Photo: LATIF HOSSAIN

উৎসর্গ
অধ্যাপক রাশেদ উজ জামান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে আমার শিক্ষক, যিনি তাঁর কোর্সে, আমাদেরকে অ্যাসেমোগলু আর রবিনসনের লেখা বইটি পড়িয়েছিলেন

নির্বাচনের আগে নৌকা মার্কার পক্ষেবিপক্ষে পোল করেছিলাম। তাতে পক্ষে পড়েছিলো ১০% ভোট, বিপক্ষে ৯০%। এই ৯০% কোনো বিশেষ পার্টির সমর্থক না, এঁদের ভেতরে বাম-ডান-মধ্যপন্থী সবাই আছেন, নানা ইস্যুতে তাঁদের মতপার্থক্য প্রচুর।

কিন্তু এঁরা একটা জায়গায় এক, আর সেটা হচ্ছে নৌকা মার্কার বিপক্ষে অবস্থান নেয়া। যদিও এই ধরণের ফেসবুক পোলের সীমাবদ্ধতা থাকে, একটা পোল থেকে ডেফেনিটিভ সিদ্ধান্ত টানা ভুল, তা পদ্ধতিগতভাবে ত্রুটিকর। তথাপি আমি এই পোলটাকে যথার্থ মনে করি।

কারণ আমার আগে আরো অনেক ইন্ডিপেন্ডেন্ট লোককে সিমিলার পোল করতে দেখেছি ফেসবুকে, সব ক্ষেত্রে রেশিওটা এরকমই ছিলো। মানে যেটা দাঁড়াচ্ছে, আওয়ামি লিগ ১০ শতাংশের সরকারে পরিণত হয়েছে, বাকি ৯০ শতাংশ তাঁদেরকে ট্রাস্ট করে না। জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের নৈতিক সমর্থন তারা হারিয়েছে।

এমআইটির অর্থনীতির অধ্যাপক দারোন অ্যাসেমোগলু আর হার্ভার্ডের রাজনীতিবিজ্ঞানের অধ্যাপক জেমস এ. রবিনসন যৌথভাবে তাঁদের দেড় দশকের গবেষণার ভিত্তিতে ২০১২য় Why Nations Fail: The Origins of Power, Prosperity and Poverty নামে একটি বই লেখেন।

এই বইয়ে তাঁরা একটি তত্ত্ব পেশ করেন। এই তত্ত্ব অনুসারে, কিছু জাতি ধনী আর কিছু জাতি গরিব, এই বৈষম্যের পেছনে রয়েছে তাদের প্রতিষ্ঠানসমূহের পার্থক্য। এই পার্থক্য ঐতিহাসিকভাবে নির্মিত, কিন্তু নির্ধারিত নয়।

তাঁরা যাবতীয় প্রতিষ্ঠানকে দুটি ভাগে ভাগ করেন। এগুলো হচ্ছে – ক্ষমতা বিতরণ করা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান আর সম্পদ বিতরণ করা অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান আবার চরিত্রগতভাবে দুই ভাগে বিভক্ত, যথাক্রমে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান আর নিষ্কাশনমূলক প্রতিষ্ঠান।

যেসব প্রতিষ্ঠান সমাজের বৃহত্তর অংশে ক্ষমতা ও সম্পদ বিতরণ করে সেগুলো অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান।

যেসব প্রতিষ্ঠান একটা গোষ্ঠীর হাতে ক্ষমতা ও সম্পদ কেন্দ্রীভূত করে সেগুলো নিষ্কাশনমূলক প্রতিষ্ঠান।

একটা শাদা কাগজে মনে মনে গ্রাফ আঁকলে আপনি এখানে চার ধরণের প্রতিষ্ঠান পাবেনঃ

ক. অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান (Inclusive Economic Institutions)

খ. নিষ্কাশনমূলক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান (Extractive Economic Institutions)

গ. অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান (Inclusive Political Institutions)

ঘ. নিষ্কাশনমূলক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান (Extractive Political Institutions)

তাঁদের তত্ত্ব মতে; ভৌগলিক অবস্থান, সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য, বা শাসকদের অজ্ঞতা নয়; ধনী দেশ আর গরিব দেশের মধ্যকার ফারাকটা তৈরি করে প্রতিষ্ঠান।

অ্যাসেমোগলু আর রবিনসন মনে করেন, একটা সময় পর্যন্ত দুনিয়ার সর্বত্রই প্রতিষ্ঠানগুলো নিষ্কাশনমূলক ছিলো। ১৬৮৮র মহিমান্বিত বিপ্লব প্রথমবারের মতো রাজার ক্ষমতা কমিয়ে ও সংসদের ক্ষমতা বাড়িয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠানের বীজ বপন করে। এর পথ ধরেই পরবর্তী শতকগুলোতে এসেছে শিল্প বিপ্লব, ফরাশি বিপ্লব, ও আমেরিকান বিপ্লব।

নিষ্কাশনমূলক প্রতিষ্ঠানের অধীনে কিছু পরিমাণে অর্থনৈতিক বিকাশ সম্ভব। কিন্তু সেটার সুফল ভোগ করে ছোট একটা শাসক গোষ্ঠী ও তাঁদের সাথে গুড টার্মসে থাকা ধনিক গোষ্ঠী। এবং এই বিকাশ দীর্ঘমেয়াদে টেকসই হয় না।

দুনিয়ায় এতো জায়গা থাকতে ১৬৮৮র যুক্তরাজ্যেই কেনো বীজ আকারে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান দেখা দিলো? চতুর্দশ শতাব্দীতে ইওরোপে যে সামন্ত সমাজব্যবস্থা ছিলো, ১৩৪৬র ব্ল্যাক ডেথ পশ্চিম ইওরোপে তার ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয়। ফলে পশ্চিম ইওরোপে ধীরে বণিকশ্রেণীর বিকাশ ঘটে, যারা একসময় গিয়ে রাজতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করে। পূর্ব ইওরোপে ঘটেছে ঠিক এর উল্টো ঘটনা। সেখানে একই সময়কালে দেখা দিয়েছে সেকেন্ড সার্ফডম। আজকে পূর্ব ইওরোপকে মনে হয় ইওরোপের তৃতীয়বিশ্ব, পশ্চিমের সাথে তুলনাই চলে না তার। ইতিহাসের বিশেষ বিশেষ সন্ধিস্থলে কিছু ঘটনা ভিন্নভাবে ঘটলে এটা নাও ঘটতে পারতো, অর্থাৎ এটা অবশ্যম্ভাবী ছিলো না।

এই সন্ধিস্থলগুলোকে অ্যাসেমোগলু আর রবিনসন ক্রিটিকাল জাঙ্কচার বলেন, যে-সময় কিছু স্মল ডিফরেন্স বিভিন্ন মহাদেশের বা একই মহাদেশের বিভিন্ন দেশের রাজনীতি-অর্থনীতির যাত্রাপথটি দীর্ঘ সময়ের জন্য আলাদা করে দেয়।

আরেকটা উদাহরণ তাঁরা টেনেছেন দুই আমেরিকার ক্ষেত্রে। আজকে পেরু গরিব দেশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ধনী। এটা পুরোপুরি ইওরোপিয়ান উপনিবেশবাদের অবদান, আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গদের আগমনের আগে আজকের পেরু যেখানে অবস্থিত সেখানকার ইনকারা ছিলো ধনী, আর আজকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেখানে অবস্থিত সেখানকার আদিবাসীরা ছিলো গরিব।

অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অন্তর্ভুক্তিমূলক করে। নিষ্কাশনমূলক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিষ্কাশনমূলক করে। তবে ধীরে ধীরে।

প্রথম প্রক্রিয়ার টেক্সটবুক এগজাম্পল হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে কোরিয়া বিভক্ত হলে দক্ষিণ কোরিয়ায় একটা সামরিক একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় যারা রাজনৈতিকভাবে নিষ্কাশনমূলক ছিলো। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতিকে এরা অন্তর্ভুক্তিমূলক করে। এভাবে তারা নিজেদের ক্ষমতাকে নিজেরাই সীমিত করে। কারণ অর্থনীতি অন্তর্ভুক্তিমূলক হলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে, জীবনমান বৃদ্ধি পায়, এবং অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার মতো প্রাথমিক প্রয়োজনগুলো পূরণ হওয়ায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য লড়াই করার আগ্রহ জন্মায়। আজকে দক্ষিণ কোরিয়া একটি সফল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। তার নাগরিকদের জীবনমান পশ্চিমা দেশগুলোর নাগরিকদের সমতুল্য।

উত্তর কোরিয়া হচ্ছে দ্বিতীয় প্রক্রিয়ার টেক্সটবুক এগজাম্পল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে কোরিয়া বিভক্ত হলে উত্তর কোরিয়ায় ফ্যাসিবিরোধী প্রতিরোধযুদ্ধের পার্টিজান কিম ইল সুং এমন একটি ব্যবস্থার সুপ্রীম লিডার হন যা দক্ষিণ কোরিয়ার মতোই রাজনৈতিকভাবে নিষ্কাশনমূলক ছিলো। কিন্তু আনলাইক দক্ষিণ কোরিয়া, উত্তর কোরিয়ার অর্থনীতিকেও নিষ্কাশনমূলক করে তোলা হয়, সমাজতন্ত্রের ধোঁয়া তুলে সব ক্ষমতা ও সম্পদ কিম পরিবার ও তাঁদের প্রতি অনুগতদের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়। সব ধরণের রাজনৈতিক ভিন্নমত দমন করা হয়। সবকিছুর ওপরে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। আজকে উত্তর কোরিয়া একটা চরম স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র। তার নাগরিকদের জীবনমান আফ্রিকার দেশগুলোর নাগরিকদের সমতুল্য।

চিনকে তাঁরা দেখেছেন একটা বিশেষ ব্যতিক্রম হিশেবে। চিনে আপাতদৃষ্টিতে নিষ্কাশনমূলক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান আর অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান টিকে গেছে, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো গণতন্ত্রায়ন ঘটে নি, এবং খোদ পশ্চিমেই অনেকে চিনা মডেলের ক্রনি পুঁজিবাদকে বিকল্প ভাবেন। অ্যাসেমোগলু আর রবিনসন মনে করেন এই ভাবনাটা ভুল। কারণ ১৯২০এর দশক থেকে ১৯৭০এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের নিষ্কাশনমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর আওতায় হওয়া বিস্ময়কর অর্থনৈতিক বিকাশ দেখেও পশ্চিমে এমন অনুমান করতেন অনেকেই। সেই সোভিয়েত ইউনিয়নে ১৯৭০এর দশকেই বিকাশ থেমে গেছে এবং বছর বিশেকের মধ্যে রাষ্ট্রটি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়েছে। চিনের ক্ষেত্রেও ভবিষ্যতে তেমনটা হবে না সেটা নিশ্চয়তা দিয়ে কেউ বলতে পারে না। তবে তিয়েনআনমেন স্কয়ারে গণতন্ত্রের যে ঢেউটুকু উঠেই থেমে গেছিলো, সেরকম একটা দ্বিতীয় ঢেউ উঠলে এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মতো গণতন্ত্রায়ন ঘটলে, চিন সোভিয়েত ইউনিয়নের শোচনীয় ভাগ্যটা এড়াতে পারবে।

যেসব রাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিষ্কাশনমূলক, সেসব রাষ্ট্রের এলিটরা সবচে বেশি কিসের ভয় পায়? শামপিটার যেই প্রক্রিয়াকে ক্রিয়েটিভ ডেসট্রাকশন* বলেন, তাকে! এর একটা চমৎকার উদাহরণ হচ্ছে গুটেনবার্গের মুদ্রণালয়ের ব্যাপারে অটোমান তুরস্কের শাসকদের নীতি।

১৪৪৫এ জার্মানি মেইঞ্জে আবিষ্কৃত হওয়ার তিন দশকের মধ্যে জোহানেস গুটেনবার্গের যুগান্তকারী আবিষ্কার মুদ্রণালয় পৌঁছে যায় ফ্রান্সের স্ট্রাসবুর্গে, ইতালির রোম, ভেনিস, ফ্লোরেন্স, মিলান, ও তুরিনে, ইংল্যান্ডের লন্ডন ও অক্সফোর্ডে, হাঙেরির বুদাপেস্টে, ও পোল্যাণ্ডের ক্রাকাওয়ে। কিন্তু সবাই এই আবিষ্কারকে ইতিবাচকভাবে নেয় নি। ১৪৮৫তে অটোমান সুলতান দ্বিতীয় বায়েজিদ একটা ফরমান জারি করেন, যাতে, মুসলমানদের জন্য আরবিতে কিছু মুদ্রণ করা স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ১৫১৫তে সুলতান প্রথম সেলিম ফরমানটাকে পুনঃবলবৎ করেন। ১৭২৭এর আগে অটোমান শাসনাধীন ভূখণ্ডগুলোতে মুদ্রণালয় প্রবেশাধিকার পায় নি, সে-বছর সুলতান তৃতীয় আহমেদ একটা ডিক্রি জারি করে ইব্রাহিম মুতেফেরিকাকে ছাপাখানা বসানোর অনুমতি দেন। কিন্তু এমনকি এই অনুমতিও অবাধ ছিলো না। তা ছিলো নিয়ন্ত্রিত।

ডিক্রিতে বলা হল, ছাপানো বইগুলো প্রকাশিত হওয়ার আগে, পড়ে দেখবেন ইস্তানবুল, সেলানিকি, আর গালাতার তিনজন শ্রদ্ধেয় কাজী। এই ধর্মীয়-আইনী বিশেষজ্ঞরা বইয়ের বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করবেন। বিশ্লেষণ শেষে যদি তাঁদের মনে হয় বইটিতে আপত্তিকর কিছু নেই, তাহলেই কেবল, তা প্রকাশের জন্য ছাড়পত্র পাবে। ১৭২৯এ মুদ্রণালয় চালু হওয়ার পর থেকে ১৭৪৩এ মুতেফেরিকা অবসরে যাওয়া পর্যন্ত মাত্র সতেরোটা বই ছাপা সম্ভব হয়েছিলো। তাঁর পরিবার ব্যবসাটা চালিয়ে গেছিলো ১৭৯৭ পর্যন্ত। পাঁচ দশকে সাতটা বই ছাপতে পেরেছিলো তাঁরা। এরপর তাঁরা হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেয়।

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ পর্যন্ত অটোমান সাম্রাজ্যে বই প্রকাশের ব্যাপারটা হাতে লিখে কপি করা স্ক্রাইবদের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এই শতকটির শুরুর দিকে, এক ইস্তানবুলেই আট হাজার নামকরা স্ক্রাইব বেশ সক্রিয় ছিলেন। মুতেফেরিকার মুদ্রণালয় তেমন কোনো প্রভাবই ফেলে নি। সাক্ষরতা, শিক্ষা, আর অর্থনৈতিক সাফল্যের ওপর এই বিরোধিতার সুদূরপ্রসারী প্রভাব ছিল অত্যন্ত নেতিবাচক। ১৮০০তে, অটোমান সাম্রাজ্যের প্রজাদের মধ্যে, মাত্র ২ থেকে ৩ শতাংশ লিখতে পড়তে জানতেন। সেই একই বছরে, ইংল্যাণ্ডে সাক্ষরতার হার প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের ক্ষেত্রে ছিলো ৬০ শতাংশ, প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ। নেদারল্যান্ডস আর জার্মানিতে সাক্ষরতার হারটা ছিলো আরো বেশি, এমনকি যে-পর্তুগাল ছিলো ইওরোপের মধ্যে সবচে কম শিক্ষিত দেশ, সেখানেও প্রাপ্তবয়স্কদের ২০ শতাংশ ছিলেন সাক্ষর।

বই জ্ঞানের ওপর থাকা অভিজাতদের নিয়ন্ত্রণ কমায়। এ-থেকে যে ক্রিয়েটিভ ডেসট্রাকশন সম্ভবপর হবে, দীর্ঘ মেয়াদে তাতে ক্ষমতা হারানোর ভয় ছিলো অটোমান সুলতান আর ধর্মীয় এস্টাবলিশমেন্টের, তাঁদের সমাধান ছিলো মুদ্রণালয়ের মাধ্যমে বই ছাপানো নিষিদ্ধ করা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হেরে ভেঙে পড়ার আগ পর্যন্ত অটোমান প্রতিষ্ঠানগুলো নিষ্কাশনমূলক রয়ে যায়, আর এই সময়কালে, সাম্রাজ্যটি সফল হয়েছিলো ক্রিয়েটিভ ডেসট্রাকশন সম্ভবপর করতে পারে মুদ্রণালয়ের মতো এমন সব আবিষ্কারের বিরোধিতা করতে বা তাদেরকে ঠেকিয়ে রাখতে।

একটা রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো অন্তর্ভুক্তিমূলক হলে তা একটা ভার্চুয়াস সার্কেল তৈরি করে, যা পজিটিভ ফিডব্যাক লুপের একটা প্রক্রিয়া। চাইলেও এলিটরা জনপরিসর সংকুচিত করতে পারে না, বরং সময়ের সাথে, এলিটের ক্ষমতা কমে আর পাবলিকের ক্ষমতা বাড়ে। একটা রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো নিষ্কাশনমূলক হলে তা তৈরি করে একটা ভিশিয়াস সার্কেল, যা নেগেটিভ ফিডব্যাক লুপের একটা প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া রাষ্ট্রের নিষ্কাশনমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকিয়ে রাখে। সময়ের সাথে জনপরিসর সংকুচিত হয়ে আসতে থাকে, এলিটের ক্ষমতা বেড়েই চলে, আর পাবলিক দিন দিন ক্ষমতাহীন হয়। ভিশিয়াস সার্কেলের একটা বিশেষ রূপ হচ্ছে, জার্মান সমাজতাত্ত্বিক রবার্ট মিশেলসের ভাষায়, কতিপয়তন্ত্রের লৌহশাসন (Iron Rule of Oligarchy)। এই ক্ষেত্রে স্বাধীনতা বা বিপ্লবের পরেও উপনিবেশিক আমলের বা রাজতন্ত্রের সময়কার নিষ্কাশনমূলক প্রতিষ্ঠানগুলো অটুট থেকে যায়, ব্যবহৃত হয় স্বাধীনতা বা বিপ্লবের নামে গোষ্ঠী স্বার্থ চরিতার্থ করতে, যেমনটা ঘটেছে আফ্রিকার ইথিওপিয়া আর সিয়েরা লিয়নে।

অ্যাসেমোগলু আর রবিনসন মনে করেন, ক্রিটিকাল জাঙ্কচারে তৈরি হওয়া স্মল ডিফরেন্সগুলো কাজে লাগাতে পারলে এবং কিছুটা ভাগ্যের সহায়তা পেলে, নিষ্কাশনমূলক প্রতিষ্ঠানের নিগড় ভেঙে বেরিয়ে আসাটা অসম্ভব নয়। উনিশশতকের শেষদিকে আফ্রিকায় এই কাজটা করেছিলো বতসোয়ানা। দেশটিতে ঐতিহাসিকভাবেই তুলনামূলকভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব ছিলো। উপনিবেশিক আমলেও তারা সেগুলো প্রাণপণে টিকিয়ে রেখেছে। এর সুফল তারা পেয়েছে স্বাধীনতা লাভের পর। অন্য আফ্রিকান দেশগুলোতে স্বাধীন শাসকরা উপনিবেশিক আমলে ইওরোপিয়ানরা যে-নিষ্কাশনমূলক প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে জনগণকে দাবিয়ে রাখতো, তাদেরকে স্রেফ খুবলে খেতো, সেগুলো জায়গামতো রেখে দিলেও বতসোয়ানায় সেটা হয় নি। আজকে আফ্রিকার একটি সফল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বতসোয়ানা।

৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ দিনটা আমার জন্য শিক্ষণীয়। আরো অনেকের জন্যই। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চরিত্রটা এইদিন যেভাবে স্পষ্ট হয়েছে, এভাবে আমাদের প্রজন্মের আর কারো কাছে আর কোনোদিন হয় নাই।

বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো নিষ্কাশনমূলক। সকল রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক সম্পদ এখানে ব্যবস্থাগতভাবেই একটা গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত হয়। ক্ষমতায় থাকাটা যাদের জন্য অস্তিত্ব রক্ষার ব্যাপার, এই কারণে এখানে নির্বাচন সংগঠিত আত্মপ্রতারণা, সত্যিকার নির্বাচনের প্যারোডি মাত্র।

১৯৭১এর মুক্তিযুদ্ধে আমরা ভৌগলিক স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এটা জরুরী ছিলো। সময়ের প্রয়োজনে যা করা দরকার মুক্তিযোদ্ধারা করেছেন। এখন আমরা বাস করছি একটা নতুন সময়ে। এই সময়টা নতুন, তাই তার যুদ্ধটাও নতুন। সেটা হচ্ছে এই দেশটা মানুষের বসবাসযোগ্য করা। সেটার জন্য আমাদের সব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে হবে, ২০১৮র শেষ দিনে শুধু এই কামনা করি, ২০১৯ হোক সেই প্রক্রিয়ার জন্য এই জনপদের লড়াইয়ের সূচনাবছর।

* অস্ট্রিয় অর্থনীতিবিদ জোসেফ শামপিটারের (১৮৮৩-১৯৫০) একটি কনসেপ্ট, যা সমাজের আর্থনীতিক বিকাশকে দেখে জৈবিকভাবে, নতুনের জন্মের জন্য পুরনোর মৃত্যু জরুরী এই জৈববাস্তবতাকে অর্থনীতির এলাকায় প্রয়োগ করে।

লেখকঃ ইরফানুর রহমান রাফিন, সম্পাদকমণ্ডলীর সদয়, মুক্তিফোরাম

Share.

মুক্তিফোরাম একটি মুক্তিবাদী, বহুত্ববাদী এবং জনপন্থী সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে গড়ে ওঠা সংগঠিত গণমঞ্চ। এর লক্ষ্য হলো নতুন ধরণের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক চর্চা নির্মাণ। নোংরা হিসেবে রাজনীতির যে রূপকল্প এদেশের মানুষের কাছে নির্মাণ করা হয়েছে, সেটিকে চ্যালেঞ্জ করতে চায় মুক্তিফোরাম। আবার যেসব একক আদর্শ (যেমন বামপন্থা-ডানপন্থা) বা পরিচয়ের রাজনীতি (সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, জাতিবাদ) দিয়ে জনগণের সংহতি ও বৈচিত্র্য হুমকির মুখে ফেলা হয়েছে তার একটি এন্টিডোট হয়ে ওঠাও মুক্তিফোরামের প্রকল্প।

Leave A Reply