ইন্দোনেশিয়া আজ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে আলোচিত দেশগুলোর একটি। বিশাল জনসংখ্যা ও দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও দেশটি সাম্প্রতিক সময়ে ভয়াবহ রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে পড়েছে। রাজধানী জাকার্তা থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রাদেশিক শহরে মানুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করছে। প্রথমে সংসদ সদস্যদের ভাতা নিয়ে শুরু হলেও এখন এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে জাতীয় সংকটে। অনেক বিশ্লেষক বলছেন—পরিস্থিতি গণঅভ্যুত্থানের দিকে গড়াতে পারে। চলুন একে একে দেখি কীভাবে বিষয়গুলো এগোচ্ছে।
বিক্ষোভের সূচনা ও বিস্তার:
সবকিছু শুরু হয় আগস্টের শেষ দিকে। ইন্দোনেশিয়ার সংসদ সদস্যদের জন্য অতিরিক্ত ভাতা ও সুবিধার একটি প্রস্তাব সংসদে আসে। সাধারণ মানুষ তখন থেকেই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। কারণ দেশের অর্থনীতি তাদের জন্য খুবই কঠিন হয়ে উঠেছে—তরুণরা চাকরি পাচ্ছে না, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়েছে, আর সংসদ সদস্যরা উল্টো নিজের জন্য সুবিধা বাড়াতে চাইছে।
এই প্রস্তাবটি প্রকাশ্যে আসার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র সংগঠনগুলো প্রতিবাদ শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে মিছিল বের হয়, শ্রমিক ইউনিয়ন যোগ দেয়, আর পরে ডেলিভারি কর্মী, রাইড-শেয়ার চালকরাও যুক্ত হয়। ইন্দোনেশিয়ার তরুণ প্রজন্ম বিশেষ করে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, কারণ তারা মনে করে রাজনৈতিক নেতারা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছেন না।
বিক্ষোভ শুরুতে ছোট আকারে থাকলেও দ্রুত বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়ে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে ছাত্ররা সংগঠিত হয়। অনেক জায়গায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়, তবে মানুষ ক্রমেই সাহসী হয়ে ওঠে। এই অবস্থাতেই ঘটে যায় একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা।
আফফান কুরনিয়াওয়ানের মৃত্যু: আন্দোলনের বাঁকবদল
২১ বছরের ডেলিভারি রাইডার আফফান কুরনিয়াওয়ান সংসদ ভবনের সামনে বিক্ষোভে ছিলেন। সেই সময় পুলিশের একটি গাড়ি তাকে ধাক্কা দেয়। পরে হাসপাতালে নিয়ে গেলে তিনি মারা যান।
এই মৃত্যুই আন্দোলনের প্রকৃত বাঁকবদল। আগে মানুষ হয়তো বিষয়টিকে শুধু সংসদ সদস্যদের সুবিধা-ভাতা হিসেবে দেখছিল, কিন্তু আফফানের মৃত্যুর পর এটি পুলিশি নির্যাতন ও রাষ্ট্রীয় জবাবদিহির বিরুদ্ধে জাতীয় প্রতিরোধে পরিণত হয়।
সোশ্যাল মিডিয়ায় আফফানের ছবি ভাইরাল হয়ে যায়। অনেকেই তাকে “জনগণের সন্তান” আখ্যা দেয়। মায়ের কান্না, পরিবারের সাক্ষাৎকার, সহকর্মীদের প্রতিবাদ মানুষের মনে গভীর সহানুভূতি জাগায়। ছাত্ররা স্লোগান তোলে—“আমরা সবাই আফফান।” এই আবেগী সংহতি আন্দোলনকে নতুন শক্তি দেয়।
গণঅভ্যুত্থানের সম্ভাবনার কারণ:
ইন্দোনেশিয়ার ইতিহাস মনে করিয়ে দেয় যে, ছাত্র আন্দোলন থেকেই বড় রাজনৈতিক পরিবর্তন হতে পারে। ১৯৯৮ সালে প্রেসিডেন্ট সুহার্তোর পতনের পেছনেও ছাত্রদের বিশাল ভূমিকা ছিল। বর্তমান আন্দোলনে অনেকেই সেই সময়ের স্মৃতি ফিরে পাচ্ছেন।
গণঅভ্যুত্থানের সম্ভাবনা তৈরি হওয়ার মূল কারণগুলো হলো:
অর্থনৈতিক অসন্তোষ: ইন্দোনেশিয়ার অর্থনীতি মোটের ওপর ভালো মনে হলেও, তরুণরা চাকরি পাচ্ছে না। শিল্পখাতে কর্মসংস্থান কমেছে, আর যারা চাকরি পাচ্ছে তাদের আয় দিয়ে সংসার চালানো কষ্টকর। এই হতাশা আন্দোলনের জ্বালানি।
রাজনৈতিক অবিশ্বাস: সংসদ ও রাজনৈতিক নেতাদের উপর আস্থা নেই। মানুষ মনে করে রাজনীতিবিদরা কেবল নিজেদের সুবিধা নিয়ে ব্যস্ত।
পুলিশি নির্যাতন ও জবাবদিহির অভাব: আফফানের মৃত্যু মানুষের মনে ক্ষোভ জমা করেছে। অনেকেই বলছে, পুলিশ সবসময় ক্ষমতাশালীদের রক্ষা করে, সাধারণ মানুষকে নয়।
সেনাবাহিনীর প্রভাব বৃদ্ধি: সাম্প্রতিক সময়ে সেনা ও পুলিশের ক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মানুষ আশঙ্কা করছে, এতে গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়বে।
যদি আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং নিরাপত্তা বাহিনীর ভেতরে ফাটল দেখা দেয়, তাহলে পরিস্থিতি গণঅভ্যুত্থানের দিকে গড়াতে পারে। যদিও এখনও সেনাবাহিনী পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে, কিন্তু চাপ যদি বাড়ে, তাহলে তারাও দ্বিধায় পড়তে পারে।
সরকারের প্রতিক্রিয়া:
বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর সরকার দ্রুত কিছু পদক্ষেপ নেয়। তারা ভাতার প্রস্তাব পুনর্বিবেচনার আশ্বাস দেয়, কয়েকজন মন্ত্রীকে বদলি করে, এমনকি পুলিশের তদন্তের প্রতিশ্রুতি দেয়।
তবে সাধারণ মানুষ এসবকে ভাঁওতাবাজি হিসেবে দেখছে। কারণ অতীতেও সরকার বারবার একই প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কিন্তু বাস্তবে কিছুই ঘটেনি। মন্ত্রী পরিবর্তন হলেও নীতি পরিবর্তন হয়নি।
শুধু তাই নয়, অনেক জায়গায় পুলিশ আবারও শক্তি প্রয়োগ করছে। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ার গ্যাস ও রাবার বুলেট ব্যবহার করা হয়েছে। এতে মানুষের ক্ষোভ আরও বেড়েছে।
সরকার আসল সংস্কার না করলে, যেমন—পুলিশি জবাবদিহি নিশ্চিত করা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সংসদে স্বচ্ছতা আনা—তাহলে আন্দোলন আরও বাড়বে।

ছবি: মেঝা.নেট
বাইরের শক্তি ও রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকা:
ইন্দোনেশিয়া শুধু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে বড় দেশই নয়, বরং জনসংখ্যার দিক থেকেও বিশ্বের চতুর্থ। তাই এর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বা অস্থিরতা অনেক দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ
যুক্তরাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়াকে মূলত দুই দিক থেকে দেখে—একদিকে এটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ, অন্যদিকে এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কৌশলগত কেন্দ্রে অবস্থিত। যুক্তরাষ্ট্র চায়, ইন্দোনেশিয়া যেন গণতান্ত্রিক ধারায় থাকে এবং চীনকে ঠেকাতে আঞ্চলিক রাজনীতিতে তার পাশে দাঁড়ায়। যদি বিক্ষোভ দীর্ঘস্থায়ী হয়ে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়, তবে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো ইন্দোনেশিয়ার গণতন্ত্রপন্থী শক্তিগুলোকে পরোক্ষভাবে সমর্থন করবে। একইসাথে রাজনৈতিক অস্থিরতা যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে—এ কারণেও তারা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
চীনের ভূমিকা
চীনের জন্য ইন্দোনেশিয়া হচ্ছে “বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ”-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। চীন বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ করছে অবকাঠামো, রেলপথ, খনি ও বন্দর নির্মাণে। রাজনৈতিক অস্থিরতা চীনের বিনিয়োগকে সরাসরি ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে। তাই চীন সম্ভবত সরকারের পক্ষে দাঁড়াবে এবং যেকোনো প্রকার গণঅভ্যুত্থানকে নেতিবাচকভাবে দেখবে। তবে, যদি নতুন কোনো রাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতায় আসে এবং চীনের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করার ইচ্ছা প্রকাশ করে, তবে চীন দ্রুত তাদের সাথে মানিয়ে নেবে।
আসিয়ান দেশগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি
ইন্দোনেশিয়া আসিয়ানের সবচেয়ে বড় ও প্রভাবশালী সদস্য। এখানে যদি গণঅভ্যুত্থান বা বড় রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়, তবে আসিয়ানের ভেতরে বিভাজন তৈরি হতে পারে। সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া স্থিতিশীলতা চায়, কারণ তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ইন্দোনেশিয়ার সাথে গভীরভাবে জড়িত। মিয়ানমারের মতো সংকট ইন্দোনেশিয়ায় তৈরি হলে আসিয়ানের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং আন্তর্জাতিক চাপ বাড়বে।
মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাব
ইন্দোনেশিয়ায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুসলিম জনগোষ্ঠী বাস করে। সৌদি আরব, তুরস্ক, কাতারসহ বিভিন্ন মধ্যপ্রাচ্যের দেশ এখানে ধর্মভিত্তিক কূটনীতি চালায়। বিক্ষোভ যদি ইসলামপন্থী আন্দোলনের দিকে ঝুঁকে পড়ে, তবে এই দেশগুলো নিজেদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করবে। এতে করে ইন্দোনেশিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনীতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে।
ইন্দোনেশিয়ার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কোন পথে?
ইন্দোনেশিয়ার সামনে এখন কয়েকটি সম্ভাব্য পথ খোলা রয়েছে।
ক. গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা
যদি বর্তমান সরকার বা এর বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি জনগণের দাবিকে গুরুত্ব দিয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধান বের করতে পারে, তবে ইন্দোনেশিয়া গণতান্ত্রিক ধারাতেই অগ্রসর হবে। সংসদীয় সংস্কার, স্বচ্ছ নির্বাচন, মানবাধিকার রক্ষা ইত্যাদি পদক্ষেপ জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে। তবে এর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর দমননীতি বাদ দিয়ে সংলাপ ও সংস্কারমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।
খ. স্বৈরশাসনের দিকে ঝুঁকে পড়া
বিক্ষোভ যদি দীর্ঘায়িত হয় এবং সহিংসতা বাড়তে থাকে, তবে সেনাবাহিনী শক্ত হাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে পারে। ইন্দোনেশিয়ার অতীত ইতিহাসে সেনা হস্তক্ষেপ নতুন কিছু নয়। ১৯৬৫ সালের অভ্যুত্থান ও সুহার্তোর দীর্ঘ শাসন এ দেশের মানুষ দেখেছে। তাই রাজনৈতিক সংকট থেকে স্বৈরশাসনের দিকে যাওয়া একেবারেই অসম্ভব নয়। তবে বর্তমান বিশ্বে গণতন্ত্রপন্থী চাপ ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ থাকায় সেনা শাসন আগের মতো দীর্ঘস্থায়ী নাও হতে পারে।
গ. ইসলামপন্থী শক্তির উত্থান
ইন্দোনেশিয়ায় ধর্মভিত্তিক আন্দোলনের একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা রয়েছে। বিক্ষোভ যদি ইসলামপন্থী গোষ্ঠীর নেতৃত্বে শক্তিশালী হয়, তবে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক ইসলাম বড় প্রভাব বিস্তার করতে পারে। তবে সাধারণ জনগণের বড় অংশই মাঝারি ও সহনশীল ইসলামী সংস্কৃতির অনুসারী, তাই কট্টর ইসলামপন্থার পুরো নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সহজ হবে না।
ঘ. আঞ্চলিক নেতৃত্ব ও বৈশ্বিক ভূমিকাইন্দোনেশিয়া শুধু অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেই নয়, বরং আন্তর্জাতিক পর্যায়েও একটি শক্তিশালী কণ্ঠ। যদি সংকট থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসতে পারে, তবে এটি আসিয়ানকে নেতৃত্ব দেবে, দক্ষিণ চীন সাগর ইস্যুতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষায় বড় প্লেয়ার হিসেবে আবির্ভূত হবে। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী অস্থিরতা হলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার প্রভাব কমে যাবে।
মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন।