মুজিব বর্ষ উদযাপনের অনুষ্ঠানে নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রন নিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, “মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত ছিল বাংলাদেশের প্রধান সাহায্যকারী দেশ। মুজিববর্ষে সে দেশের সরকার প্রধানকে আমন্ত্রণ না জানানো হবে সম্পূর্ণ অকৃতজ্ঞতা।”
সেতুমন্ত্রী আরও বলেছেন, “মুজিব বর্ষে নরেন্দ্র মোদিকে আমন্ত্রণ জানানোর মূল কারণ হলো মুক্তিযুদ্ধের সময় অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছে ভারত। আমাদের রক্তের সাথে ভারতের রক্ত মিশে আছে।”
এবং “ভারতে চলমান আন্দোলন তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়”।

অন্যদিকে মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আগমন কেউই ঠেকাতে পারবে না- এমন দাবি করেছেন ১৪দল মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম।
তিনি বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের মিত্র ভারতের অতিথিদের আগমন নিয়ে যারা অরাজকতা সৃষ্টি করবে তাদের রুখে দেয়া হবে। 

এখন কিছু বিষয় সাধারন বিশ্লেষন করা যাক।

প্রথমত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ভারতের অবদান নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। আমাদের দেশের মানুষ সেটা সব সময়ই শ্রদ্ধার সাথে স্মরন করে। এবং তার কারনে বিভিন্ন সময়ে ট্রানজিট, বন্দর, বানিজ্য সহ ভারত বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পেয়েছে বাংলাদেশের কাছ থেকে, এখনো পাচ্ছে।

দ্বিতীয়ত মুজিব বর্ষের অনুষ্ঠান বঙ্গবন্ধুর জন্ম-শতবার্ষিকীর একটি অনুষ্ঠান এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী, সূবর্ণজয়ন্তী বা শতবর্ষ পূর্ণের অনুষ্ঠান নয়, যে যেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রন না জানানো হলে সেটা বাংলাদেশের অসম্মান হবে!

তৃতীয়ত বঙ্গবন্ধুর জন্ম-শতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে মূলত তার জীবনী নিয়ে আলোচনা ও বক্তব্য রাখবেন বক্তারা। যেখানে উঠে আসবে তার জন্ম, বেড়ে ওঠা, পারিবারিক জীবন, শিক্ষা জীবন, রাজনীতিতে প্রবেশ, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ও রাষ্ট্র পরিচালনার ইতিহাস। আর তার জীবনী নিয়ে প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখার জন্য NRC, CAA নিয়ে লাফ ঝাঁপ দেয়া উগ্রবাদী গুজরাটি কসাই মোদিকে আনতে হবে! অথচ যার জন্মই হয়েছে ৪৭ এর ভারতবর্ষ ভাগের পরে ১৯৫০ এ! বয়সেতো মোদি শেখ হাসিনার চাইতেও ছোট! ৭১এর মুক্তিযুদ্ধের সময় মোদির অবস্থান কই ছিল? ভূমিকাই বা কি ছিল আওয়ামীলীগের কেউ বলতে পারবেন? আরে ভাই দেশে কি বর্ষীয়ান রাজনৈতীক নেতাদের অভাব পড়ছে? আওয়ামীলীগের আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদে, জাসদের আ স ম আবদুর রব, গণফোরামের ড.কামাল হোসেনর মত নেতারা যারা মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে বঙ্গবন্ধুর সাথে ছিলেন, এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে রাজনীতি করেছেন তাদের মধ্যে তো অন্তত এরা বেঁচে আছেন!
তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কে সবচাইতে ভালো যে দুজন মানুষ বলতে পারবেন তারা হলেন তার কন্যা শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানা। কারন সন্তানের চাইতে বেশি সুন্দর করে অন্য কেউ একজন পিতাকে বর্ণনা করতে পারে না।

আর আন্তর্জাতিক অঙ্গনের কথা চিন্তা করলে যেহেতু প্রথমে ভারতের নাম আসবে সেহেতু সেখানে ইন্দিরা গান্ধির পরিবারের নাম আসার কথা। তা নাহয় বাদ দিলাম ইন্দিরা গান্ধি বেঁচে নেই।
কিন্তু ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মূখার্জি? তিনি তো বেঁচে আছেন! মুক্তিযুদ্ধে যার অবদান চির স্মরনীয়! অথচ প্রণব মূখার্জিকে আমন্ত্রন করা হয়েছে ২২শে মার্চ! এমন সব গুনী মানুষ থাকতে একটা বর্ণবাদী, উগ্র হিন্দুত্ববাদী কসাইকে আনার এত তোড়জোড়ের কারন টা কি?

আর কাদের সাহেব জ্বি জেনে রাখেন ভারতে NRC, CAA নিয়ে যে আন্দোলন হচ্ছে এবং সেটাকে তাদের অভ্যন্তরীন বিষয় বলে নিজেদের দায় এড়ানোর পাশা পাশি ফ্যাসিস্ট কসাই এর কর্মকান্ডের স্বিকৃতি দিচ্ছেন? CAA পড়ে দেখেছেন?
CAA এর “STATEMENT OF OBJECTS AND REASONS” এ লেখা আছেঃ- “It is a historical fact that trans-border migration of population has been happening continuously between the territories of India and the areas presently comprised in Pakistan, Afghanistan and Bangladesh. Millions of citizens of undivided India belonging to various faiths were staying in the said areas of Pakistan and Bangladesh when India was partitioned in 1947. The constitutions of Pakistan, Afghanistan and Bangladesh provide for a specific state religion. As a result, many persons belonging to Hindu, Sikh, Buddhist, Jain, Parsi and Christian communities have faced persecution on grounds of religion in those countries. Some of them also have fears about such persecution in their day-to-day life where right to practice, profess and propagate their religion has been obstructed and restricted. Many such persons have fled to India to seek shelter and continued to stay in India even if their travel documents have expired or they have incomplete or no documents.”

এখানে স্পষ্ট ভাবে বাংলাদেশের সংবিধানকে অপমান হেয় করা হয়েছে, বাংলদেশকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং বাংলাদেশে সাংবিধানিক ভাবে সংখ্যালঘুরা নিরাপদ নয় বলে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। ভারতের আইনে সরাসরি বাংলাদেশের সংবিধান ও সংখ্যালঘুদের নামে মিথ্যাচার এবং কথায় কথায় যারা বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের ফেরত পাঠানো হবে বলে হুংকার দিচ্ছেন সেটাকে কি একান্ত ভারতের অভ্যন্তরীন বিষয় বলা যাবে?

এই যে মিয়ানমারে কয়েক দশক ধরে রোহিঙ্গা নিধন চলছে সেটাকে কি তাদের অভ্যন্তরীন বিষয় বলছেন? সেখানেও সমস্যাটা কিন্তু নাগরিকত্ব নিয়ে। এবং বলা হচ্ছে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ হতে আগত। একটা সময় যখন মহামারি হয়ে রোহিঙ্গারা দল বেঁধে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে তখন পেরেছেন কিছু করতে? দুই বছরে একটা রোহিঙ্গা পরিবার ফেরত পাঠাতে পেরেছেন?

যাই হোক মোদিকে আমন্ত্রনের অবশ্য কারনটাও সহজ। চোরে চোরে যেমন মাসতুতো ভাই সেভাবে এক ফ্যাসিস্ট এর জন্যই সাফাই গাইবে অন্য ফ্যাসিস্ট।

মোদির শাসনামলে ভারতে একের পর এক দূরাবস্থা দূর্বল অর্থনীতি, কর্মসংস্থান, ভাত-কাপড়ের অভাব মেটাতে না পারার গ্লানি ঢাকতে যেমন NRC CAA ইশ্যুতে ভারতের জনগণকে বিভক্ত করে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা হচ্ছে বলছে স্বয়ং ভারতেরই জনগন। সারা দেশে গো-রক্ষার নামে হয়েছে একের পর এক মুসলমান হত্যা করা হয়েছে রাষ্ট্রিয় উষ্কানিতে, হয়নি কোন বিচার। সর্বশেষ NRC CAA ইশ্যুকে ধর্মীয় দাঙ্গায় রুপান্তর করে ৩০ এর বেশি মানুষ মারা হয়েছে দিল্লিতে গত সপ্তাহে, যেখানে পুলিশের ছিল নিরব দর্শকের ভূমিকা। মোদি সরকারের এসব কর্মকান্ড শুধুমাত্র ভারত নয় সমস্ত দক্ষিন এশিয়ার সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিচ্ছে। আর তার এসব কর্মকান্ডে একমাত্র বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ব্যাতীত সারাবিশ্বের কোন দেশ সমালোচনা করতে ছাড়ছে না।

অন্যদিকে প্রশ্নোবিদ্ধ নির্বাচনের মধ্যদিয়ে গনতন্ত্র হত্যা, বাক-স্বাধীনতা হরণ, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রন, ভিন্নমত দমন, উন্নয়ন প্রকল্পের নামে একেরপর এক সীমাহীন দূর্নীতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, খুন-গুম-ধর্ষণে দেশের মানুষ আজ অতিষ্ঠ।
মায়ানমার হতে রোহিঙ্গা ঢল, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে প্রতিনিয়ত পাখির মত গুলি করে মানুষ হত্যার মত বিষয়ে নীরব ভূমিকা সব কিছু মিলিয়ে আন্তর্জাতিক পররাষ্ট্রনীতির মঞ্চে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা এতটাই দূর্বল যা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

এক কথায় অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তচিন্তার যে ভিত্তিনিয়ে ৪৭ এ ভারত ও ৭১ এ বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল তার পুরুটাই ভুলুন্ঠিত হয়েছে দুু দেশের দুই বর্তমান ফ্যাসিস্ট সরকারের হাতে।

রাষ্ট্রের জনগনের অর্থে মুজিব বর্ষ উদযাপনের রাষ্ট্রিয় অনুষ্ঠানে অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা বলে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কে প্রধান বক্তা হিসেবে এমতাবস্থায় আরএসএস-বিজেপি’র সৃষ্টি উগ্র-হিন্দুত্ববাদী দাঙ্গাবাজ মোদিকে আনার আর কত সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করবেন ক্ষমতাসীন নেতারা?

মুক্তিযুদ্ধের অবদানের ফেনা তুলছেন মুখে?
খন্দকার মোশতাক আহমেদের কথা মনে আছে তো? মুক্তিযুদ্ধের সময় মুশতাক মুজিবনগর সরকারে তিনি পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লাভ করেন। দেশ স্বাধীন হবার পর শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারে তিনি বিদ্যুৎ, সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৭৫ সালে তাকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি বাকশালের কার্যকরী কমিটির সদস্য ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নিহত হবার পর মোশতাক আহমেদ নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। রাষ্ট্রপতির দ্বায়িত্ব নেবার পর তিনি ইনডেমিনিটি বিল পাশ করেন। তিনি “জয় বাংলা” স্লোগান পরিবর্তন করে এর স্থলে “বাংলাদেশ জিন্দাবাদ” স্লোগান চালু করেন। তার শাসনামলে চার জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, ক্যাপ্টেন মোঃ মনসুর আলী ও এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামানকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে (৩ নভেম্বর) হত্যা করা হয়। মোশতাকের পরিবারের লোকজন জনরোষের ভয়ে দেশে আসেনা। আপনারা মোদির সন্ত্রাসবাদের কুকর্ম ঢাকতে যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের অবদানের ডোল পেটাচ্ছেন সে হিসেবে তো মুক্তিযুদ্ধের অবদানের জন্য বঙ্গবন্ধুর খুনি খন্দকার মোশতাকের পরিবারও মুজিব বর্ষের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রন পেয়ে যাওয়ার কথা!

সবশেষে এটুকু বলবো, কথায় কথায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিক্রি বন্ধ করুন, মুক্তিযুদ্ধকে আপনারা হাসিঠাট্টার পর্যায়ে টেনে নিয়ে এসেছেন। ভারত ও ভারতের জনগণের জন্য বাংলাদেশের মানুষের কোন অশ্রদ্ধা বা বিরোধ নেই, মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান স্বিকারে কোন কৃপণতা ও অস্বস্তি নেই। তবে দীর্ঘদিন ধরে সীমান্তে যেভাবে বাংলাদেশের নাগরিকেদের অকারনে হত্যা করছে ভারতের বিএসএফ, তাতে দিন দিন এদেশের মানুষ ক্ষুব্ধ। আর মোদি একজন সাম্প্রদায়িক উগ্রবাদী। তাই সারা দেশের মানুষের একটাই ভাবনা একজন দাঙ্গাবাজ সাম্প্রদায়িক নেতা কি করে ১৯৭১ এ অসাম্প্রদায়িকতার শপথে জন্ম নেয়া বাংলাদেশের কোন রাষ্ট্রিয় অনুষ্ঠানে আসে?


এটা কি বঙ্গবন্ধুর অসম্মান নয়?
এটা কি বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িকতার ইতিহাসে রাষ্ট্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় সাম্প্রদায়িকতার কালিমা লেপন নয়?

আর রাষ্ট্রিয় অনুষ্ঠানের মানে হল রাষ্ট্রের জনগনের অর্থ ব্যায়ে অনুষ্ঠান। অতএব সে অনুষ্ঠানে কে আসবে কে আসবেনা সেটাও এদেশের মানুষের মতামত অনুযায়ী ঠিক হবে কারো দলীয় সিদ্ধান্তে নয়। কারন এটি একটি রাষ্ট্রিয় অনুষ্ঠান আওয়ামীলীগের দলীয় কাউন্সিল নয়।

রাইহান, সম্পাদক, মুক্তিফোরাম।

Share.

আবু রাইহান মুক্তিফোরামের একজন সম্পাদক ও সংগঠক

Leave A Reply