তিস্তা নদীর নাম উচ্চারিত হলেই বাংলাদেশের মানুষ আবেগতাড়িত হয়। বিশেষত দেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষদের কাছে এই নদী শুধুই পানি বা প্রকৃতির একটি অংশ নয়—এটি তাদের জীবিকা, সংস্কৃতি, এবং রাজনৈতিক ভাগ্যেরও প্রতীক। দীর্ঘদিন ধরে ভারত থেকে ন্যায্য পানিবণ্টনের দাবি বাস্তবায়িত হয়নি। বর্ষায় যে নদী ভয় দেখায়, সেখানে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় হাঁটু পর্যন্ত পানিও থাকে না। এমন বাস্তবতায়, ‘তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন’—এই ব্যানারে বিএনপির নেতা আসাদুল হাবিব যখন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য কাজ শুরু করার দাবি জানান ও এর অন্যথা হলে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার হুঁশিয়ারি দেন, তখন বোঝা যায়—তিস্তার পানি এখন শুধু নদীর নয়, রাজনীতির স্রোতেও মিশেছে।
এক নদীর দুই তীর, দুই রাজনীতি
তিস্তা বাংলাদেশের ভৌগোলিক ও কূটনৈতিক ইস্যু হলেও এর রাজনৈতিক প্রভাব সবসময়ই গভীর। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—দুই বড় দলই কখনো না কখনো এই নদীকে রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে ব্যবহার করেছে।
২০০২ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীনও তিস্তা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল, কিন্তু কোনো স্থায়ী চুক্তি হয়নি। পরে ২০১১ সালে শেখ হাসিনা দিল্লি সফরে গেলে তিস্তা চুক্তি প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তিতে তা স্থগিত হয়ে যায়।
এই দীর্ঘ ব্যর্থতা জনগণের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করেছে। উত্তরবঙ্গের কৃষকরা এখন নদীর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এ অবস্থায় তিস্তা ইস্যু আবার রাজনৈতিক আলোচনায় ফিরে আসায় সেটি একদিকে জনআবেগের প্রতিফলন, অন্যদিকে রাজনৈতিক সম্ভাবনার ক্ষেত্রও খুলে দিয়েছে।
পরিবেশ না রাজনীতি?
আসাদুল হাবিব বলেছেন, “তিস্তা রক্ষা মানে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা।” এ বক্তব্য শুনলে মনে হয় এটি জাতীয় স্বার্থে একটি পরিবেশ আন্দোলন। কিন্তু তার পরের বাক্য—“তফসিল ঘোষণার আগে কাজ শুরু না করলে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে”—সেই বক্তব্যকে স্পষ্টভাবে রাজনৈতিক করে তোলে।
তফসিল ঘোষণার আগে চুক্তি না হলে আন্দোলন শুরুর অর্থ কী? তাছাড়া বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির নেতারা আছেন নেতৃস্থানীয় ভূমিকায়। এর অর্থ হলো, বিএনপি রাজনৈতিক মাঠে আগাম অবস্থান নিতে চায়। সাধারণত তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ বাড়ে; রাজনৈতিক কার্যক্রমের ওপর বিধিনিষেধও আরোপিত হয়। তাই আগেভাগে ‘ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন’ শুরু করে মাঠ উত্তপ্ত করার কৌশল রাজনৈতিকভাবে বুদ্ধিদীপ্ত।
তিস্তা এখানে কেবল ইস্যু নয়, বরং একটি “প্রবেশদ্বার”—যার ভেতর দিয়ে সরকারবিরোধী বৃহত্তর আন্দোলনের সূচনা হতে পারে।
‘জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই’ স্লোগানে বিএনপির নেতৃত্বে রংপুরসহ পাঁচ জেলায় চলছে ‘তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন’।
জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য ইস্যু
রাজনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো “জনসংযোগ” বা মানুষের হৃদয়ে পৌঁছানো। তিস্তা ইস্যু সেই জায়গায় অত্যন্ত শক্তিশালী। কারণ এটি দলীয় নয়, জাতীয়।উত্তরবঙ্গের লাখ লাখ কৃষক তিস্তার পানির ওপর নির্ভরশীল। প্রতিটি শুকনো মৌসুমে যখন ফসল নষ্ট হয়, নদী শুকিয়ে বালুচরে পরিণত হয়, তখন তাদের ক্ষোভ বাড়ে। এই ক্ষোভ যদি সঠিকভাবে সংগঠিত হয়, তাহলে তা রাজনৈতিক শক্তিতে রূপ নিতে পারে।
আসাদুল হাবিবের বক্তব্য তাই কেবল রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, সামাজিক ও আবেগিক দিক থেকেও প্রভাব ফেলতে পারে। তিনি যদি এই আন্দোলনে নাগরিক ও পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোকেও যুক্ত করতে পারেন, তাহলে এটি ‘জনআন্দোলন’-এর রূপ নিতে পারে—যার পেছনে রাজনৈতিক শক্তিও থাকবে, এবং থাকবে নৈতিক বৈধতাও।
সরকারের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া ও কূটনৈতিক সংবেদনশীলতা
সরকারের দৃষ্টিতে এই আন্দোলন নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে।তিস্তা ইস্যু এখন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের সবচেয়ে সংবেদনশীল অংশ। ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকারও চুক্তির ব্যাপারে প্রকাশ্যে ইতিবাচক বক্তব্য দিলেও পশ্চিমবঙ্গের বাধায় বিষয়টি অগ্রসর হচ্ছে না।এই প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশে যদি তিস্তা নিয়ে ব্যাপক জনআন্দোলন শুরু হয়, তা ভারতকেও বিব্রত করতে পারে।
ফলে সরকার হয়তো এটিকে “রাষ্ট্রবিরোধী প্রচেষ্টা” বা “বিদেশনীতি নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি” হিসেবে ব্যাখ্যা দেবে। বিশেষ করে যদি বিএনপির নেতারা আন্দোলনের ভাষায় “ভারতবিরোধী সুর” ব্যবহার করেন, তাহলে সরকার সেটাকে কূটনৈতিক ঝুঁকি হিসেবে দেখবে।
অর্থাৎ, বিএনপিকে এখানে এক সূক্ষ্ম ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে—জাতীয় স্বার্থের কথা বলতে হবে, কিন্তু বিদেশনীতি-বিরোধী মনে না হয়, এমনভাবে।
আগামী নির্বাচনের ছায়া
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আন্দোলনের ব্যাপারটি নির্বাচন ঘনিয়ে এলে ভিন্ন মাত্রা পায়।
বিএনপি গত কয়েকটি নির্বাচন বর্জন করেছে, বর্তমানে তারা নির্বাচনে আগ্রহী , তবে এনসিপি বা জামায়াত অংশ নেবে কিনা- সেটি এখনো পরিষ্কার নয়। কিন্তু “তিস্তা রক্ষা”র মতো একটি বিষয়কে সামনে এনে যদি বিএনপি নেতারা রংপুর অঞ্চলের জনগণকে সক্রিয় করতে পারেন, তাহলে এটি নির্বাচনের আগে শক্তির জানান দেয়ার একটি উপায় হতে পারে।
বিএনপি সরাসরি নির্বাচনী দাবিতে এখনই নামলে প্রশাসনিক বাধা আসবে। কিন্তু পরিবেশ বা জাতীয় ইস্যুতে আন্দোলন করলে তা সহজে দমন করা যায় না। এভাবে “ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন” আসলে একটি স্মার্ট প্রি-ইলেকশন স্ট্র্যাটেজি হতে পারে।
তিস্তা প্রকল্পের বাস্তবতা ও রাজনীতির ছায়া
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, সরকার ইতোমধ্যে চীনের সহায়তায় “তিস্তা মাস্টারপ্ল্যান” বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছে। এতে নদীর খনন, বাঁধ ও অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির পরিকল্পনাও আছে। কিন্তু এই প্রকল্প কতটা বাস্তবায়নযোগ্য, তাতে চীন কতটা যুক্ত হবে—তা নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা রয়েছে।
বিএনপি এই অনিশ্চয়তাকে রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগাতে পারে। তারা বলতে পারে—“চুক্তি নেই, প্রকল্পও নেই, তিস্তা মরে যাচ্ছে”—এমন আবেগপ্রবণ বক্তব্য মাঠে বেশ প্রভাব ফেলবে।
আন্দোলনের সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা
তবে বিএনপির এই পরিকল্পনা কতটা কার্যকর হবে, তা নির্ভর করছে তাদের সংগঠিত শক্তির ওপর। গত এক দশকে তাদের আন্দোলন প্রায়ই পুলিশের বাধা, গ্রেপ্তার, ও অভ্যন্তরীণ বিভক্তির কারণে স্থায়ী গতি পায়নি।তিস্তার ইস্যুতে যদি তারা জনগণের প্রকৃত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে এটি এক ধরনের ‘পুনর্জাগরণ’ হতে পারে।
কিন্তু যদি আন্দোলন কেবল রাজনৈতিক বক্তৃতায় সীমিত থাকে, তাহলে এটি পরিবেশ বা জনগণের দাবি হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা হারাবে।
তিস্তা: নদী নাকি প্রতীক?
তিস্তা এখন কেবল একটি নদী নয়; এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে “ন্যায্য অধিকার” ও “অবহেলার প্রতীক” হয়ে উঠেছে।বিএনপি সেটিকে ব্যবহার করতে চাইছে “অধিকার আদায়ের আন্দোলন” হিসেবে, যার আড়ালে নির্বাচনী প্রস্তুতির রাজনীতি লুকানো আছে।অন্যদিকে সরকার এটিকে দেখবে “অস্থিতিশীলতা তৈরির কৌশল” হিসেবে। এই দুই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে কোথায় সত্য, তা সময়ই বলবে।তবে এটুকু নিশ্চিত—তিস্তার জলে যে রাজনীতি মিশেছে, তার ঢেউ এখন জাতীয় রাজনীতির তীরে এসে পড়েছে।এই ঢেউ শান্ত নদীতে পরিণত হবে, না কি নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক জলোচ্ছ্বাসে রূপ নেবে—সেটিই এখন দেখার বিষয়।
শেষকথা
আসাদুল হাবিবের ঘোষণা বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন এক “ইস্যু রাজনীতি”-র দিক নির্দেশ করছে। যেখানে নদী, পরিবেশ, সার্বভৌমত্ব—সব মিলিয়ে এক জটিল কিন্তু কার্যকর আবেগ তৈরি হচ্ছে।রাজনীতি যদি জনগণের বাস্তব সমস্যা থেকে উৎসারিত হয়, তাহলে তিস্তা ইস্যু নিঃসন্দেহে শক্তিশালী। কিন্তু যদি এটি কেবল রাজনৈতিক সুবিধার জন্য ব্যবহৃত হয়, তাহলে মানুষ দ্রুতই তা বুঝে ফেলবে।
বাংলাদেশের নদীগুলো যেমন প্রাকৃতিক জীবনের অংশ, তেমনি আজ রাজনীতিরও অংশ হয়ে উঠেছে। তিস্তা হয়তো আমাদের শেখাবে—কীভাবে একটি নদীর স্রোত রাজনীতির গতিপথ বদলে দিতে পারে।
মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন।