নিজেদের জীবন ও সার্বভৌম বাঁচানোর আন্দোলনে শামিল থাকা এক বিদ্রোহীকে টেনে হিঁচড়ে তুলে নিয়ে যাচ্ছে একদল পুলিশ বাহিনী, আর এই সংবাদ আগুনের লেলিহান শিখার মতো মুহূর্তের মাঝেই ছড়িয়ে পড়েছে আসেপাশের গ্রামগুলোতে। ক্রোধোন্মত্ত স্থানীয় জনতা লাঠি, কাস্তে, দা কিংবা বটি, যা হাতের কাছে ছিল তা-ই নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্যে একত্রিত হয়েছে, কারন এই সংগ্রাম তো তাদের নিজেদেরও মুক্তির সংগ্রাম। তবে কি সরকারের পোষা এই জানোয়ারদের হিংস্র বন্দুকের নলের বিপরীতে রুখে দাঁড়াতে পারবে নিরীহ ও অত্যাচারিত গ্রামবাসী?

প্রিয় পাঠক, কোনো কল্পকথা অথবা গ্রামের কোনো কিচ্ছাকাহিনি নয়, আজ শোনাবো নতুন প্রজন্মের কাছে অজানা এক বীরত্বগাঁথা নারী সংগ্রামের ইতিহাস!

স্থান ও কালঃ বর্তমান নেত্রকোনা জেলার সুসং দুর্গাপুর উপজেলার কুল্লাগরা ইউনিয়নের বহেরাতলী গ্রাম, সাল ১৩৫২ বঙ্গাব্দ, মাঘ মাসের ১৮ তারিখ (৩১ জানুয়ারী, ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দ) । জী ব্রিটিশ আমলের কথা বলছি, ব্রিটিশবিরোধী ‘টঙ্ক’ আন্দোলনের কথা বলছি!

কনকনে শীতে আবহাওয়া ঠাণ্ডা থাকলেও তখন টঙ্ক আন্দলনের ব্যাপকতা ও তীব্রতায় চারিদিক মুখর হয়ে ছিল। তৎকালীন এই এলাকায় বসবাস করতেন ‘হাজং’ নামের সম্প্রদায় (বর্তমানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃত)। ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে ক্ষমতালোভীরা নিজেদের গদি বাঁচাতে সাধারণ জনগণের উপরে জুলুম অত্যাচার বাড়িয়ে দিয়েছে, তাই তাদের প্রতিনিধি হিসেবে ‘সুসং’ জমিদারেরা চালু করেছিলো ‘টঙ্ক’ প্রথা, যেখানে বরাবরের মতো অন্যান্য জুলুম অত্যাচারের পাশাপাশি গরীব কৃষকদের চুক্তি অনুসারে জমিদার-মহাজনদের ফসলের ধান দিয়ে দিতে হতো, এরা এইবার অনাহারে মরে গেলেও ওদের কি যায় আসে।

ইতিহাস বলে হাজং সম্প্রদায় পূর্বেও ‘হাতিখেদা’ নামক এক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল, তাই এইবারও এর ব্যাতিক্রম হল না। কমরেড ‘মনি সিংহ’ (জমিদারদের ভাগ্নে) জনগণের এই কাতারে শামিল হয়ে আন্দোলনকে ভয়াবহ রুপ দিলেন আর বাড়িয়ে দিলেন গতি। তাঁর খুব কাছের একজন মানুষ ছিলেন ‘লংকেশ্বর হাজং’, যে কিনা ঘরে তুলেছে তার সদ্যবিবাহিতা স্ত্রী ‘কুমুদিনী হাজং’-কে। ক’দিন থেকেই ‘ব্রিটিশ রাইফেলস রেজিমেন্ট’ এর পুলিশ বাহিনী হানা দিচ্ছে এ-গ্রামে ও-গ্রামে, খবর পেয়ে আন্দোলনকারী পুরুষ দল সরে পড়লো নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে দূরের এক আস্তানায়।

ব্রিটিশ রাইফেলস রেজিমেন্টের লোকেরা তখন কুমুদিনী হাজং কে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে–যা বৃথা হয়ে যায় গ্রামের নারীরা সম্মিলিত প্রতিরোধে। প্রথমে দা, বটি সহ হাতের কাছে যা ছিল তা-ই নিয়ে পরে যখন ৫০ কিংবা তার কাছাকাছি সংখ্যক বিদ্রোহী তাঁর সাথে যোগ দিলেন তখন বল্লম ও রামদা দিয়ে ব্রিটিশ পুলিশের সাথে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ জড়ালেন ও সফলভাবে তাদেরকে হটিয়ে দিলেন।

কিন্তু এর ফলাফলে তাঁর শরীর অন্ততপক্ষে ১০টি বুলেট দ্বারা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেলো, ‘টঙ্ক’ আন্দোলনের প্রথম শহীদ হলেন ‘রাসমনি হাজং’। একই সাথে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন ‘সুরেন্দ্র হাজং’ ও আরও নাম না জানা অনেকেই। ‘রাসমনি হাজং’ কুমুদিনীকে লালন পালন করেছেন ছোটবেলায় তাঁর মা-বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে, তাঁর মৃত্যুর শোক নিয়েই পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। নিজ নাম পাল্টে রাখতে হয়েছে ‘সরস্বতী’, যেন ছদ্মনামে মামলা কিংবা হয়রানির শিকার না হতে হয়। ১৯৫০ সালে ব্রিটিশবিরোধী লড়াইয়ের দ্বারা অভিশপ্ত ‘টঙ্ক’ প্রথা বাতিল হয়েছে, তারপর কুমুদিনী আবার লড়েছেন স্বাধীকার আন্দোলনে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। কিন্তু এই রাষ্ট্রযন্ত্র তাকে যেন ভুলেই গেছে। লেখার সময়কালীন স্বাধীন বাংলায় তিনি থাকছেন ছোট পাহাড়ের এক টিলার উপরে, যেখানে তাঁরা ঘন জঙ্গল ও আগাছা পরিষ্কার করে ঘর তুলেছেন, বন্য গাছ পরিষ্কার করে ফলজ গাছ লাগিয়েছেন।

শেষ কোন একবার কুমিদিনী দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে আফসোস করে বলেছিলেন ফরেস্টার সাহেব এসে নিষেধ করে গেছেন তাঁদের নিজেদের লাগানো গাছ থেকে ফল না খেতে, যত তাড়াতাড়ি পারেন বসতবাড়ি ছেড়ে দেওয়ার-ও নির্দেশ দিয়েছেন।

দেশের শেষ দুইজন প্রধানমন্ত্রী অনেক ক্ষমতায়নের বয়ান দিয়ে গেছেন। তবু তাদের কেউ কুমুদিনী হাজংকে মনে রাখেননাই। ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের, স্বাধিকারের লড়াইয়ের আর মুক্তিযুদ্ধের লড়াইয়ে শামিল এই চিরযোদ্ধাকে, জাতীয় বীরকে, কোনদিন রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানো হয়নাই। কিন্তু মুক্তিফোরাম সরকারের দিকে মুখ চেয়ে থাকেনা। মুক্তিফোরামের তৃতীয় ও চতুর্থ গণপরিষদের আলাপে সর্বসম্মতিক্রমে কুমুদিনি হাজং-এর হাতে মুক্তিপদক তুলে দেবার প্রস্তাবটি গৃহীত হয়।

জনগণের অংশীজন হিসেবে জনতার পক্ষ থেকে কুমুদিনী হাজং এর হাতে মুক্তিপদক তুলে দেবে মুক্তিফোরাম, সাথে থাকবে সারাদেশের মানুষের ভালোবাসা। এই পদকের প্রতিটা পয়সা আসবে দেশের মানুষের শ্রম আর ঘামের টাকাকড়ির থেকে। তার অবদানকে বাংলাদেশ ভুলবে না, তার ত্যাগকে আমরা সম্মান জানাবো। তার সংগ্রামী জীবনের কাছে এই পদকটি হয়তো কিছুই নয়–কিন্তু তাকে সম্মান জানানোটা আমাদের সকলেরই কর্তব্য।

তাই আপনাদের যে যতটুকু পারেন এই পদকের জন্য আর্থিক সাহায্য পাঠাতে পারেন। বইমেলায় গ্রন্থিকের স্টলে (স্টল ২১১) আমাদের কুমুদিনী হাজং ফান্ডের দানবাক্স রয়েছে। চাইলে আমাদেরকে বিকাশ করতে পারেন ০১৯৪৪৬৮৬০৮৬ নাম্বারে।

সকলকে ধন্যবাদ।

সূর্যের দিন আসবেই।

মুক্তিফোরামের পক্ষে এই ঘোষণাপত্রটি লিখেছেন আল মাহাদি হাসান

Share.

মুক্তিফোরাম একটি মুক্তিবাদী, বহুত্ববাদী এবং জনপন্থী সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে গড়ে ওঠা সংগঠিত গণমঞ্চ। এর লক্ষ্য হলো নতুন ধরণের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক চর্চা নির্মাণ। নোংরা হিসেবে রাজনীতির যে রূপকল্প এদেশের মানুষের কাছে নির্মাণ করা হয়েছে, সেটিকে চ্যালেঞ্জ করতে চায় মুক্তিফোরাম। আবার যেসব একক আদর্শ (যেমন বামপন্থা-ডানপন্থা) বা পরিচয়ের রাজনীতি (সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, জাতিবাদ) দিয়ে জনগণের সংহতি ও বৈচিত্র্য হুমকির মুখে ফেলা হয়েছে তার একটি এন্টিডোট হয়ে ওঠাও মুক্তিফোরামের প্রকল্প।

Leave A Reply