হরতাল এর কথা মনে পরে গেলো সঙ্গত কারনেই।
হরতাল তার নিজস্বতা হারিয়েছে অনেক আগেই। এই হরতাল ছিল বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিবাদের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। কিন্তু যখন তখন অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে এই হাতিয়ারে আর আগের সেই ধার নেই। এখন আর কেউ হরতালের ডাক দেয় না বললেই চলে। এমনকি দিলেও আর শোনা যায় না আগের মত “সারাদেশে কঠোরভাবে পালিত হয়েছে অমুক দলের ডাকা হরতাল”। সর্বশেষ যেই হরতালের কর্মসূচী গুলো আমরা দেখেছি সবগুলোর সেই একই চিত্র “ঢিলেঢালা ভাবে পালিত হয়েছে সারাদেশে অমুক দলের ডাকা হরতাল, যানবাহন চলাচল কিছুটা কম থাকলেও জনজীবন স্বাভাবিক ছিলো”। এতে করে যেই উদ্দেশ্যে হরতালের ডাক দেয়া হতো তার কিছুই হতো না মাঝখান  থেকে দেশের অর্থনীতির ক্ষতি হতো। 

এইবার প্রসঙ্গে আসি, রষ্ট্র ঘোষিত ১০ দিনের সাধারন ছুটি যার উদ্দেশ্য হচ্ছে সামাজিক দুরত্ব কিংবা হোম কোয়ারেন্টাইন অথবা লকডাউন যাই বলেন না কেন এসব করে করোনা ভাইরাস কোভিড ১৯ এর সংক্রমন রোধ করা। সেই কাজটা আমরা কতটুকু করছি, কতটুকু করতে পারছি আর কতটুকুই বা করতে পারবো?

এই লকডাউন ফলে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, দিন আনা দিন খাওয়া, ভাসমান গৃহহীন, দরিদ্র মানুষ অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে, কৃষক তার উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য তো দুরের কথা নাম মাত্র মূল্যও পাচ্ছেন না এমনকি কেউ কিনছেনই না।

এতসব সংকট সমস্যা হবে কিংবা হচ্ছে জেনেও সাধারন ছুটির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তার কারন এর চাইতে বড় সংকট হচ্ছে করোনা ভাইরাস কোভিড ১৯। সেটা বিবেচনা করেই পুর্বঘোষিত সাধারন ছুটির মেয়াদ আরও বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজটা কি আসলেই হচ্ছে?

সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার নির্দেশনা আমরা কতটুকু পালন করছি? প্রথম দুই দিন মোটামুটি পালন করলাম, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীও অনেক তৎপর ছিলো।  কিন্তু হুট করে কি হলো, আইইডিসিয়ার পর পর দুইদিন জানালো দেশে তারা কোনো করোনা আক্রান্ত রোগী পায়নি! আর তারপরই শুরু হলো ঢিলেঢালা ভাব সবার মধ্যে। রাস্তা ঘাটে, হাট বাজারে মানুষের অবাধ যাতায়াত।  মনে হচ্ছে যে আমরা করোনা থেকে মুক্ত হয়ে গেছি। কতটা ভয়াবহ একটা ব্যাপার এই স্টেজে এটা চিন্তা করাটা।
অথচ এই লেখাটি যখন লিখছি তখনও মানবজমিন পত্রিকা রিপোর্ট করেছে –
“দেশের বিভিন্ন জেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে আরও ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ঢামেকে ২, বগুড়ায় ১, রাজশাহীতে ১, চট্টগ্রামে ১, সাতক্ষীরায় ১, ঝালকাঠির কাঁঠালিয়ায় ১, শরীয়তপুরে ১ ও নড়াইলে ১জন রয়েছেন। এর আগে গত ৩দিনে করোনার উপসর্গ নিয়ে ১৯ জন মারা যান।”

তাহলে আইইডিসিআর কি ভুল তথ্য দিচ্ছে?  না। হয়তো তারা তাদের জায়গা থেকে ঠিকই বলছে, কিন্তু তারা অন্যভাবে বললেও পারতেন। কিভাবে সেটা চলুন দেখি দ্যা ডেইলি স্টার এ প্রকাশিত জনাব গোলাম মোর্তজার কলামে-

“আইইডিসিআরের পরিচালক মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরার দেওয়া তথ্যানুযায়ী ৩০ মার্চ পর্যন্ত ৯ লাখ ৫৫ হাজার ৪২৫ জন ফোন করেছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় আইইডিসিআরে ফোন করেছেন ৪ হাজার ৭২৫ জন। অন্যান্য জায়গা মিলিয়ে মোট ফোন করেছেন ৭১ হাজার ২৬৬ জন। আইইডিসিআর নমুনা সংগ্রহ করেছে ১৫৩ জনের। একদিনে মোট ফোনকারীর ০.২১ শতাংশের নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করা হয়েছে। তার মধ্যে শনাক্ত হয়েছে একজন। ০.২১ শতাংশের পরীক্ষায় একজন আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে।
মোট প্রায় সাড়ে ৯ লাখ ফোনের থেকে আইইডিসিআর নমুনা সংগ্রহ করেছে ১,৩৩৮ জনের। শতকরা হিসাবে ১ শতাংশও নয়, ০.১৪ শতাংশের। মোট ফোনকারীর ০.১৪ শতাংশ মানুষের নমুনা পরীক্ষায় করোনা আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে ৪৯ জন।
সাড়ে ৯ লাখের মধ্যে ১,৩৩৮ জন মানে ০.১৪ শতাংশ নমুনা পরীক্ষা করে বলে দেওয়া যায় যে, দেশে আজ কেউ করোনায় আক্রান্ত হননি বা একজন আক্রান্ত হয়েছেন?
কথাটা হতে পারতো এমন যে, আমরা আজ ফোনকারীদের থেকে ০.২১ শতাংশের নমুনা পরীক্ষা করে ‘কোভিড ১৯’ আক্রান্ত একজনকে পেয়েছি। সারা দেশ তো আপনাদের পরীক্ষার আওতায় নেই। তাহলে সারা দেশে আক্রান্ত একজন বা আজ কেউ আক্রান্ত হননি, এমন কথা বলছেন কেন? প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন জায়গায় জ্বর-কাশি-শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত মানুষের সংবাদ আসছে। মারাও যাচ্ছে কেউ কেউ। তারা যে ‘কোভিড ১৯’ আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন, তা বলা যায় না। এও বলা যায় না যে তারা ‘কোভিড ১৯’ আক্রান্ত ছিলেন না। হ্যাঁ বা না তখনই বলা যেত, যদি তারা পরীক্ষার আওতায় আসতেন। তা তো করা হচ্ছে না।”

এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। এই বাস্তবতা আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। শুরুতে হরতাল নিয়ে কথা বলেছি সেটা মুলত এটা বোঝাতেই যে ঢিলেঢালা হরতালে যেমন হরতাল আহ্বানকারীদের উদ্দেশ্য সাধন হতো না ঠিক তেমনি এই সংকটময় মুহূর্তের সাধারণ ছুটিতে রাষ্ট্রের নির্দেশনা ঢিলেঢালা ভাবে পালন করে আসলে তাতে কোন উপকারই হবে না। এভাবে করোনা প্রতিরোধ করা কিংবা মহামারী ঠেকানো যাবে না।  বৃহত্তর স্বার্থে যে ক্ষুদ্রতম স্বার্থ ত্যাগ করা হলো সেই ত্যাগের কোন বিনিময় আমরা পাবো না এভাবে চলতে থাকলে। সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্যে দিনযাপন করা মানুষগুলোকে তাহলে কষ্ট দিয়ে লাভটা কি হচ্ছে? 

যদিও অনেকটা সময় চলে গেছে এখনো ভাবতে হবে আমাদের। রাষ্ট্রকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে, সঠিক চিত্র তুলে ধরে মানুষকে বোঝাতে হবে। কঠোর নির্দেশনা দিতে হবে, জনগণকে তা মানতে বাধ্য করতে হবে। ঢিলেঢালা নির্দেশনায় কাজ হবে না। যেমন ছুটি বাড়ানো সম্পর্কিত সর্বশেষ প্রজ্ঞাপনে ঢিলেঢালা ভাব পরিলক্ষিত হয়েছে, যেমন কোন কোন খাত এর আওতায় বাইরে থাকবে সেটা নির্দিষ্ট করে বলার পরেও আবার বলা হয়েছে “জরুরি প্রয়োজনে অফিসসমূহ খোলা রাখা যাবে”। জরুরি প্রয়োজনের তো কোন নির্দিষ্ট মাপকাঠি করে দেয়া হয়নি সেক্ষেত্রে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান গুলো তাদের কর্মীদের অফিসে ডাকার সুযোগ পেলো। কয়জন মালিক আছেন যারা চাইবেন তাদের কর্মীদের এভাবে বাসায় বসিয়ে বেতন দিতে? তাই এখানে কঠোর নির্দেশনা কাম্য।
প্রশাসন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও তৎপর হতে হবে, কঠোর হতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে যে কঠোর হওয়া মানেই যেখানে সেখানে যাকে তাকে এমনকি কাউকে লাঠিপেটা কিংবা কানে ধরানো নয়। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে।

সর্বোপরি আমাদের নিজেদের যার যার দায়িত্ব পালন করতে হবে। হ্যাঁ এই মূহুর্তে রাষ্ট্রের নির্দেশনা অনুযায়ী  সামাজিক দূরত্ব মেনে চলাই এখন আমাদের প্রধান এবং নৈতিক দায়িত্ব।
এছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই এই মহামারী ঠেকানোর।

এসম্পর্কে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদন নিয়ে দ্যা ডেইলি স্টার এর গতকালের রিপোর্টের চুম্বক অংশ দেখুন-

“সামাজিক সঙ্গ কমিয়ে না আনলে করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারিতে এ বছর বিশ্বের প্রায় ২ কোটি লোক মারা যেতে পারে। লন্ডনের ইমপেরিয়াল কলেজের গবেষকদের তৈরিকৃত গাণিতিক মডেল অনুসারে এ তথ্য জানিয়েছে সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট।
ওই মডেলে উল্লেখ করা হয়েছে, সবক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার উদ্যোগ না নিলে, ভাইরাসটি বিশ্বের ৪ কোটি লোকের প্রাণ কেড়ে নিতে পারে। তবে মানুষ তার সামাজিক সঙ্গ ৪০ শতাংশ এবং বৃদ্ধরা তাদের পারস্পরিক সংযোগ ৬০ শতাংশ কমানোর মাধ্যমে মৃত্যুর সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনতে পারে।
গবেষকরা বলছেন, যত আগ্রাসী উদ্যোগ নেওয়া হবে পরবর্তীতে মৃতের সংখ্যা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা তত বাড়বে। কত কঠোরভাবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারবে এবং কতদিন তা বলবৎ রাখতে পারবে, আগামী সপ্তাহ ও মাসগুলোতে সব সরকারকে এ ধরনের ‘চ্যালেঞ্জিং সিদ্ধান্তের’ মুখোমুখি হতে হবে বলেও সতর্ক করেছেন তারা।
গবেষকরা হিসাব করে দেখেছেন, আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগ ৭৫ শতাংশ কমিয়ে আনার মাধ্যমে আগেভাগেই যদি বৃহৎ পরিসরে সামাজিক দূরত্ব বজায়ের সিদ্ধান্ত দীর্ঘমেয়াদে বহাল রাখা যায়, তাহলে ৩ কোটি ৮৭ লাখ মানুষের প্রাণ বাঁচানো যেতে পারে।”

আমরা এখনো নিরাপদ নই।  মোট ফোনকারীর ০.১৪ শতাংশ মানুষের নমুনা পরীক্ষা করে আমরা নিজেদের নিরাপদ ভাবতে পারি না।
ক্ষুদ্রতম স্বার্থ ত্যাগ বিবেচনায় দুর্ভোগ পোহানো মানুষগুলোর কথা চিন্তা করে হলেও ঘরে থাকুন, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলুন।

Share.
Leave A Reply