দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের মানুষ অপেক্ষা করে রয়েছে তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা পাবার জন্যে।

যতবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভারতে বেড়াতে যান, ততবার আমরা মনে করি যে জনগণের পয়সা দিয়ে এবারে কেবলমাত্র একটি আনন্দ হিল্লোল ভ্রমণ না করে এবারে আমাদের অভিন্ন নদীগুলোর পানিবন্টন নিয়ে একটি হাল হবে। তেমনি আমরা এবারও আশা করেছিলাম যে কোন একটি সমাধান হবে এবং আমাদের
সমালোচকদের মুখে ছাই দিয়ে আমরা তাঁর সম্মানে একটি সম্পাদকীয় লিখবো।

কিন্তু তা হলোনা। কারণ তিস্তার পানি তো তিনি আনতে পারেনই নাই, বরং দিয়ে এসেছেন আমাদের ফেনী নদীর পানি।

সাক্ষরিত এমওইউ অনুযায়ী এখন থেকে ভারত ফেনী নদী থেকে ১.৮২ কিউসেক পানি প্রত্যাহার করতে পারবে। ত্রিপুরার সাব্রুম নগরের বাসিন্দারা যাতে পানের জন্যে যথেষ্ঠ পানি পায় সেই কারণে এই প্রত্যাহার চুক্তি সাক্ষর করা হয়েছে।

এমন সময়ে অবশ্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তিস্তার পানির কথা তোলেন। ২০১১ সাল থেকে ঝুলে থাকা এই চুক্তি আবার ঝুলিয়ে দেয়া হয় একই কথা বলে, প্রভাবগ্রস্থ অঞ্চলের সরকারের সম্মতি ছাড়া কেন্দ্র এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না।

এদিকে আমাদের প্রধানমন্ত্রী কিন্তু প্রভাবগ্রস্থ অঞ্চলের মানুষের কোন তোয়াক্কা না করেই সুন্দর পানিদান করে আসলেন। তিনি এটি করতে পারেন কেননা তিনি একটি একক রাষ্ট্রের একচ্ছত্র অধিপতি, যার আজকাল জনতার ভোটেরও দরকার পড়েনা। অপরদিকে মোদী তো মমতার স্বার্থের বাইরে যেতে পারেন না। আর মমতা যেতে পারেন না ভোটারের স্বার্থের বাইরে। শুধু এই “প্রজা”তন্ত্রের অধিপতি তাঁর “প্রজা”র স্বার্থের তোয়াক্কা না করে যা ইচ্ছে তাই করে বেড়াতে পারেন।

তিস্তার পানি আমরা আজও কেন পাইনি? তার একটা অন্যতম কারণ হল আমাদের কোন বার্গেইনিং চিপ না থাকা। এই ব্যাপারটা বোঝার জন্য বিরাট কূটনৈতিক তাত্ত্বিক হতে হয়না। যে কোন নেগোসিয়েশনের প্রথম শর্ত হল নিজের পক্ষে কিছু শক্তিশালী বিষয় রাখা যেগুলো অপর পক্ষ চায়। যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি সেগুলো ছেড়ে না দিচ্ছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত সেই পক্ষের আপনাকে তার স্বার্থের কিছু ত্যাগ করে কিছু দেবার সম্ভাবনা আছে।

কিন্তু বাংলাদেশের তেমন কিছু কি আছে? বাংলাদেশ ভারতের জন্যে কোন সামরিক হুমকি নয়। অর্থনৈতিকভাবে তারা যা চায় আমরা তাও দিয়ে দেই। কিছুদিন আমরা তাদেরকে ইলিশ মাছ বিক্রি করা বন্ধ রেখেছিলাম গোসসা করে, তাও ছেড়ে দিয়েছি–যদি তাদের মহানুভবতার উদয় হয়, তাই ভেবে। মহানুভবতার উদয় হয়নাই।

ট্রানজিট আমরা ধরে রাখতে পারতাম, ধরে রাখিনাই। ফেনী নদীর পানি ছিল সর্বশেষ চিপ, সেটাও আমরা মিস্টার টুইস্ট ঠাউরে এইবারে দিয়ে এসেছি। ভারত জানে যে সে হালুম করে উঠলেই সরকারের গদি নড়ে যাবে, কেননা এদের কোন রাজনৈতিক ম্যান্ডেট নাই।

সেই ভয়ে যতদিন সরকার থাকবে, ততদিন যতাযথভাবে নেগোশিয়েট করতেই পারবেনা ভারতের সাথে। পারবে না মায়ানমারের সাথেও কেননা মায়ানমারের পেছনেই রয়েছে ভারত।

যতদিন পর্যন্ত দেশে গণতান্ত্রিক ম্যান্ডেটের ভিত্তিতে গড়া সরকারকে ফিরিয়ে আনা না যাচ্ছে এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ আর আংশিক অথবা পূর্ণাঙ্গ আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসন নিশ্চিত করা যাচ্ছে–ততদিন সরকার জনগণের পক্ষে কাজ করবে, এমনটা ভাবার কোন অবকাশ নাই।

মুক্তিফোরামের পক্ষে এই সম্পাদকীয়টি রচনা করেছেন অনুপম দেবাশীষ রায়।

Share.

মুক্তিফোরাম একটি মুক্তিবাদী, বহুত্ববাদী এবং জনপন্থী সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে গড়ে ওঠা সংগঠিত গণমঞ্চ। এর লক্ষ্য হলো নতুন ধরণের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক চর্চা নির্মাণ। নোংরা হিসেবে রাজনীতির যে রূপকল্প এদেশের মানুষের কাছে নির্মাণ করা হয়েছে, সেটিকে চ্যালেঞ্জ করতে চায় মুক্তিফোরাম। আবার যেসব একক আদর্শ (যেমন বামপন্থা-ডানপন্থা) বা পরিচয়ের রাজনীতি (সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, জাতিবাদ) দিয়ে জনগণের সংহতি ও বৈচিত্র্য হুমকির মুখে ফেলা হয়েছে তার একটি এন্টিডোট হয়ে ওঠাও মুক্তিফোরামের প্রকল্প।

Leave A Reply