গৌতম আদানি নিয়ে আরও অনেকের মতো আমিও আগ্রহী। যেকোন দেশে রাজনৈতিক দানবদের বুঝতে হলে তাদের অর্থনৈতিক উৎস বোঝাও জরুরি।
মাত্র ছয় দিন আগেও আদানি বিশ্বের তৃতীয় ধনী ছিলেন। আজকে সপ্তম। ব্যবধানটা ৩ আর ৭ এর নয়। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের। আদানি সাম্রাজের আরও ক্ষয় ঘটবে। যা আবার আদানির রাজনৈতিক মুরুব্বিদেরও বিব্রত করছে।
চলমান এ কাজটি করছে ৫ জন গোড়াপত্তনকারীর একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। যার পেছনে মূল লোক নাথান অ্যান্ডারসান। এ কালের এক ডেইটা বিশ্লেষক।
নাথানের কাজ কর্পোরটদের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ। তথা কর্পোরেট কাজ-কারবারে তদন্ত চালানো। ইদানিং যাকে বলে ফরেনসিক ফিন্যানসিয়াল রিসার্চ।
নাথানের প্রতিষ্ঠান হিন্ডেনাবার্গের বয়স মাত্র ৫ বছর। কিন্তু ইতোমধ্যে আদানির মতো অনেক ঘুঘুর ঘুম কেড়ে নিয়েছে তারা। আদানি তাদের ১৭ তম টার্গেট হলেন মাত্র।
আগের দফায় নাথানের এক আলোচিত শিকার ছিল গাড়ি নির্মাতা নিকোলা। হিন্ডেনবার্গের গবেষণায় নিকোলার জালিয়াতি দেখানো হয়। তাতে শেষ পর্যন্ত নিকোলাকে ১২৫ মিলিয়ন খরচ করতে হয়েছে। বাড়তি বিপর্যয় ছিল এই–২০২০ এ নিকোলার সম্পদ মূল্য ছিল ৩৪ বিলিয়ন ডলার– পরে সেটা ২ বিলিয়নের নিচে নেমে আসে।
দক্ষিণ এশিয়ার দুর্ভাগ্যের দিক এখানে কর্পোরেট-গাল-গল্পের ফানুসগুলো চ্যালেঞ্জ করার মতো মানব সম্পদ কম। গবেষণা মেধাগুলো সেভাবে গড়ে উঠেনি। করপোরেটদের রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে ভিন্ন মতালম্বীদের কাজ করাও দুরূহ। সে কারণেই আদানির মতো চরিত্রগুলো অবিশ্বাস গতিতে এখানে ফুলেফেঁপে উঠতে পারে। এ অঞ্চলে আদানিদের তুলে ধরা হয় দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নের প্রতীক হিসেবে। কিন্তু নাথানের প্রতিবেদন দেখাচ্ছে কীভাবে এরা শেয়ার বাজারে জালিয়াতি, অস্বচ্ছ হিসাবপত্তর এবং অর্থ পাচারে যুক্ত।
গবেষণা তথ্য মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়ে গৌতম আদানি এখন বলছেন ‘হিন্ডেনবার্গ ভারতের উপর আক্রমণ করেছে।’ ব্যাপারটা যেন এই, আদানি নিজেই ভারত।
বাংলাদেশেও করপোরেটরা দেশের পরিচয়ের সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করে দেখাতে চেষ্টা করে। সে অনুযায়ী দেশপ্রেমমূলক নানান বিজ্ঞাপন তৈরি হয়। ভোক্তারা তাতে বিভ্রান্ত হয়। তাদের সূত্রে ‘কর্পোরেট গভরনেন্স’ বলে মুখরোচক দুটো শব্দ ইদানিং চালু হয়েছে। কিন্তু আমাদের কোন নাথান নেই। ফলে আমরা এখানকার বাজার সিণ্ডিকেটের আসল গভরনেন্স সম্পর্কে কিছু জানতে-বুঝতে পারি না।
আদানি গ্রুপ গত কয়দিন ধরে একের পর এক নাথানের প্রতিবেদনকে ‘মিথ্যা’ বলছে। কিন্তু নাথানের প্রতিবেদনের শেষে যে ৮৮টি প্রশ্ন রাখা হয়েছিল—তার সদুত্তর দিচ্ছে না তারা। উল্টো হিন্ডেনবার্গের বিরুদ্ধে মামলার ভয় দেখাচ্ছে।
বুদ্ধিমান নাথান, সঙ্গত কারণেই আদানির মামলার হুমকিকে দ্রুত স্বাগত জানিয়েছে। কারণ তাতে তাদের ১০৬ পাতার প্রতিবেদনটি নিয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ তৈরি হবে। সবচেয়ে বড় কথা ওরকম মামলায় আদালতের মাধ্যমে আদানিদের আরও অনেক গোপন নথিপত্র জনসম্মুখে আনতে বাধ্য করা যাবে। এভাবে আদানি গ্রুপের শেয়ার দর আরও পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ থেকে নাথানদের প্রতিষ্ঠান ব্যবসাও করবে। নাথান এবং তার হিন্ডেনবার্গও শেয়ার বাজারের ব্যবসায় যুক্ত।
হিন্ডেনবার্গ তাদের গবেষণা ফলকে সহযোগী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শেয়ার বাজারের বৃহৎ বিনিয়োগকারীদের বাজি ধরতে সাহায্য করে। ‘শর্ট সেলে’র মাধ্যমে এরা পতনশীল দরের কম্পানির শেয়ার থেকে লাভ করে। শর্ট সেল ব্যাপারটা আমাদের দেশের ক্যাপিটাল মার্কেটে ওভাবে চালু হয়নি এখনও। তবে সামনে হবে হয়তো। সাধারণভাবে এটা হলো উঠন্ত বাজারে শেয়ার ধার করে সেটা বিক্রি করে দিয়ে পতনমুখী বাজারে একই শেয়ার কিনে ধার শোধ করা। দক্ষ গবেষণা ছাড়া শর্ট সেলে লাভবান হওয়া কঠিন। নাথান সেখানে দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন।
আদানিদের প্রতিবেদন থেকেও হিন্ডেনবার্গের বিপুল আয় হবে বলেই ধারণা করা যায়। শেয়ার বাজার কেন্দ্রীক এই পাল্টাপাল্টির ভেতর দিয়ে আপাতত দক্ষিণ এশিয়ার সাধারণ মানুষের লাভ এটুকুই যে এটা আবারও ভালোভাবে জানা গেল— তথাকথিত সমৃদ্ধি আর উন্নয়নের প্রতীকদের ভেতর অনেক কিছুই লুকানো থাকে। গোপন করে রাখা হয়। এসব ধোঁকাবাজির উপর চলে অর্থনৈতিক ধাপ্পাবাজি।
আদানির বেলায়ও তাই ছিল। বড় আদানিদের আশেপাশের দেশের ছোট আদানিদের বেলায়ও তাই আছে।
[এ নিয়ে আলাপ চলতে থাকবে.. .. ..]