জুলাই সনদের বাস্তবায়ন নিয়ে এখন ঐক্যমত্য কমিশনের গোলটেবিল থেকে জনতার সংসদ ফেসবুক এবং টং দোকান – সব জায়গাতেই আলোচনা চলছে। মূল প্রশ্নটা একটাই: ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবের প্রতিটা নিয়ে আলাদা করে গণভোট হবে, নাকি পুরো সনদটার ওপর একসঙ্গে হ্যাঁ বা না ভোট নেওয়া হবে? নোট অব ডিসেন্ট দেওয়া সংস্কার প্রস্তাবগুলোর কী হবে? প্রভিশনাল সাংবিধানিক অধ্যাদেশহীন এই সনদের এই বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেন দ্বন্দ্ব থামছেই না। বলা হচ্ছে খোদ জুলাই বিপ্লবই হুমকির মুখে। কিন্তু কেন?
নোট অব ডিসেন্ট দেওয়া সংস্কার প্রস্তাবগুলো কত গুরুত্বপূর্ণ?
সংবিধান সংস্কার কমিশনের ৮৪টি প্রস্তাবের মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও সমমনা দল নোট অব ডিসেন্ট অর্থাৎ ভিন্ন মত দিয়েছে ৯টি তে আর জামায়াত ইসলামী ও সমমনা দল দিয়েছে ১টি তে। ৭৪টি সংস্কার প্রস্তাব সংখ্যায় অনেক বড় মনে হলেও, জুলাই বিপ্লবের নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে আকাঙ্ক্ষা, তা আটকে আছে এই ১০টি প্রস্তাবেই।
এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটো বিষয় রয়েছে: একটি হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নির্ধারণ। একটি সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে সেই সরকারের আন্ডারে নির্বাচন – বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি পরীক্ষিতভাবে সফল পদ্ধতি এবং রাজনৈতিক দলগুলোও এই ব্যবস্থা প্রণয়নে একমত। সরকারের প্রধান কিভাবে নিয়োগ হবে সেটা নিয়ে কমিশনের প্রস্তাব হলো প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতা, ডেপুটি স্পিকার (বিরোধী দলীয়) এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধির সমন্বয়ে একটি কমিটি ৯০ দিনের জন্য সরকার প্রধান নিয়োগ দিবে। কেউ একমত না হলে সাথে আরও কয়েকটি ধাপ যেমন র্যাঙ্ক চয়েজ, বিচার বিভাগের প্রতিনিধি ইত্যাদি রয়েছে। তবে, সে নিয়ে দলগুলোর ভিন্ন মত রয়েছে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব হলো দুদকের স্বয়ংক্রিয়তা ও চেয়ারম্যান নিয়োগ। বর্তমান ব্যবস্থায় দুদকের নিয়ন্ত্রণ মুলত প্রধানমন্ত্রীর হাতে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় এই সংস্থাকে দলীয়করণ ও অপব্যাবহার হয়ে আসছে বিগত বছরগুলোতে। কমিশন প্রস্তাব দিয়েছে যে দুদককে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা দেওয়া ও আপিল বিভাগের বিচারপতির সভাপতিত্বে সংসদ নেতা ও বিরোধী দলীয় নেতারা দুদকের প্রধান নিয়োগ দিবেন। এতে প্রতিষ্ঠানটি দলীয় করণের আওয়তা থেকে মুক্ত ও স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করতে পারবে। কিন্তু বিএনপিসহ সাত দল গোটা দুদকের এই পরিবর্তনেই ভিন্নমত পোষণ করেছে।
এছাড়া বহুল আলোচিত উচ্চকক্ষে পিআর ব্যবস্থা, সরকারি কর্ম কমিশনে প্রধানমন্ত্রীর আধিপত্য বাতিল করে অন্যান্যদের যুক্ত করা, দুদকের চাহিদায় যেকোনো ব্যক্তির আয়কর প্রকাশ, পিএসসির সব সরকারি নিয়োগ বাদ দিয়ে একাধিক কমিশন করা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার ঠেকে আছে নোট অব ডিসেন্টের জালে (শেষের প্রস্তাবটিতে ভিন্নমত দিয়েছে জামায়াত)। এগুলো বাদে আনডিস্পিউটেড সংস্কারগুলো দরকারি হলেও তা মুলত অলংকারিক। যেমন ২২টি মৌলিক অধিকারে নিরবিচ্ছিন্ন ইন্টারনেট ও ব্যক্তিগত তথ্য গোপনীয়তা যোগ করা, রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে সাম্য, মানবিক মর্যাদা যুক্ত করা, সংসদ সদস্যের অধিকার নির্ধারণ ইত্যাদি। দলিলে পরিবর্তনীয় ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ম্যাচুরিটি বাড়লেও আমজনতার জীবন যাত্রায় এই সংস্কার গুলোর কোনো প্র্যাক্টিকাল প্রভাব ফেলবে না বলা চলে।
সমাধানের খোঁজে গণভোট
নোট অব ডিসেন্টের আলোচনায় গণভোটের বিষয়টি এসেছে। এখনও নির্ধারণ না হলেও গণভোট কী নিয়ে হবে তা নিয়ে চলছে আলোচনা। অনেকেই বলছেন, পুরো জুলাই সনদের উপর হ্যাঁ/না ভোট করতে। এতে সাংবিধানিক অধ্যাদেশ জারি না করলেও জনগণের ম্যান্ডেট থাকবে সনদের প্রতি। তবে সমস্যা থেকে যায় সেই নোট অব ডিসেন্ট নিয়েই। পুরো সনদের উপর হ্যাঁ/না ভোট হলে ডিসপিউটেড সংস্কার গুলোর কী হবে? এক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, যে দল মেজরিটি পাবে সে দলই তাদের দলীয় অবস্থানের প্রেক্ষিতে সংস্কার করবেন।
প্রশ্ন থেকে যায় যে, জনগণের সনদের প্রতি হ্যাঁ ভোট কি নোট অব ডিসেন্ট দেওয়া সংস্কারের পক্ষে নাকি বিপক্ষে? যদি কেউ কোনো স্পেসিফিক সংস্কারের বিপক্ষে থাকে (যেমন ফরিদপুর ও কুমিল্লা বিভাগ করা) তাহলে সে কী গোটা সনদের বিপরীতেই না ভোট দিবে? এটি করলে তো বরং জুলাই সনদের বিপক্ষে না ভোট পড়বে বিশাল সংখায়। আবার, নোট অব ডিসেন্ট দেওয়া দল যদি ক্ষমতায় যায়, তাহলে তারা কি সেই সংস্কার গুলো করবে না? বাকি দল গুলো এক্ষেত্রে পলিটিকাল প্রেসার দিলে করতে পারে, কিন্তু বাকি দলগুলোও যে ব্যাকডোর মিটিঙে গিয়ে কোনো চুক্তি করে আসবে না তার নিশ্চয়তা কী? দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে খ্যাতি পাওয়া জামায়াতে ইসলামী ১৭ তারিখ সকালেও বলেছিল যে নিম্ন কক্ষে পিআর না দিলে তারা জুলাই সনদে সাক্ষর করবে না। অথচ ঘন্টা খানেক পরই তারা সনদে সাক্ষর করেছে যেখানে সনদে নিম্ন কক্ষে পিআর তো দূর, উচ্চ কক্ষেই পিআর হবে কিনা তা ঠিক করা নাই। তাহলে, পুরো সনদের উপর ভোট হলে জুলাই বিপ্লবের যে জনআকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন, তাতে জনগণের কোনও স্টেক তো থাকছেই না বরং গুটি কয়েক রাজনৈতিক দলের হাতে কুক্ষিগত থাকবে পুরোটা।
প্রত্যেক সংস্কার প্রস্তাবে হ্যাঁ/না ভোট
অনেকে আবার প্রস্তাব করছেন যে প্রতিটা সংস্কার এক এক করে হ্যা/না ভোট নিতে। কিন্তু, এতগুলো সংস্কার প্রস্তাব প্রত্যেকটার ওপর সাধারণ মানুষকে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দিতে বলা মোটেই বাস্তবসম্মত নয়। দেশের ২০ কোটিরও বেশি মানুষকে তিন মাসের মধ্যে বোঝানো সম্ভব নয় ৮৪টা সংস্কারের মধ্যে কোন কোন সংস্কার দরকারি আর কোনটা নয়। সাধারণ ভোটারদের শিক্ষাগত সীমাবদ্ধতা আমাদের এখানে মাথায় রাখতে হবে – খেঁটে খাওয়া মানুষের হাতে সময় নেই কয়েকদিন খাতা কলম নিয়ে বসার। এই ক্ষেত্রে দুটো বিষয় হতে পারে: হয় তারা শুধু নেতা নির্বাচনের ভোট দিয়ে চলে যাবেন, সনদের জায়গা ফাঁকা রেখে দিবেন, নয়তো তাদের পছন্দের কোনো শিক্ষিত লোকের কথা মত লিস্ট ধরে ভোট দিবেন।
প্রথম ঘটনাটি হলে সংস্কারের বিষয় সমাধা তো পরের কথা, খোদ জুলাই সনদের এবং পক্ষান্তরে সংস্কারের ম্যান্ডেটই প্রশ্নের মুখে পড়বে। তবে দ্বিতীয় ঘটনাই সবচেয়ে বেশি দেখা যেতে পারে। এক্ষেত্রে জননন্দিত বুদ্ধিজীবীদের বয়ানই বেশি প্রভাব রাখবে। জনতা এইসব পপুলার ফেইসদের দেওয়া লিস্ট ধরে ভোট দিয়ে আসবেন। আপাতমস্তক এটা জনগণের উইল রিফ্লেক্ট করছে মনে হলেও খেয়াল করলেই দেখা যাবে যে এই “জননন্দিত বুদ্ধিজীবী/এক্টিভিস্ট” শ্রেণী মূলত হাতে গোনা কয়েকজনের কাছে কুক্ষিগত। এই নির্দলীয় ইউটিউব কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকে টেক্কা দিতে খোদ রাজনৈতিক দলগুলোও হিমশিম খাচ্ছে বলে বিভিন্ন মহল থেকে শোনা যায়। কয়েক সপ্তাহ আগেও বিভিন্ন জায়গায় বলা হচ্ছিল যে জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) অনলাইনে এক্টিভিস্ট সার্কেল তৈরি করার জন্য কোর্স চালু করছে। তার মানে, রাজনীতির বয়ান তৈরিতে মনোপলি আছে এই হাতে গোনা কয়েকজন লোকের। ৮৪টা সংস্কার বিষয়ক ভোট হলে কার্যত এই কয়েকজন লোকদের হাতেই বাংলাদেশের কাঠামোগত ভবিষ্যৎ থাকবে। জনগণের উইলের রিফ্লেকশন হওয়ার বদলে ইউটিউবার রিফ্লেকশন হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি বরং। এছাড়া সংবিধানের মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা ও অন্যান্য বিষয় থাকায় সেকুলার-ইসলামিস্ট দন্দ নতুন করে উস্কে দেওয়া সহ বাংলাদেশের রাজনীতির চিরচায়িত খাসলত “কালচার ওয়ার” হওয়ারও সমূহ সম্ভাবনা আছে। এটি হলে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার আলোচনা আরও ধামাচাপা পড়ে যাবে। ইতোমধ্যেই মূলধারার রাজনৈতিক ডিসকোর্স এ অন্যান্য কমিশনের সংস্কার বাদ দিয়ে শুধু পিআর নিয়েই আলোচনা চলছে। এই ঘটনাগুলো যে বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য যে নেতিবাচক তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
তারপর আসে লজিস্টিক আর ফিজিবিলিটির ইস্যু। ১৭ বছর পর প্রথম নির্বাচন হওয়াতে ভোটার টার্ন আউট ঐতিহাসিক ভাবে বেশি হবে এটা ধারণা করা যায়। এমনকি ঢাকাস্থ কর্মরত কিন্তু ভোটার অন্য বিভাগে – তারাও ভোট দিতে উৎসাহ বোধ করবেন। এত বিপুল সংখ্যক ভোটারের প্রত্যেকটা সংস্কার বিষয় ধরে গণনা করা, যাচাই করা—এসবের জন্য সময় ও জনবল দুইটোই লাগবে বিশাল পরিমাণে। এই সমস্যার সমাধান হতে পারে ওএমআর দিয়ে ভোট গণনা – ডাকসু নির্বাচন যেভাবে হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশে ইভিএম বা ডিজিটাল ভোটিং সিস্টেমের ইতিহাস খুব একটা উৎসাহজনক নয়। মেশিন ম্যনুপুলেট করা যাবে কিনা সেটা পরের আলোচনা, পুরো সরঞ্জামকেই বাংলাদেশের মানুষ আর রাজনীতিবীদরা বিশ্বাস করবেন না সেটা অনুমেয়।
সীমিত গনভোটই সমাধান
এর চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর হতে পারে সীমিত গণভোট। শুধু যেসব প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলো নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে, শুধু সেগুলোর ওপর ভোট। বিএনপি ৯টি আর জামায়াতে ইসলামি ১টি প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়েছে; অর্থাৎ মোট ১০টি বিষয়ে দ্বিমত আছে। এই দশটি প্রস্তাব নিয়ে জনমত যাচাই করা তুলনামুলক সহজ। ৩ মাসে ভোটারদের এই অল্প সংখ্যক বিষয়ে এডুকেট করা যেমন সহজ হবে, তেমনই অগুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে বিতর্ক এড়ানোও যাবে। রাজনৈতিক দলগুলো এলাকা ভিত্তিক ক্যাম্পেইন করতে পারবে। এতে “জননন্দিত বুদ্ধিজীবী”দের একচ্ছত্র আধিপত্যও থাকবে না।
চাইলে “অপশনাল স্লট” রাখা যেতে পারে। যে সংস্কার প্রস্তাবে কোনো নাগরিক আলাদা করে ‘না’ ভোট দিতে চান, সংস্কারের নাম্বার উল্লেখ করে সেটি দিতে পারবেন। যেমন ৬৮ নম্বর সংস্কারে ফরিদপুর ও কুমিল্লা বিভাগ গঠনের কথা আছে; ওই অঞ্চলের জনগণের আলাদা মত থাকতে পারে। যারা অপশনাল ভোট দেবেন না, তাদের জন্য সেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ‘হ্যাঁ’ হিসেবে গণ্য হবে। আর যাদের মৌলিক আপত্তি আছে পুরো সনদ নিয়েই, তাদের জন্য তো এক্সপ্লিসিট ‘না’ ভোটের অপশন থাকছেই। এই পদ্ধতিতে জুলাই সনদে যে জনগনের অংশ গ্রহণ অনুপস্থিত ছিল তা ঘনিয়ে আসবে।
জুলাই বিপ্লব শুরু হয়েছিল রাজপথে, ক্লোজ ডোর মিটিঙে নয়। যদি ৯০ এর গণ অভ্যুথানের মত জুলাইও রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতার লড়াইয়ে পরিণত হয়, তবে সেই বিপ্লবের চেতনা বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হবে আবার। কিন্তু যদি নাগরিকরা স্পষ্টভাবে নিজেদের মত প্রকাশ করতে পারেন, সংস্কারে অংশগ্রহণ করতে পারেন, তবে এই সনদ হতে পারে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সত্যিকারের সম্মিলিত নাগরিক রচনা। বিপ্লব উত্তর বাংলাদেশ তাই নির্ভর করছে একটাই বিষয়ের ওপর: রাজনীতিকে আমরাই লেখবো, নাকি টপ ১% এর হাতে ছেড়ে দেব?
ইফতেখার তামিম,স্বাধীন লেখক।
