শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ,

সবসময় তো উঁচু মঞ্চটিতে দাঁড়িয়ে আপনিই কথা বলেন আর আমি শুনি। আজ কি একটু আমার কথা শোনার সময় হবে?

সেই আড়াই বছর বয়সী ছোট্ট শিশুটির কথা মনে আছে আপনার? ছবিসহ একটি ছড়ার বই হাতে নিয়ে পুরোনো স্কুল ঘরের একটি কক্ষে বসেছিল। আর আপনি দেখতে পেয়ে কোলে নিয়ে তার মায়ের কাছে নিয়ে এসেছিলেন। হ্যাঁ, সেই শিশুটিই আমি। আপনার সাথে তার কিছুসময় পরেই ভালো করে দেখা হলো আমার, তাও পুরো পাঁচ বছরের জন্য আপনার হাতে। স্কুলে অনেকটা মায়ের মতো করেই আপনাকে পেয়েছিলাম বলে ছোটবেলা থেকে বিশ্বাস করতে পেরেছি যে বাবা-মায়ের পরেই শিক্ষকের স্থান। তারপর মাধ্যমিক- আপনার অনেকটা পরিবর্তিত রূপ। কলেজে গিয়ে আরো কিছুটা পরিবর্তন। তবে সবচেয়ে শক্তিশালী ধাক্কাটা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেই পেয়েছি।

আমার দেখা আপনার সুন্দরতম রূপটি যেমন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেই পেয়েছি, তেমনি অতি কুৎসিত রূপটিও এখানে এসেই দেখেছি এবং শিহরিত হয়েছি। দেখেছি কি করে পদ, পদবী কিংবা পদকের লোভে আপনি নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিতে পারেন। এর আগের প্রতিষ্ঠানগুলোতেও আমি আপনার কিছুটা নৈতিক অবক্ষয় দেখেছি। কিন্তু তখন বিশ্বাস করতাম আপনি শিক্ষক তাই সকল প্রশ্নের উর্ধ্বে। আজ আমার সেই ধারনা ভেঙেছে। তাই আপনাকে প্রশ্ন করছি – কি করে পারেন একজন শিক্ষক হয়ে ক্ষমতার কাছে নিজের আত্মসম্মান বিক্রি করতে?

ওহ্! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম যে আপনি প্রশ্ন করা পছন্দ করেন না। কিন্তু কি করব বলুন আপনি প্রশ্নকে ভয় পান বলেই তো আমার মনে প্রশ্ন আসে। তাহলে প্রশ্ন নিয়ে সমস্যাটা আসলে কার? আমার না কি আপনার?

আপনি আমার বাকস্বাধীনতা হরণ করেছেন অর্থাৎ আমার মানবাধিকার ক্ষুন্ন করেছেন। আমার কোনো কথা আপনার মনঃপুত না হলে আপনি কি নোংরাভাবে আমাকে অপমান করেছেন! বিনা দোষে বহিস্কার করে আমার শিক্ষাজীবনকে আপনি নরক বানিয়েছেন কত বার! কত বার আমার অসহায় বাবা মাকে আপনি অপমান করেছেন! তারপর কি করে আবার নিজেকে আমার বাবার সাথে তুলনা করেন? আপনার অনুগত না হলে, আপনাকে তোষামোদ করতে না পারলেই আপনি তাকে অপমান করেন। এই অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে?

আপনার শিক্ষার্থী বিতর্ক করবে সেটি আপনার মনঃপুত নয়। শিক্ষার্থী তার পাঠ্যক্রমের বাইরে মননশীল বই পড়বে তাতেও আপনার আপত্তি। যতক্ষণ আমি বিসিএস এর জন্য মুখস্থ করছি “যদ্যপি আমার গুরু” বইয়ের লেখক আহমদ ছফা, ততক্ষণ পর্যন্ত আপনি আমাকে উৎসাহিত করছেন, কিন্তু আমার হাতে ওই নির্দিষ্ট বইটি দেখলেই আর আপনার সহ্য হয় না। কিন্তু কেন? কিসের এত ভয় আপনার?

নিজের অক্ষমতাকে ঢাকতে আমার মতো সাধারণ শিক্ষার্থীর ক্ষতি কেন করেন আপনি? ক্লাসে যদি না-ই পড়াতে পারবেন তাহলে বলে দিবেন বাইরে থেকে যেমন করে হোক পড়ে নেব। আপনার পারবারিক গল্প শুনিয়ে আপনি কেন আমার সময় নষ্ট করবেন? ছোটবেলায় ‘সময়ের মর্যাদা’ শিখিয়েছেন যে আপনি, তাঁর কাছেই দেখছি তাঁর শিক্ষার্থীর সময়ের কোনো গুরুত্ব নেই।

আপনি শিক্ষক। আপনার ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ কেন আপনার শিক্ষার্থীর পরীক্ষার ফলাফলে প্রতিফলিত হবে? শিক্ষার্থী হিসেবে আমাকে কেন অনুভব করতে হবে যে আমি আপনার কাছে জিম্মি? আপনি ব্যক্তিগতভাবে পুরুষ-বিদ্বেষি কিংবা নারীবিদ্বষী হতেই পারেন তবে তা কেন শ্রেণিকক্ষে প্রকাশ করতে হবে?

যাই হোক, সবচেয়ে বেশি অবাক লাগে কখন জানেন? যখন দেখি আমাকে বিপ্লবী হতে শিখিয়ে আপনি নিজেই সত্যিকার বিপ্লবের সময় মাঠ ছেড়ে চলে গিয়েছেন। তবে প্রথম একটু আশাহত হলেও মনোবল কিন্তু হারাই না। তাহলে মনোবলের বিবেচনায় কি আপনি আমার চেয়ে কিছুটা দূর্বল? শেষ একটি অনুরোধ- আপনি যতক্ষণ না পর্যন্ত নিজের নৈতিকতার প্রশ্নে সম্পূর্ণ সৎ হতে পারবেন ততক্ষণ পর্যন্ত দয়া করে আমাকে নৈতিকতা শিখাবেন না। অন্তত যে বিষয়টিতে আপনার নৈতিকতার ঘাটতি আছে সেটি আমাকে শিখাবেন না। নয়ত দুঃসময়ে পরে যখন আবার মোহভঙ্গ হবে তখন অত বড় আঘাত নিতে পারব না।

শ্রদ্ধেয় শিক্ষক, আপনি জানেন কত দিন আমি না খেয়ে আপনার ক্লাসে গিয়েছি? কখনো হয়ত টাকার অভাবে, কখনোবা সকাল বেলার টিউশন থেকে ফিরতে দেরি হয়ে গেছে বলে, আবার কখনো রান্না শেষ হতে না হতেই ক্লাসের সময় হয়ে গেছে বলে। বিদ্যালয় থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয় অবধি আমার সজ্ঞানে আমি কখনো আপনার সাথে বেয়াদবি কিংবা অসদাচরণ করিনি। কেননা, ছোটবেলা থেকেই বিশ্বাস করে এসেছি যে বাবা-মায়ের পরেই আপনার স্থান।
কিন্তু সত্যি বলছি আজ ঘুম থেকে উঠে ক্ষুধা পেটে নিয়ে যখন ক্লাসে ছুটে যাই তখন ইচ্ছে হয় না আপনার আগমন ও প্রস্থানের সময় দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানাই। কি করে শ্রদ্ধা জানাই বলুন তো? যখনই মনে করি আপনি আমার শিক্ষক ঠিক তখনই আবার মনে পরে যে এই আপনিই একজন অত্যাচারী লম্পটের পক্ষ নিয়ে আপনার শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পেরেছেন। আমার বাহ্যিক আচরণে আমি কখনোই আপনাকে অসম্মান করব না তবে মন থেকে কতটুকু শ্রদ্ধা করতে পারব সেটা আপনিই নিজেকে প্রশ্ন করলে জানতে পারবেন।

– ইতি
আপনার অসহায় শিক্ষার্থী। ( বারবিয়ানা স্কুল থেকে অনুপ্রাণিত)

লেখাঃ সুজাতা, শিক্ষার্থী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

Share.

মুক্তিফোরাম একটি মুক্তিবাদী, বহুত্ববাদী এবং জনপন্থী সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে গড়ে ওঠা সংগঠিত গণমঞ্চ। এর লক্ষ্য হলো নতুন ধরণের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক চর্চা নির্মাণ। নোংরা হিসেবে রাজনীতির যে রূপকল্প এদেশের মানুষের কাছে নির্মাণ করা হয়েছে, সেটিকে চ্যালেঞ্জ করতে চায় মুক্তিফোরাম। আবার যেসব একক আদর্শ (যেমন বামপন্থা-ডানপন্থা) বা পরিচয়ের রাজনীতি (সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, জাতিবাদ) দিয়ে জনগণের সংহতি ও বৈচিত্র্য হুমকির মুখে ফেলা হয়েছে তার একটি এন্টিডোট হয়ে ওঠাও মুক্তিফোরামের প্রকল্প।

Leave A Reply