মুজিব বর্ষে বাড়ি রঙ করার নির্দেশনা আসছে। দেখবেন আরও বহুত কিছু আসবে। পুরা একটা বছর শেখ মুজিবকে উসিলা করে এমন ভাবে আওয়ামী লীগের বেসাতি বসবে যে আপনি ভুইলাই যাবেন যে শেখ মুজিব একজন মানুষ ছিলেন, আপনার মনে হইতে পারে যে তিনি আসলে একটা দলের মাসকট।

বিষয়টা একটু জটিল—কেনো বলি…এইযে আমি কথাটা বললাম, এটা চোখে লাগছে, কারণ মনে হইতে পারে যে মুজিব বর্ষ তো আসলে সবার। কোন দলের না। সব মানুষের…কারণ মুজিব তো সবারই নেতা। তাই তার জন্মবার্ষিকী পালন হচ্ছে জাতির উৎসব।
মনে হইতে পারে৷ কিন্তু সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলা খেয়াল কইরেন। শাহবাগ মোড়ের বিগ স্ক্রিনে মুজিবের কোন ভাষনগুলা বেশি বাজে, খেয়াল কইরেন।

বেসিকালি একটা প্রডাক্ট যখন বাজারে কম চলে, তখন মার্কেটিং এক্সপার্টরা সেই প্রডাক্টকে “রিব্র‍্যান্ড” করে। এই রিব্র‍্যান্ডিং করার জন্য নতুন মোড়ক তৈরি হয়…তার ওপরে লেখা থাকে “নিউ এন্ড ইম্প্রুভড”. মুজিব বর্ষ হচ্ছে আওয়ামী লীগের সেই রিব্র‍্যান্ডিং।

খেয়াল করে দেখবেন, আঠারো সালের ধাক্কার পরের থেকে আওয়ামী লীগ টানা তাদের এই রিব্র‍্যান্ডিং করে যাচ্ছে। শুদ্ধি অভিযানের নামে ইমেজ পরিস্কার কচ্ছে, দলে অনুগতদের একক আধিপত্য স্থাপন করছে যাতে বেলাইন কাজ কম হয়। বিভিন্ন সহযোগি বা অঙ্গ সংগঠনের নেতৃত্বে বদল আসছে। ছাত্রলীগ সুশীল হচ্ছে। কেনো হচ্ছে এইসব?

যখন সত্যিকারের গণতন্ত্র থাকেনা, তখন দলের ভেতরে রদবদল করে পরিবর্তনের আভাস দেয়া লাগে স্বৈরতন্ত্রকে টিকায়ে রাখার জন্যে। এটাই ডিকটেটরিয়াল সাইন্স।

আর এই মুজিব বর্ষকে ঘিরে যে পরিমানে হাইপ বিল্ড করা হচ্ছে, চারদিকে ঘড়ি–একটা একক কনসার্টেড লোগো, একের পরে এক ইভেন্ট–এগুলা কোন চাট্টিখানি কথা না। বাংলাদেশের সবচেয়ে মেধাবি মার্কেটিং মাইন্ডগুলার কিছু কাজ করছে এই রিব্র‍্যান্ডিং এর প্রজেক্টে। যেহেতু মুজিব একটা সম্মানের জায়গায় আছেন, তাই একই সাথে তার সম্মান বাড়ায়ে তুলে আওয়ামী লীগকে তার সাথে ট্যাগ করে আওয়ামী লীগের সম্মান বাড়ানো হবে….কিন্তু এইটা করা হবে সাটলি, যাতে কেউ একদম সরাসরি টের না পায় যে এটা ন্যাক্কারজনক আওয়ামী প্রচারণা। কমপক্ষে যে তরুণরা আঠারোতে আওয়ামী বিরোধী হয়ে গেছিলো, যারা কথায় কথায় মুজিব মুজিব করা ছেড়ে দিসিলো, তাদের জবানেও যাতে মুজিব ফিরায়ে আনা যায়। মুজিব ছাড়া কোন কল্পনাও যাতে আর না আসে।

তাই এখন তরুণরা ভাবতেসে, মুজিব বর্ষের মতন পবিত্র প্রহরে খুনি মোদিকে চাই না! কিন্তু খুনি মোদিকে চাই না বলতে কি মুজিব বর্ষ লাগে নাকি? তারে তো আমরা এমনেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসাবে চাই না কখনো! নাকি চাই?

এইযে কল্পনায় মুজিবের সর্বপ্রসার, এটা আবার আওয়ামী লীগেরই ডালপালা ছড়ায়। কারণ মুজিবকে আওয়ামী লীগের পৈত্রিক সম্পত্তি লীগই বানাইসে। জয় আসার পরে আরো মনোযোগ দিয়ে বানাইসে। মুখে বলসে মুজিব সবার, কিন্তু কাজে করসে মুজিব আমার। মুজিব যদি সবারই হয়, তাইলে তো মুজিব নিয়ে সবার কথা বলতে পারার কথা! কিন্তু আমি আমার মতন মুজিব ব্যাখ্যা করলে দেখা যাবে ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্টের খপ্পরে পরতেসি। তাইলে মুজিব সবার হইলো কেম্নে?

আবার বলবেন এটা তো লাগেই কারণ মুজিববমানননা মেনে নেয়া যায় না। কিন্তু আপনার এই অবমানননার মানদন্ড ঠিক করে কে? বিচার করে কে? আইন বানায় কে?

এক জাতি, এক রাজ্য, এক নেত্রী। আইন ভোল্ক, আইন রাইখ, আইন ফিউরার। সুপ্রিম লিডার শেখ হাসিনা।

তাহলে মুজিব কার? মুজিব বর্ষ এককভাবে যে ঘোষণা করে–তার, আর কারুরই না, কারণ আর কারো কোন মত নেয়া হয়নাই। এই যে আমরা ভাবতেসি, যে কেউ তো দ্বিমত দিতো না–এটাই স্বৈরতন্ত্রের সাফল্য। দ্বিমত মানে শুধু বিরুদ্ধমত না, ভিন্নমতও। কিভাবে আয়োজন করা যায়, ক্যামনে কি–সেটা নিয়ে সব গোষ্ঠীকে এক করে অংশীজনত্ব নিশ্চয়তা দেয়া হয়নাই, হবেনা। সংসদ কার্যকর না হইলে সকল সরকারি প্রোগ্রামই আসলে দলীয় প্রোগ্রাম। সেটাকে জাতীয় ভাবার কোন ফুরসত নাই। তাই সেখানে সেই দল ক্ষমতায় থাকবার জন্যে যারে আনা দরকার তারে আনবে। মোদিরেও আনবে এইজন্যেই। কারণ এই মুজিব বর্ষের সাথে আমাদের কোনই সম্পর্ক নাই, সম্পর্ক আছে আওয়ামী লীগের ক্ষমতার ওপরে জেকে বসার সরাসরি সম্পর্ক। তাই মোদিরে ঠেকাইতে গেলে আমাদের মানুষকে বুঝাইতে হবে আওয়ামী লীগের এই গ্রান্ড স্ট্র‍্যাটেজি। প্রমাণ করতে হবে যে তারা মোদির আশির্বাদে ক্ষমতায় থাকতে পারবেনা বেশিদিন।

তার চেয়ে বেশি করে মানুষকে বুঝাইতে হবে মুজিব বর্ষের সূক্ষ্ম প্রপাগান্ডাটা। মুজিবের প্রতি আমার প্রচুর সম্মান আছে, এবং এই যে এইটা আমার বলে নিতে হচ্ছে–এটার রাজনীতিটাও বুঝতে হবে। আঠারো সালে যে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনটা ঘটে এই স্বৈরশাসনের সাজানো রাজপ্রাসাদ এলোমেলো করে দিয়েছিলো, এখন আবার সেটারে গোছানো হইতেসে। সেটা আমাদের দেখতে হবে, বুঝতে হবে, আর সেভাবে পরিকল্পনা করতে হবে। হয়তো আমাদের ওদের মতন অগাধ টাকা পয়সা নাই ট্যালেন্ট ভাড়া করার। কিন্তু জিগরা তো আছে। সুষ্ঠু পরিকল্পনা নিয়ে আগাইলে কাজ করার মতন মেধাবী মানুষের অভাব নাই দেশে।

পাবো সবাইকে–সেই আশা রাখি।
সূর্যের দিন আসবেই।

অনুপম দেবাশীষ রায় মুক্তিফোরামের একজন সংগঠন ও সম্পাদক

Share.

মুক্তিফোরাম একটি মুক্তিবাদী, বহুত্ববাদী এবং জনপন্থী সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে গড়ে ওঠা সংগঠিত গণমঞ্চ। এর লক্ষ্য হলো নতুন ধরণের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক চর্চা নির্মাণ। নোংরা হিসেবে রাজনীতির যে রূপকল্প এদেশের মানুষের কাছে নির্মাণ করা হয়েছে, সেটিকে চ্যালেঞ্জ করতে চায় মুক্তিফোরাম। আবার যেসব একক আদর্শ (যেমন বামপন্থা-ডানপন্থা) বা পরিচয়ের রাজনীতি (সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, জাতিবাদ) দিয়ে জনগণের সংহতি ও বৈচিত্র্য হুমকির মুখে ফেলা হয়েছে তার একটি এন্টিডোট হয়ে ওঠাও মুক্তিফোরামের প্রকল্প।

Leave A Reply