আজকের দিনটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে চিহ্নিত হওয়া দরকার। পৃথিবীর সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে এক অভুতপূর্ব ঘটনার স্বাক্ষী হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে বাংলাদেশের নাগরিকদের। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ক্ষমতাসীন দলের ঘনিষ্ঠ দল জাতীয় পার্টির দুই জন সদস্য – কাজী ফিরোজ রশীদ এবং মুজিবুল হক ধর্ষনকারীদের বিচারবহির্ভূতভাবে ‘ক্রসফায়ারে’ মেরে ফেলার দাবি জানিয়েছেন। পৃথিবীর কোনো দেশে আইন প্রনেতারাই সংসদের অধিবেশনে আনুষ্ঠানিকভাবে আইনের প্রতি এত বড় অবজ্ঞা দেখিয়েছেন বলে আমার জানা নেই। সংবিধানের প্রতি এবং আইনানুগ বিচারের প্রতি একে এক হুমকি ছাড়া আর কিছু বলার অবকাশ নেই। তাঁদের এই বক্তব্যে সমর্থন দিয়েছেন সরকারী দলের দুইজন – এদের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা (তোফায়েল আহমেদ)। অন্য যে সংসদ সদস্য এই বক্তব্যের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন তিনি তরিকত ফেডারেশনের নেতা নজিবুল বশর মাইজভান্ডারি। তিনি বলেছেন “আমি টুপি দাঁড়ি মাথায় নিয়ে আল্লাহকে হাজির নাজির জেনে বলছি, এদের ক্রসফায়ার করলে বেহেস্তে যাওয়া যাবে কোনো অসুবিধা নাই” (বিডিনিউজ২৪)। বাংলাদেশের সংবিধানে স্পষ্ট করেই বলা আছে যে “সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী” (২৭ অনুচ্ছেদ); বলা হয়েছে যে, “আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহারলাভ যে কোন স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষতঃ আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে’ (অনুচ্ছেদ ৩১)। “আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না (অনুচ্ছেদ ৩২)।
এই সংবিধানকে সমুন্নত রাখাই হচ্ছে সংসদ সদস্যদের কাজ। তার শপথ গ্রহনের সময়ে বলেছেন, “”আমি…., সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইয়া সশ্রদ্ধচিত্তে শপথ (বা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা) করিতেছি যে, আমি যে কতর্ব্যভার গ্রহণ করিতে যাইতেছি, তাহা আইন-অনুযায়ী ও বিশ্বস্ততার সহিত পালন করিব।” আইন অনুযায়ী দায়িত্ব পালনের অঙ্গিকারাবদ্ধ সংসদ সদস্যরা এখন বিচার বহির্ভূত হত্যার জন্যে বলছেন। শুধু তাই নয়, তারা জানেন যে, দেশে বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যা অব্যাহত আছে – জাপার সদস্য এই বক্তব্য যখন দিচ্ছিলেন “এ সময় কাজী ফিরোজের পাশ থেকে একজন সাংসদ আইন করার কথা বলেন। ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘আইন লাগে না। পুলিশের আইন আছে তো। মাদকের আসামি পরশুদিনও মারা হয়েছে, কোন আইনে মারা হয়েছে?” (প্রথম আলো)। ক্রসফায়ার / এনকাউন্টার যে কেবলি গল্প তা সকলের জানা। তার পরেও তা প্রেস নোট আকারে দেয়া হয় প্রায় প্রতিদিন। সরকার সমর্থকরা, যাদের মধ্যে কথিত সাংবাদিকরাও আছেন, তারা কথায় কথায় কাকে ক্রসফায়ারে দিতে হবে তার তালিকা দিয়ে থাকেন, অথচ এরাই আবার দেশে বিচার বহির্ভূত হত্যা আছে এমন কথা শুনতে রাজি নন।
দেশে ক্রসফায়ারের পক্ষে ২০১৪ সালেই বলেছিলেন তৎকালীন মন্ত্রী শাহজাহান খান। বিবিসির বাংলাদেশ সংলাপে তিনি বলেছিলেন ‘ক্রসফায়ার গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে’। ২০১৫ সালে এসে তিনি এর পক্ষে সাফাই গিয়েছিলেন (বিবিসি বাংলা ২২ আগস্ট ২০১৫)। অনেকের মনে থাকবে, যে, ক্রসফায়ার বিষয়ে আদালত কী বলেছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড (ক্রসফায়ার) কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না এবং কেন এ ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও ফৌজদারি কার্যক্রম গ্রহণের আদেশ দেয়া হবে না এই মর্মে গত ২৯ জুন ২০০৯ তারিখে চার সপ্তাহের মধ্যে জবাব প্রদানের জন্য সরকারের প্রতি রুল জারি করেছিলো হাইকোর্ট। ওই একই বছরে, ১১ নভেম্বর হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটি আদেশ দেন। র‌্যাবের সঙ্গে কথিত ক্রসফায়ারে মাদারীপুরে দুই ভাইয়ের নিহত হওয়ার ঘটনাকে কেন আইনবহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না ৪৮ ঘন্টার মধ্যে তা জানতে চেয়ে সরকার ও র‌্যাবের প্রতি রুল জারি করেন হাইকোর্ট। দেশে আইনের শাসনের অনুপস্থিতি বিষয়ে বিস্তারিত বলার দরকার নেই। এখন আইন-প্রণেতারাই কার্যত বলছেন আইনের দরকার নেই, আদালতের দরকার নেই। যখন জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা থাকে না, যখন কোথাও জবাবদিহি থাকে না তখন আইনও থাকেনা, সংবিধান কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় এই হচ্ছে তার উদাহরণ। কিন্ত এটি উদাহরণ মাত্র। বাস্তবে যা ঘটছে তা আরো ভয়াবহ।

Ali Riaz, Distinguished Professor, Department of Politics and Government at Illinois State University, USA এর ফেসবুক পোষ্ট হতে নেয়া

Share.

মুক্তিফোরাম একটি মুক্তিবাদী, বহুত্ববাদী এবং জনপন্থী সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে গড়ে ওঠা সংগঠিত গণমঞ্চ। এর লক্ষ্য হলো নতুন ধরণের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক চর্চা নির্মাণ। নোংরা হিসেবে রাজনীতির যে রূপকল্প এদেশের মানুষের কাছে নির্মাণ করা হয়েছে, সেটিকে চ্যালেঞ্জ করতে চায় মুক্তিফোরাম। আবার যেসব একক আদর্শ (যেমন বামপন্থা-ডানপন্থা) বা পরিচয়ের রাজনীতি (সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, জাতিবাদ) দিয়ে জনগণের সংহতি ও বৈচিত্র্য হুমকির মুখে ফেলা হয়েছে তার একটি এন্টিডোট হয়ে ওঠাও মুক্তিফোরামের প্রকল্প।

Leave A Reply