একটি সমাজে একজন বুদ্ধিজীবীর, একজন চিন্তকের দায়িত্ব কী, কর্তব্য কী? ১৯৬৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন ভিয়েতনাম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে এবং তার বিরুদ্ধে সারা দেশে ক্ষোভ-বিক্ষোভ চলছিলো সেই সময়, সেই সঙ্কটকালে একজন তরুণ লেখক বুদ্ধিজীবির দায়িত্ব বিষয়ে একটি লেখা লিখেছিলেন। লেখকের নাম নোয়াম চমস্কী।

তিনি লিখেছিলেন, “বুদ্ধিজীবির দায়িত্ব হলো ক্ষমতাসীনদের সামনে সত্য প্রকাশ করে দেয়া এবং তাদের মিথ্যাচারকে উন্মোচণ করা। আর তা করতে গিয়ে বুদ্ধিজীবীরা বিতর্কের পথ তৈরি করেন আর বিভিন্ন নীতির পথ গড়ে দেন।”চমস্কীর এই কথাগুলো যেমন ১৯৬৭ সালের জন্যে প্রাসঙ্গিক ছিলো, আজকের দিনেও ঠিক তেমনি ভাবেই প্রাসঙ্গিক। যেই দেশে যে সময়েই থাকুন না কেন।

একজন মানুষকে আমরা বুদ্ধিজীবী বলে বিবেচনা করবো কীনা তার একটা বড় মাপকাঠি হচ্ছে এটিই। যে মানুষ ক্ষমতাসীনদের কাছে তার আত্মাকে বিক্রি করে দেবেন, সত্যকে প্রকাশ করবেন না, ক্ষমতাসীনদের মিথ্যাচারকে উন্মোচিত করবেন না, উপরন্ত সেই মিথ্যাকেই সত্য বলে প্রতিপন্ন করতে চাইবেন তাঁকে আপনি বুদ্ধিজীবী কেন বলবেন? সেটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই হোক কি বাংলাদেশই হোক।

বুদ্ধিজীবীতা কোনো পেশা নয়, বুদ্ধিজীবিতা হচ্ছে একটা দায়িত্ব।চেক ভাষার অন্যতম লেখক এবং পরে যিনি চেক প্রজাতন্ত্রের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান হয়েছিলেন তার নাম ভাস্লাভ হাভেল। ভাস্লাভ হাভেল বুদ্ধিজীবির কাজ কি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বলেছেন, “বুদ্ধিজীবীদের উচিৎ সারাক্ষন উপদ্রব করা, দুনিয়ায় যে সব দুর্দশা আছে সেগুলোর স্বাক্ষ্য দেয়া, নিজের স্বাধীনতা বজায় সব ধরণের প্রকাশ্য এবং গোপণ চাপ ও কারসাজির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা। তাদের উচিত বিরাজমান ব্যবস্থা নিয়ে সংশয়ী হওয়া”।

হাভেলের এই কথাগুলো আমাদের মনে রাখা দরকার।আমরা এখন এক দুঃসময়ের মধ্যে বাস করছি। সারা পৃথিবী জুড়েই এখন গণতন্ত্রের দুর্দিন, স্বৈরাচারী শাসকদের উত্থান ঘটছে, সমাজে সহিষ্ণুতা কমছে, ভিন্নমত প্রকাশে বাধা বিঘ্ন আসছে। স্বাধীনভাবে কথা বলার জায়গা সীমিত হয়ে আসছে। এই দুঃসময়ে যে বুদ্ধিজীবী ক্ষমতাকে প্রশ্ন করলেন না, মিথ্যাকে উন্মোচিত করলেন না, গোপন চাপ বা কারসাজির কাছে মাথা নত করলেন তিনি বুদ্ধিজীবীর দায়িত্ব পালন করলেন না।

আজকের দিনে আপনার আমার চারপাশের কত জন চিন্তক, কত জন বুদ্ধিজীবী এই বিচারে তাঁদের দায়িত্ব পালন করছেন?

আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির পলিটিকস ও গভর্নমেন্ট ডিপার্টমেন্টের একজন ডিশটিংগুইশড প্রফেসর

Share.

মুক্তিফোরাম একটি মুক্তিবাদী, বহুত্ববাদী এবং জনপন্থী সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে গড়ে ওঠা সংগঠিত গণমঞ্চ। এর লক্ষ্য হলো নতুন ধরণের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক চর্চা নির্মাণ। নোংরা হিসেবে রাজনীতির যে রূপকল্প এদেশের মানুষের কাছে নির্মাণ করা হয়েছে, সেটিকে চ্যালেঞ্জ করতে চায় মুক্তিফোরাম। আবার যেসব একক আদর্শ (যেমন বামপন্থা-ডানপন্থা) বা পরিচয়ের রাজনীতি (সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, জাতিবাদ) দিয়ে জনগণের সংহতি ও বৈচিত্র্য হুমকির মুখে ফেলা হয়েছে তার একটি এন্টিডোট হয়ে ওঠাও মুক্তিফোরামের প্রকল্প।

Leave A Reply