আবরার হত্যার প্রতিবাদ অতঃপর গ্রাফিতি অঙ্কনচর্চার মধ্যদিয়ে শীতল হয়েছে। অতীতেও নিষ্ঠুরতম জুলুমগুলোর বিরুদ্ধে সামাজিক ফুঁসে ওঠার প্রায় অনুরূপ উপসংহার দেখেছি আমরা।

আবরার হত্যার ‘ন্যায়বিচার’ পাওয়া গেলে– নিশ্চয়ই সেটা হবে বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে একটা ভালো দৃষ্টান্ত। কিন্তু জুলুমের বিচার যখন সমাজের গভীরে সকলের বড় ধরনের #মিলিত#তদন্ত ছাড়াই দ্রুত উপনিবেশিক আইনের হাতে সোপর্দ হয়ে যায়– তখন তার সবচেয়ে ভালো পরিণতিও কী হয় সেটার সাক্ষী আছে শত শত বছরের ইতিহাসে। সেসব সকলের জানা।

নিপীড়ন, সহিংসতা ও হত্যার প্রতিকার হিসেবে কিছু মানুষের কারাদন্ডের বেশি কিছু ভেবে উঠতে পারি না আমরা। অথচ সহিংসতা যখন পদ্ধতিগত– বিচ্ছিন্ন কিছু ব্যক্তিগত কারাদন্ড তার সামান্যই ভবিষ্যত সুরাহা দিতে পারে।

এসব পুনঃপুন অভিজ্ঞতার অনেক ধরনের সারসংকলন করা যায়। অন্তত একটা সিদ্ধান্ত বোধহয় এটা হওয়া জরুরি, সমাজে সহিংসতার মূল মূল কাঠামোগুলো নিয়ে কথা বলা দরকার। আবরারের হত্যা নিশ্চয়ই কতিপয় পরিবারের নৈতিক মূল্যবোধজনিত সমস্যা নয় কিংবা ছাত্র রাজনীতি থাকা-না থাকার বিষয় নয়। একে ‘অপসংস্কৃতি’ নামক বোকাবোকা শব্দটি দিয়ে গালি দেয়াও হাস্যকর।

মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তের স্বপ্নভূমি বলেই বুয়েটের সহিংসতায় আমরা আলোড়িত হয়েছি– কিন্তু ইটের ভাটায় মানুষ পোড়ানো থেকে এসিডে মুখ ঝলসে দেয়ার বহু বহু দৃষ্টান্ত আছে আমাদের আর্কাইভে। তার চেয়ে বড় সহিংসতার নজির হিসেবে আছে কোটি কোটি মানুষের প্রতিদিনকার কম খাওয়া-বিনা চিকিৎসা-বেকারি-থাকার জায়গার অভাব-অপুষ্টিসহ আরও বহু কিছু। প্রশ্ন জাগে, লাখ লাখ কম বয়সী শিশু-আবরার যখন অপুষ্টিতে ভোগে– সেটাকে কবে সহিংসতা বলে তার বিচার চাইতে শুরু করবো আমরা? লাখ লাখ মানুষের চিকিৎসা সুবিধা না পাওয়া কী এক ধরনের পরোক্ষ খুন নয়? এসবকেও ‘সহিংসতা’ বলার মতো হিম্মত নিশ্চয়ই এবার আমাদের হবে।

আমরা প্রায়ই ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বাছাই করা কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরে মানবিক আবেগ নিয়ে খেলতে ভালোবাসি– কিন্তু অসাম্য অবসানের প্রশ্ন এলে একে ‘নিয়তি’ হিসেবে উল্লেখ করবো আর কতদিন?

কেন সমাজে কিছু মানুষের হাতে ক্রমাগত অনেক জমি, অনেক অর্থ, সব ক্ষমতা ও শক্তি জমা হচ্ছে এবং বাকি সংখ্যাগরিষ্ঠরা কেন ভূমিহীন, আশ্রয়হীন, বেকার ও ‘দুর্বল’– তার খোদ-কারণগুলো খতিয়ে দেখবো কবে আমরা? একে অস্বাভাবিক বলে ভাবতে শিখবো কবে?

আমাদের শত শত নারী ও শিশু প্রতি মাসে ধর্ষনের শিকার হয়। এটা কি অতিনিকৃষ্ট গণযুদ্ধের মতো নয়? আইন কিংবা তথাকথিত নৈতিক মূল্যবোধ দিয়ে কী সেটা বন্ধ করা গেছে বা কমানো গেছে? নাকি এর প্রাদুর্ভাবের শেকড় সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে রয়ে গেছে? আর কত অনাচার দেখার পর সেই সম্পর্ক ভাঙ্গচুরে হাত লাগাবো সবাই?

আমরা বর্ণ ও সম্প্রদায়গত ঘৃণার বাছাই করা কিছু স্ফূলিঙ্গ নিয়ে সভা-সমাবেশ করেছি। পারলে এসব অস্বীকার করেছি। বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার কাঠামোকে আঘাত করিনি। আমাদের শিক্ষা-সংস্কৃতি থেকে ‘অপর’-এর প্রতি ঘৃণার উপাদান বাদ দিতে আর কতদিন লাগাবো? কেন ঐতিহাসিক এসব সহিংসতার কথা বাদ দিয়ে আমরা কেবল ‘সোনার বাংলা’র হাজার বছরের রূপকথাই শিক্ষার্থীদের শুনিয়ে যাচ্ছি?

আমরা ভুল ওষুধ খেয়ে কয়েকজন শিশুর মৃত্যু নিয়ে হৈচৈ করে ২-৩ জন ব্যক্তিকে সাজা দিয়ে তৃপ্ত হয়েছি। জনগণের দিক থেকে ওষুধ কোম্পানিগুলোকে নিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন তুলিনি। শিল্পায়নের নামে প্রাণপ্রকৃতি ধ্বংস করাকে ‘উন্নয়ন’ ও ‘সফলতা’ নাম দেয়ার পরও আমরা ভাবি এদেশে যুদ্ধাপরাধ কেবল অতীতের বিষয়।

এসকল কাঠামোগত সহিংসতার মূল যে গোড়া– সেই ‘রাষ্ট্র’কেও আমরা পূতপবিত্র জ্ঞান করে বসে আছি। আমরা আইন, প্রশাসন, ইতিহাস, অভ্যাস, শিক্ষা কাউকে প্রশ্ন করতে চাই না। অথচ এরা সবাই দাঁড়িয়ে আছে নানারূপ সহিংসতার বন্টন, বিস্তার ও বৈধতার উপর। প্রতিমুহূর্তে তারা সহিংসতা ছড়াচ্ছে। সেই সহিংসতার সুবিধাভোগী উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত। এই ‘সুবিধা’র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াই হলো আবরার। ২০১৯-এর আগের আবরার এবং পরের আবরাররাও।

সহিংসতা মানে কেবল স্ট্যাম্প দিয়ে পেটানো নয়। প্রতিটি ধর্ষন, বিনা চিকিৎসার শিকার প্রতিটি মৃত্যু, প্রত্যেক বেকার তরুণের প্রতিটি দীর্ঘশ্বাস, নদীগুলোর কুৎসিৎ কালো পানি, পাজেরোগুলোর হাইড্রলিক হর্ণে ক্ষণে ক্ষণে কুকড়ে যাওয়া শিশুর আর্তনাদও সহিংসতা।

৬ অক্টোবরের আবরারের মৃত্যু ছিল বাংলাদেশে এরকম বহু ধরনের কাঠামোগত সহিংসতায় বলি হওয়া মানুষ ও প্রকৃতির একটা প্রতীকী নাম মাত্র। তার নাম হতে পারতো রহিমা খাতুন, রমেশ ঘোষ কিংবা রাতুল চাকমা। তার নাম হতে পারতো একটা নদীর নাম কিংবা একটা সবুজ শস্য ক্ষেত। যাদেরও আমরা অহর্নিশ খুন করছি কিংবা আগামীতে করবো এবং সেই খুনের অধিকার আমাদের আছে বলে ধরে নিয়েছি।

আমাদের কোন আবরারই তাই শেষ আবরার নয় এবং সকল প্রতিবাদই অল্প-বিস্তার আত্মসমর্পণের মধ্যদিয়ে স্মৃতি হয়ে যাবে। এ অবস্থা বদলাতে তাই গ্রাফিতি আঁকার পাশাপাশি কাঠামোগত সহিংসতার প্রকৌশলবিদ্যাটা বোঝা দরকার। অন্তত বোঝার দীর্ঘমেয়াদী কাজটি শুরু করা দরকার।

আলতাফ পারভেজ: গবেষক

Share.

মুক্তিফোরাম একটি মুক্তিবাদী, বহুত্ববাদী এবং জনপন্থী সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে গড়ে ওঠা সংগঠিত গণমঞ্চ। এর লক্ষ্য হলো নতুন ধরণের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক চর্চা নির্মাণ। নোংরা হিসেবে রাজনীতির যে রূপকল্প এদেশের মানুষের কাছে নির্মাণ করা হয়েছে, সেটিকে চ্যালেঞ্জ করতে চায় মুক্তিফোরাম। আবার যেসব একক আদর্শ (যেমন বামপন্থা-ডানপন্থা) বা পরিচয়ের রাজনীতি (সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, জাতিবাদ) দিয়ে জনগণের সংহতি ও বৈচিত্র্য হুমকির মুখে ফেলা হয়েছে তার একটি এন্টিডোট হয়ে ওঠাও মুক্তিফোরামের প্রকল্প।

Leave A Reply