দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ভেনেজুয়েলা বহু বছর ধরেই রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক ধস আর আন্তর্জাতিক চাপের মুখে আছে। পরিস্থিতি এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, অনেক বিশ্লেষক সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সঙ্গে এর তুলনা করছেন। প্রশ্ন উঠছে—ভেনেজুয়েলাও কি শেষ পর্যন্ত সিরিয়ার মতো ভয়াবহ গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে?
এই প্রবন্ধে আমরা সহজভাবে আলোচনা করবো—ভেনেজুয়েলার সংকট, সরকারবিরোধী বিক্ষোভ, যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ ও ভূমিকা, আন্তর্জাতিক শক্তির দ্বন্দ্ব, এবং দক্ষিণ আমেরিকার রাজনীতিতে এর প্রভাব।
তেলের অভিশাপ: অর্থনৈতিক পতনের শুরু
ভেনেজুয়েলা পৃথিবীর অন্যতম বড় তেলসমৃদ্ধ দেশ। তেলই তাদের অর্থনীতির মূল ভরসা। ১৯৯৯ সালে হুগো শাভেজ ক্ষমতায় আসেন এবং তেল আয়ের ওপর ভর করে দরিদ্রদের জন্য নানা কল্যাণমূলক কর্মসূচি চালু করেন। কিছুদিন এর সুফলও পাওয়া যায়।
কিন্তু একদিকে তেলের দাম ওঠানামা, অন্যদিকে দুর্নীতি আর অদক্ষ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা—এসব মিলে ধীরে ধীরে অর্থনীতি দুর্বল হতে থাকে। সরকার অন্য কোনো খাত গড়ে তুলতে পারেনি। ২০১৪ সালে তেলের দাম হঠাৎ পড়ে গেলে রাজস্ব কমে যায়।
তারপর শুরু হয় ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতি। খাদ্য, ওষুধ, নিত্যপণ্যের তীব্র সংকট দেখা দেয়। কোটি কোটি মানুষ কাজ ও নিরাপত্তার খোঁজে দেশ ছাড়তে থাকে। অর্থনৈতিক ধস জনজীবনে এত বড় আঘাত হানে যে তা রাজনৈতিক সংকটের আগুনে ঘি ঢালে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিরোধী আন্দোলন
হুগো শাভেজের মৃত্যুর পর ২০১৩ সালে নিকোলাস মাদুরো ক্ষমতায় আসেন। শুরু থেকেই তাকে নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। বিরোধীরা তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলে।
২০১৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে অনেকে অনিয়মপূর্ণ বলে মনে করে। পশ্চিমা দেশগুলো ফলাফল মেনে নেয়নি। ২০১৯ সালে বিরোধী নিয়ন্ত্রিত জাতীয় পরিষদের প্রধান হুয়ান গুইদো নিজেকে অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন। যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছু দেশ তাকে স্বীকৃতি দেয়।
এর ফলে দেশটি কার্যত দুই শিবিরে ভাগ হয়ে যায়। রাস্তায় নেমে আসে বিক্ষুব্ধ জনগণ। নিরাপত্তা বাহিনীর কঠোর দমন-পীড়নে অনেক মানুষ নিহত বা গুম হয়। দেশের ভেতরে আস্থা ও স্থিতি ভেঙে পড়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ ও ভূমিকা
ভেনেজুয়েলার তেলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ অনেক পুরোনো। বহু বছর ধরে দেশটি যুক্তরাষ্ট্রে তেল রপ্তানি করত। কিন্তু শাভেজ ক্ষমতায় আসার পর থেকে দুই দেশের সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। শাভেজ যুক্তরাষ্ট্রকে “সাম্রাজ্যবাদী শক্তি” বলে সমালোচনা করতেন এবং রাশিয়া, চীন, ইরানসহ মার্কিনবিরোধী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করেন।
ওয়াশিংটন এই ঘনিষ্ঠতা ভালো চোখে দেখেনি। ২০১৭ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তেল রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়, সরকারের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হয়, এমনকি ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানির সম্পদও আটকে দেওয়া হয়।
যুক্তরাষ্ট্র মনে করে—মাদুরোকে ক্ষমতাচ্যুত করে গুইদোর নেতৃত্বে নতুন সরকার প্রতিষ্ঠা করলে দেশটি আবার গণতান্ত্রিক পথে ফিরবে এবং মার্কিন স্বার্থও সুরক্ষিত হবে।
কিন্তু এই নীতি উল্টো ফল দেয়। নিষেধাজ্ঞায় সাধারণ মানুষ আরও কষ্টে পড়ে, দেশীয় অর্থনীতি প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। মাদুরো বরং অভ্যন্তরীণ সমর্থন জোগাড় করতে পারে এই যুক্তি দেখিয়ে যে, যুক্তরাষ্ট্র দেশকে “শ্বাসরোধ” করছে।
অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক সমাধান খোঁজার বদলে চাপ বাড়িয়ে দেশটিকে অস্থিতিশীল করেছে। এটা সিরিয়ার সংকটের সঙ্গে তুলনা টেনে আনে—যেখানে বাইরের শক্তির হস্তক্ষেপ যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করেছিল।
আন্তর্জাতিক শক্তির দ্বন্দ্ব
ভেনেজুয়েলা আজ কেবল একটি দেশের সমস্যা নয়, বরং বড় শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতার ময়দান।
রাশিয়া মাদুরোর ঘনিষ্ঠ মিত্র। তারা ঋণ দিয়েছে, তেল ও সামরিক সহযোগিতা করেছে। তাদের সামরিক উপদেষ্টারাও ভেনেজুয়েলায় কাজ করছে।
চীন বিপুল বিনিয়োগ করেছে এবং তেলের বিনিময়ে অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়েছে। চীনের জন্য ভেনেজুয়েলা একদিকে বিনিয়োগের জায়গা, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষেত্র।
ইরানও মাদুরোর পাশে দাঁড়িয়েছে। তারা তেল শোধনাগার চালাতে যন্ত্রাংশ ও জ্বালানি পাঠিয়েছে।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা মাদুরোবিরোধী শিবিরকে সমর্থন করছে।
এইভাবে ভেনেজুয়েলা বিদেশি স্বার্থের টানাপোড়েনে পড়েছে। দেশের সংকট সমাধানের বদলে এই দ্বন্দ্ব আরও জটিল করেছে, ঠিক যেমন সিরিয়ায় বিভিন্ন শক্তি নিজেদের স্বার্থে হস্তক্ষেপ করে যুদ্ধ থামতে দেয়নি।
সিরিয়ার সঙ্গে মিল ও অমিল
ভেনেজুয়েলা ও সিরিয়ার মধ্যে কিছু মিল আছে—
- দুই দেশেই শাসক ও বিরোধী গোষ্ঠীর মধ্যে তীব্র সংঘাত এবং বিদেশি শক্তির সমর্থনে মেরুকরণ।
- দুদেশেই বিপুলসংখ্যক মানুষ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে।
- বাইরের হস্তক্ষেপে সমস্যা সমাধান না হয়ে বরং আরও জটিল হয়েছে।
তবে বড় অমিলও আছে—
- সিরিয়ায় আন্দোলন দ্রুত সশস্ত্র সংঘর্ষ ও গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়; ভেনেজুয়েলায় এখনো তা হয়নি।
- ভেনেজুয়েলা দক্ষিণ আমেরিকায় অবস্থিত, যেখানে প্রতিবেশী দেশগুলো সামরিক হস্তক্ষেপে আগ্রহী নয়।
- ভেনেজুয়েলার সেনাবাহিনী এখনো সরকারের প্রতি অনুগত এবং ভেঙে পড়েনি।
তাই সিরিয়ার মতো পরিণতি অবশ্যম্ভাবী নয়। কিন্তু রাজনৈতিক সমাধান না হলে সহিংসতার ঝুঁকি বাড়তে পারে।
দক্ষিণ আমেরিকার রাজনীতিতে প্রভাব
ভেনেজুয়েলার সংকট গোটা দক্ষিণ আমেরিকাকে প্রভাবিত করেছে:
১. শরণার্থী সংকট: জাতিসংঘের হিসাবে ৭০ লাখেরও বেশি ভেনেজুয়েলীয় মানুষ দেশ ছেড়ে চলে গেছে। কলম্বিয়া, ব্রাজিল, পেরু, ইকুয়েডরসহ প্রতিবেশী দেশগুলোতে তারা আশ্রয় নিচ্ছে। এত বড় সংখ্যক শরণার্থী স্থানীয় অর্থনীতি, চাকরির বাজার ও সামাজিক অবকাঠামোর ওপর চাপ ফেলছে।
২. রাজনৈতিক বিভাজন: লাতিন আমেরিকার দেশগুলোও এই সংকট নিয়ে বিভক্ত হয়ে গেছে। ডানপন্থী সরকারগুলো মাদুরোবিরোধীদের সমর্থন করছে, বামপন্থীরা মাদুরোর পাশে দাঁড়াচ্ছে। ফলে আঞ্চলিক সহযোগিতা দুর্বল হয়েছে।
৩. অপরাধ ও নিরাপত্তা: সীমান্ত এলাকায় অবৈধ অস্ত্র, মাদক ও মানব পাচারের ঝুঁকি বেড়েছে। সীমান্তবর্তী দেশগুলোকে সীমান্তরক্ষায় বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে।
৪. আঞ্চলিক নেতৃত্বের প্রশ্ন: আগে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য নেতৃত্ব দিত। এখন তারাও নিজ নিজ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যায় ব্যস্ত। ফলে আঞ্চলিক নেতৃত্বের শূন্যতা তৈরি হয়েছে, যা সংকটকে দীর্ঘায়িত করছে।
এইসব কারণে ভেনেজুয়েলার সংকট শুধু একটি দেশের নয়, দক্ষিণ আমেরিকার স্থিতিশীলতা ও ভবিষ্যতের সঙ্গেও গভীরভাবে জড়িত।
সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ
ভেনেজুয়েলার সামনে কয়েকটি পথ খোলা আছে। প্রতিটি পথ দেশটির রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সাধারণ মানুষের জীবনের ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।
১. কূটনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধান
সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত এবং দেশের জন্য মঙ্গলজনক পথ হলো রাজনৈতিক সংলাপ ও আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতার মাধ্যমে সমাধান।
সরকার যদি ধীরে ধীরে নির্বাচনী ব্যবস্থা স্বচ্ছ করে, বিরোধীদের অংশগ্রহণের সুযোগ দেয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতিতে নির্বাচন আয়োজন করে, তবে জনগণের আস্থা ফিরে আসতে পারে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা শিথিল হলে তেল রপ্তানি বাড়বে, যা অর্থনীতিকে কিছুটা চাঙ্গা করবে।
কূটনৈতিক সমাধান হলে দেশজুড়ে সহিংসতা কমবে, শরণার্থীদের অনেকেই ঘরে ফিরতে পারবে। তবে এই পথের জন্য উভয় পক্ষেরই ছাড় দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে, যা এখনো দেখা যাচ্ছে না।
২. দীর্ঘস্থায়ী অচলাবস্থা
দ্বিতীয় সম্ভাবনা হলো বর্তমান অচলাবস্থা চলতে থাকা।
যদি সরকার ক্ষমতা ছাড়তে রাজি না হয় এবং বিরোধীরাও সমঝোতায় না আসে, তবে রাজনৈতিক অচলাবস্থা চলবে। নিষেধাজ্ঞা এবং দুর্নীতির কারণে অর্থনীতি উন্নত হবে না। সাধারণ মানুষ খাদ্য ও ওষুধের সংকটে ভুগতে থাকবে, অভিবাসনের ঢল অব্যাহত থাকবে। সমাজে ক্ষোভ ও হতাশা বাড়বে, যা মাঝেমধ্যে সহিংস প্রতিবাদের রূপ নিতে পারে। এই পরিস্থিতি সিরিয়ার মতো গৃহযুদ্ধ না হলেও দীর্ঘস্থায়ী মানবিক বিপর্যয় তৈরি করবে।
৩. সহিংস সংঘাত ও গৃহযুদ্ধের ঝুঁকি
সবচেয়ে ভয়ংকর পথ হলো গৃহযুদ্ধ বা বড় ধরনের সহিংস সংঘাত।
যদি সেনাবাহিনীর ভেতরে বিভাজন দেখা দেয় বা বিদেশি শক্তি সরাসরি হস্তক্ষেপ করে, তবে সংঘর্ষ দ্রুত বাড়তে পারে। তখন বিভিন্ন গোষ্ঠী নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা তৈরি করতে চাইবে, যা সিরিয়ার অভিজ্ঞতার মতো দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ ও ধ্বংসযজ্ঞের দিকে নিয়ে যেতে পারে। এই পরিস্থিতিতে শরণার্থী সংকট আরও ভয়াবহ আকার নেবে এবং পুরো দক্ষিণ আমেরিকার স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়বে।
বর্তমানে সেনাবাহিনী সরকারের পক্ষে থাকায় এই সম্ভাবনা গুরুতর নয়, তবে রাজনৈতিক সমাধান ব্যর্থ হলে ঝুঁকিটা ধীরে ধীরে বেড়ে উঠবে।
৪. আঞ্চলিক হস্তক্ষেপ বা সমন্বিত উদ্যোগ
আরেকটি সম্ভাবনা হলো দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো আঞ্চলিক সংস্থাগুলোর মাধ্যমে (যেমন OAS বা CELAC) সক্রিয় হয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য একযোগে উদ্যোগ নেয়।
শরণার্থী সংকট ও সীমান্ত নিরাপত্তা নিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর উদ্বেগ বাড়ছে। তাই তারা একসময় চাপ প্রয়োগ করতে পারে বা মধ্যস্থতা করতে পারে। আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়লে সংকট প্রশমিত হতে পারে, যদিও এখনো দেশগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন থাকায় এটি কঠিন।
সিরিয়ার পথে না হাঁটার সুযোগ
ভেনেজুয়েলার সংকট গভীর হলেও এখনো তা সিরিয়ার মতো ভয়াবহ গৃহযুদ্ধে পরিণত হয়নি। দেশটি সেই সীমানা অতিক্রম করার আগেই সমাধানের সুযোগ আছে।
দরকার হচ্ছে—রাজনৈতিক সংলাপ, জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার, এবং বিদেশি শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতার বদলে গঠনমূলক সহযোগিতা। যুক্তরাষ্ট্রসহ বৈশ্বিক শক্তিগুলো যদি নিজেদের স্বার্থের বাইরে গিয়ে জনগণের কল্যাণে এগোয়, তবে এই দেশ সিরিয়ার পথ এড়িয়ে স্থিতিশীলতা ফিরে পেতে পারে। তা না হলে দক্ষিণ আমেরিকার কেন্দ্রস্থলে একটি দেশ ধীরে ধীরে গৃহযুদ্ধ ও অস্থিরতার গভীর খাদে নেমে যাবে, যার অভিঘাত গোটা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে।
সংকট সমাধানের সময় এখনো ফুরিয়ে যায়নি, কিন্তু তা দ্রুত কমে আসছে।
মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন।
