে-যেটা রাজনীতিতে আঘাত ফেলতে বাধ্য। এরাই একসময়ে আলোচনার ধারাকে নিয়ন্ত্রণ করে–আর এদের মানুষ নেয়ও কারণ এরা নিজের চিন্তাকে সামনে আনেনা, সামনে আনে নিজেকে– ফলে মানুষ আর ব্যক্তির ভয়ে চিন্তাকে সমালোচনা করার সাহস পায়না।

এখন বলতে পারেন যে এমন ঘটনা তো সারা পৃথিবীতেই ঘটছে। সারা দুনিয়াতেই তো এখন আত্মোন্নয়নের কাটতি। ভারতেও বহু যোগী এমন ভাবেই রাজনৈতিক নেতা হয়ে গেছে। তারাও ভয়ংকর, এবং তাদের আমরা ভয়ংকর হিসেবেই জানি। তবে আমাদের দেশের যোগীদেরকে আমরা কেন ভয়ংকর ভাবে দেখবো না? পৃথিবীর ইতিহাসে নন-ক্রিটিকাল চিন্তা সবসময়েই জুলুম কায়েম করেছে-দেশে দেশে, সময়ে সময়ে। বাজারের যে সমস্যা বললাম, সেই কারণেই এই বিষয়টা দাঁড়ায়–চিন্তার জগতে ফ্যাসিজম কায়েম হয়।

যে ব্যক্তি সফল ব্যক্তি এক ক্ষেত্রে, সে সব ক্ষেত্রে চিন্তার একাধিপত্য নিয়ে ফেলে। তবে ভারতে বা আমেরিয়াকায় এই চিন্তাফ্যাসিস্টদের ছুড়ে ফেলা কিছুটা সম্ভব হয় কেননা সেখানকার প্রকাশনা কিছুটা বিকেন্দ্রিভূত আর কমপক্ষে একক কোন সংস্থার হাতে সকল প্রকাশনার বা পত্রিকার একাধিপত্য নেই–কিন্তু বাংলাদেশে আছে। তাই বাংলাদেশের মোটিভেশনাল বিক্রেতারা সবচেয়ে বেশি ভয়ংকর।

এই চিন্তাফ্যাসিবাদকেও ছুঁড়ে ফেলে দেয়া যায়। বাংলাদেশে খুব সাম্প্রতিক সময়েও কয়েকজনকে কিছুটা হইলেও বাঁটে ফেলা গেছে। তবে এরা জ্ঞানের শত্রুই। এদের ব্যক্তিক পুঁজির কারনে এরা অসম্মানের তোড় কাটিয়েও আবার সম্মানের জায়গায় হাচড়ে পাচড়ে উঠে যাবার চেষ্টা করতে পারেন। আর এটা করতে পারেন, কেননা এই কাজে বর্তমান কাঠামো তাদের সহায় হন, কারণ তারা আসলে কাঠামোরই এক অংশ।

এলগোরিদমের ধাক্কায় ফুঁসে ওঠা অগভীর চিন্তা একটা নষ্ট বাজারে জ্ঞানের সুবিশাল শত্রু। এটা বোঝাটা জরুরি। ফেসবুক সেলেব্রিটি কোটায় বই বের করা নিয়ে আমার ঠিক সমস্যা নেই। আমার নিজের বই দুটাই কমবেশি সেই কোটায় বের হয়েছে–বিশেষ যোগ্যতা যে আমার আছে, তাও না। কিন্তু কমপক্ষে একটা ক্ষুদ্রতম বিনয় নিয়ে আমার চিন্তাকে আমার ব্যক্তিক পুঁজি থেকে আলাদা করবার একটা প্রচেষ্টা আমার আছে–সেটা সফল হোক বা ব্যর্থ। তবে ফেসবুকের জনপ্রিয়তাকে আমি লেখার মানদন্ড বা চিন্তাশক্তি বা ব্যক্তিত্বের বিচারের মানদন্ড বলে মানতে রাজি না।

ফেসবুক বা ইউটিউবও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। এলগরিদম কোন কথাটাকে উঠায় আর কোনটাকে নামায়, সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করে সেই কোম্পানির পলিসি–সরাসরি ভোক্তা আর বিক্রেতা না। আর কোন কনটেন্ট কেনো শেয়ার পায় সেটাও নির্ভর করে শিক্ষাকাঠামোর ওপরে। কাজেই এই জগতের থেকে উঠে আসা একটা মানুষের আত্মসমালোচক হবার বা বিনয়ী হওয়া খুবই কঠিন। সেই কাঠিন্য দিয়েই ফেসবুকারদের বই বিচার করা উচিত। যেটা ফেসবুক সেলেব্রিটির বই–তার সেই ব্যক্তিক পুঁজির বাইরে সেই বইটা লেখার কি যোগ্যতা আছে? যে যোগ্যতা আছে সেটার নিরিখে তার কাজের বিচার হোক।

সাহিত্য বা সমাজ বা রাজনীতি নিয়ে লিখতে যে ডিগ্রী পাশ করা লাগে সেটা আমি বলছিনা। বই সবার লিখতে পারা উচিত আর বের করার সুযোগ পাওয়া উচিত। কিন্তু সবাই সেই সুযোগ পায়না। আর যারা পারে, তাদের সেই বিষয়ে কাজের যোগ্যতা বিচারের প্রশ্ন করুক ভোক্তা। জানতে চাক তার এই বিষয়ে আগের কাজ কি? বই উলটে পালটে বই কিনুক। কিছুটা পড়ে দেখুক। শুধু নামের জোরে বইটা না কিনুক।

যদি লেখকের লেখার নির্দিষ্ট বিষয়ে লেখার বা প্রকাশনার অভিজ্ঞতা না থাকে, তবে দশটা অনভিজ্ঞ লেখকের সমান হিসেবেই তার বই দেখা হোক। কিন্তু সেটা দেখা হয়না কখনও কোথাও। ব্যক্তিক পুঁজির ওপরেই সব জায়গাতেই সেলফ হেল্প বই চলে। কিন্তু এটাকে খোলামেলা বাজার ভাবলে চলবেনা। চিন্তার জগত, কমপক্ষে এদেশে, মোটেই খোলামেলা হয় না। বিতর্ক ছাড়া, সমালোচনা ছাড়া লেখা হয়না–আর সেটা সেলফ হেল্পের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। চিন্তার সেই তর্কটা এখানে হচ্ছেনা, বা হতে দেয়া হচ্ছেনা–কমপক্ষে এতোটুকু আমাদের বোঝা উচিত।

অনুপম দেবাশীষ রায় মুক্তিফোরামের সংগঠক এবং সম্পাদক

Share.
Leave A Reply