মুক্তিফোরামের বন্ধু ফটোসাংবাদিক জীবন আহমেদের তোলা ছবিতে দেখলাম একজন শিক্ষক একটি ব্যানার হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। তাতে লেখা, যে কলম ধরতে আমি শেখালাম, সে কলমের খোঁচায় আজ আমি কেন ৩য় শ্রেণীর কর্মচারী?

এই একটি বাক্যই রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের ব্যর্থতাকে পরিস্ফুটিত করে তোলে। যে প্রাথমিক শিক্ষকদের কাছে আমাদের প্রথম হাতেখড়ি, আমাদের রাষ্ট্র তাদেরকে একটি সম্মানজনক বেতনের ব্যবস্থা করে দিতে পারেনাই। অথচ বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতি সাম্য–অথবা কমপক্ষে সুযোগের সাম্য–প্রতিষ্ঠা করতে সবচেয়ে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখেন আমাদের শিক্ষকেরা। একটি রাষ্ট্রের যতগুলো দায়িত্ব রয়েছে, তার মাঝে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হচ্ছে সকলের জন্য মানসম্মত শিক্ষার বন্দোবস্ত করা। কিন্তু আমাদের শিক্ষকদের যদি আমরা মানসম্মত একটি বেতনের ব্যবস্থা করে না দেই, তাহলে আমরা কেমন করে আশা করতে পারি যে শিক্ষকতার মতন গুরুত্বপূর্ণ পেশাটিতে আমরা যোগ্য এবং উচ্চশিক্ষিত মানুষ পাবো? এমন অবস্থায় কি কখনো সকলের জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা যেতে পারে?

আমাদের দেশে শিক্ষাখাতে বিনিয়োগের দাবি উঠলেই আমাদেরকে ইটপাথরের উন্নয়ন দেখানো হয়। কতোগুলো দালান গড়ে তোলা হয়েছে তার হিসেব দেয়া হয়। মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্যে অবশ্যই দালানকোঠার দরকার রয়েছে, কিন্তু তারই সাথে দরকার রয়েছে মানসম্মত শিক্ষকের। আজকে আমরা শিক্ষকদের যথাযথ বেতন দিতে পারিনা বলেই তারা স্কুলের কাজের পাশাপাশি প্রাইভেট পড়াতে বাধ্য হন এবং অনেক সময়ে ক্লাসরুমে যথাযথ মনোযোগ দিতে পারেন না। যার ফলে বঞ্চিত হয়ে পড়ে প্রান্তিক শিক্ষার্থীরা যাদের প্রাইভেট পড়বার মতন সামর্থ্য নাই।

অথচ যে পয়সা আমাদের দেশে দালানকোঠা আর শিক্ষা সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ের বেদরকারি আমলাদের পেছনে ঢালা হয়, তার কিছুমাত্র যদি শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধিতে ব্যয় করা হতো, তবে তাতে লাভবান হতো আমাদের শিক্ষাখাতই। যে সময়টা ধরে শিক্ষকেরা বেতন বৃদ্ধির দাবি করছেন, তার মাঝে একাধিকবার আমলাদের বেতন বাড়ানো হয়েছে কিন্তু অঙ্গিকার করেও ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে শিক্ষকদের। এখন যদি আমরা বলি যে এই রাষ্ট্রযন্ত্র কেবল তাদেরই খেদমত করে যারা হয় তার ক্ষমতার জন্য দরকারি, অথবা হুমকি–তখন হয়তো আপনারা আমাদের চরমপন্থী বলবেন। তবে এটুকু আমরা বলবোই যে যারা রাষ্ট্রের শিক্ষাদানের মূল দায়িত্বটি পালন করেন, যুগোপযোগীভাবে তাদের বেতন বৃদ্ধিটি রাষ্ট্রের অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু সেটা করা হয়নাই, আর আমাদের শিক্ষকদের পথে নামতে হয়েছে। তাদেরকে লাঠির বাড়ি খেতে হয়েছে। যেই মানুষগুলো আমাদের জীবনের প্রথম অক্ষরগুলো শেখান, তারা একটি ন্যায্য দাবি করতে এসে যদি নিগ্রহের শিকার হন, তার চেয়ে বেশি দুর্ভাগ্যজনক আর কিইবা হতে পারে?

অথচ এই মর্মন্তুদ খবরটি আমাদের গণমাধ্যমে ঠিকমতন প্রচার করা হয়নাই। আমাদের জাতীয় সচেতনতাও এই কুৎসিত ট্রাজেডিকে এড়িয়ে গেছে। যে আঘাত আমাদের সকলের মর্মে লাগবার কথা, সেই আঘাত কেবলই আমাদের শিক্ষকদের শরীরে লেগেছে। যেই দাবিতে সারা দেশের সকল ছাত্রের, সকল জনতার একাত্ম হবার কথা, সেই দাবি করতে গিয়ে আমাদের শিক্ষকেরা একলা হয়ে পড়েছেন। এরচেয়ে দূর্ভাগ্যজনক আর কিইবা হতে পারে? কি দিয়ে আমরা আমাদের এই নির্লজ্জ নিশ্চুপতার লজ্জাকে ঢাকবো?

যেহেতু আমরা মুক্তিফোরামকে একটি মুক্তিবাদী, বহুত্ববাদী এবং, সর্বোপরী, জনপন্থী সংগঠন হিসেবে গড়ে তুলতে চাই, সেহেতু একলা হলেও আমরা আমাদের শিক্ষকদের উপরে পুলিশের এই নির্মম আঘাতের তীব্র প্রতিবাদ জানাই। যেই জনপদ গড়ে উঠেছে আমাদের প্রাথমিক শিক্ষকদের হাত ধরে, সেই জনপদের অংশ হিসেবে আমাদের শিক্ষকদের সাথে থাকার অঙ্গিকার জানাই আমরা। আমাদের শিক্ষকদের প্রতি আমাদের একান্ত সংহতি ও একরাশ শুভকামনা।

মুক্তিফোরামের পক্ষে এই সম্পাদকীয়টি রচনা করেছেন অনুপম দেবাশীষ রায়।

Share.

মুক্তিফোরাম একটি মুক্তিবাদী, বহুত্ববাদী এবং জনপন্থী সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে গড়ে ওঠা সংগঠিত গণমঞ্চ। এর লক্ষ্য হলো নতুন ধরণের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক চর্চা নির্মাণ। নোংরা হিসেবে রাজনীতির যে রূপকল্প এদেশের মানুষের কাছে নির্মাণ করা হয়েছে, সেটিকে চ্যালেঞ্জ করতে চায় মুক্তিফোরাম। আবার যেসব একক আদর্শ (যেমন বামপন্থা-ডানপন্থা) বা পরিচয়ের রাজনীতি (সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, জাতিবাদ) দিয়ে জনগণের সংহতি ও বৈচিত্র্য হুমকির মুখে ফেলা হয়েছে তার একটি এন্টিডোট হয়ে ওঠাও মুক্তিফোরামের প্রকল্প।

Leave A Reply