চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৈসর্গিক ক্যাম্পাসটি আজ আর তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য আলোচনার কেন্দ্রে নেই, বরং পরিণত হয়েছে এক রাজনৈতিক রণাঙ্গনে, যেখানে প্রশাসনের চরম ব্যর্থতা ও উদাসীনতা ছাত্রসমাজকে এক নতুন সংকটের মুখে দাঁড় করিয়েছে। ‘অধিকার সচেতন শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে ৯ জন শিক্ষার্থীর আমরণ অনশনের ঘটনাটি কেবল একটি বিচ্ছিন্ন প্রতিবাদ নয়, এটি রাজনৈতিক নিপীড়ন, প্রশাসনিক দায়িত্বহীনতা এবং বিচারহীনতার বিরুদ্ধে এক তীব্র গণ-বিস্ফোরণ। যে বিশ্ববিদ্যালয়কে একদা মুক্তচিন্তা ও প্রগতির প্রতীক ভাবা হতো, আজ তা এক প্রহসনের মঞ্চে পরিণত হয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থীদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়।
অনশন কর্মসূচিতে যোগ দেন বাংলা বিভাগের স্নাতকোত্তরের (মাস্টার্স) শিক্ষার্থী ওমর সমুদ্র, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের সংগঠক ধ্রুব বড়ুয়া, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি জশদ জাকির, সাংগঠনিক সম্পাদক রাম্রা সাইন মারমা, রাজনৈতিক শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক আহমেদ মুগ্ধ, দপ্তর সম্পাদক নাইম শাহজাহান, নারী অঙ্গনের সংগঠক সুমাইয়া শিকদার, বিপ্লবী ছাত্র যুব আন্দোলনের সংগঠক ঈশা দে ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সুদর্শন চাকমা।
কিন্তু এ কেমন তামাশা চলছে? চট্টগ্রামের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা যখন নিজেদের নিরাপত্তা আর ন্যায্য অধিকারের জন্য রাস্তায় নেমেছে, অনশন করছে, তখন তাদের ন্যূনতম চিকিৎসাও দেওয়া হচ্ছে না। এটা কি কোনো সভ্য সমাজের চিত্র হতে পারে?
ধিক্কার জানাই সেই প্রশাসনকে, যারা ছাত্রদের এই দুর্দশার মধ্যেও নিজেদের ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে বসে আছে। মেডিকেল টিমকে ঘটনাস্থলে পাঠানোর সামান্য মানবিকতাটুকুও তাদের নেই।
অসুস্থ শিক্ষার্থীদের হাসপাতালে নিয়ে আসার কথা বলে তারা আসলে কী বোঝাতে চাইছে? ছাত্রদের জীবন নিয়ে কি তারা ছিনিমিনি খেলছে না?
ধ্রুবর রক্তচাপ আশঙ্কাজনকভাবে নেমে যাচ্ছে (৪০ এ নেমে এসেছে), জাকিরের হার্টের সমস্যা হচ্ছে, তখনো তারা নির্বিকার। সুদর্শনের উচ্চ রক্তচাপ, সুমাইয়ার কমে যাওয়া রক্তচাপ—এই প্রতিটি খবর কি তাদের বিবেককে একটুও নাড়া দেয় না?
এটা কেবল শিক্ষার্থীদের শারীরিক অসুস্থতা নয়, এটা সমাজের অসুস্থতা, প্রশাসনের চরম ব্যর্থতা। ছাত্রদের ন্যায্য দাবির প্রতি তাদের এই অবহেলা, এই উদাসীনতা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। আজ যদি ছাত্রদের কিছু হয়, তার দায়ভার কে নেবে? এই প্রশ্নের উত্তর প্রশাসনকে দিতেই হবে।
আর কতদিন চলবে এই প্রহসন? ছাত্রদের জীবনের চেয়ে কি তাদের ক্ষমতার মসনদ বেশি মূল্যবান?
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান সংকট কেবল রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক ব্যর্থতার গল্প নয়, এটি উচ্চশিক্ষার পবিত্রতা ও একাডেমিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের এক করুণ চিত্র। যখন কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসন শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, তখন সেই ব্যর্থতা কেবল প্রশাসনিক দুর্বলতা হিসেবে থাকে না, বরং তা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌলিক উদ্দেশ্যকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। অনশনরত শিক্ষার্থীদের দুর্দশা দেখেও যখন প্রশাসন নির্লিপ্ত থাকে, তখন এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, এই প্রতিষ্ঠান তার একাডেমিক দায়িত্ববোধ কতটা হারিয়ে ফেলেছে।
গত ৩০ ও ৩১ আগস্টের সংঘর্ষে ১৫০০ শিক্ষার্থীর আহত হওয়ার মতো একটি ভয়াবহ ঘটনার পর, প্রশাসনের উচিত ছিল দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া। কিন্তু প্রক্টরিয়াল বডি তাদের দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে এক নির্লজ্জ ঔদ্ধত্যের আশ্রয় নিয়েছে। প্রক্টর যখন শিক্ষার্থীদের জীবনের ঝুঁকিকে তুচ্ছ করে ‘ছুটিতে আছেন’ বলে দায় এড়ান, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এই পদটি কেবল ক্ষমতার জন্য, দায়িত্ব পালনের জন্য নয়। ভারপ্রাপ্ত প্রক্টরের শিক্ষার্থীদের ফোন না ধরা এই অযোগ্যতারই আরেক নির্লজ্জ প্রমাণ। যখন শিক্ষার্থীদের রক্ত ঝরছে, যখন তাদের আবাসিক হলগুলো অনিরাপদ, তখন প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের এই আচরণ কেবল দায়িত্বহীনতাই নয়, এটি শিক্ষার্থীদের প্রতি এক ধরনের বিদ্রূপ।
বিশ্ববিদ্যালয় হলো মুক্তচিন্তা ও জ্ঞানের চর্চার কেন্দ্র, যেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক গড়ে ওঠে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই সম্পর্কই প্রশ্নবিদ্ধ। একজন প্রক্টরের কাজ কেবল প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করা নয়, তিনি একজন শিক্ষকও। শিক্ষার্থীদের দুঃসময়ে তার ‘ছুটিতে থাকা’ বা তাদের ন্যায্য দাবিকে উপেক্ষা করা একজন শিক্ষকের নৈতিক দায়িত্বের পরিপন্থী। এটি প্রমাণ করে, শিক্ষকদের একাংশ রাজনৈতিক আনুগত্যের কাছে তাদের পেশাদারিত্ব বিসর্জন দিয়েছেন। যখন শিক্ষক সমাজ তাদের শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক স্বকীয়তা বলতে আর কিছু থাকে না। এই ঘটনা প্রশ্ন তোলে: বিশ্ববিদ্যালয় কি এখন জ্ঞানচর্চার পরিবর্তে রাজনৈতিক ক্ষমতার একটি বর্ধিত কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে?
প্রশাসনের এই ঔদ্ধত্য আরও স্পষ্ট হয় যখন ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ‘একাডেমিক পরিবেশ বিঘ্নকারী’ বলে মন্তব্য করেন। এই মন্তব্যে যে উন্নাসিকতা লুকিয়ে আছে, তা এক কথায় অবিশ্বাস্য। যারা নিজেদের মৌলিক অধিকার আদায়ের জন্য অনশন করছে, তাদেরকেই তিনি দোষারোপ করছেন। তার এই কথাগুলো আসলে প্রমাণ করে, প্রশাসনের কাছে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নয়, বরং তাদের ‘শান্তি’ বেশি গুরুত্বপূর্ণ—যে শান্তি আসলে একধরনের ভয় এবং পরাধীনতার ফল। তাদের কাছে প্রতিবাদ মানেই ‘পরিবেশ বিঘ্ন’, আর নীরবতা মানেই ‘স্থিতিশীলতা’। এই মানসিকতা একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কখনোই এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে না।
একটি সুশৃঙ্খল ও নিরাপদ পরিবেশ ছাড়া কোনো ধরনের গবেষণা বা উচ্চশিক্ষার মান উন্নত হতে পারে না। যখন শিক্ষার্থীরা নিজেদের জীবন ও নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত থাকে, তখন তাদের পক্ষে মন দিয়ে পড়াশোনা বা গবেষণায় মনোযোগ দেওয়া অসম্ভব। ১৫০০ শিক্ষার্থীর আহত হওয়া এবং তাদের পরবর্তীতে অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকা একটি সুস্থ একাডেমিক পরিবেশের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
এই পরিস্থিতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের অযোগ্যতা কেবল প্রশাসনিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি সরাসরি একাডেমিক পরিবেশকেও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। প্রশাসন যদি শিক্ষার্থীদের মৌলিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারে, তবে তারা কীভাবে উন্নতমানের গবেষণা বা শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করবে? প্রক্টরের মতো একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার টিকটক ভিডিও তৈরি করা বা নারী শিক্ষার্থীদের প্রতি অশোভন মন্তব্য করা কেবল ব্যক্তিগত অযোগ্যতা নয়, এটি পুরো প্রশাসনিক কাঠামোর নৈতিক অবক্ষয়ের লক্ষণ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রামবাসীর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনাটি কেবল একটি সাধারণ সংঘাত ছিল না, এটি ছিল প্রশাসনের চরম অযোগ্যতা ও দায়িত্বহীনতার এক জ্বলন্ত উদাহরণ। এই ঘটনার সময় মধুফাঁদ খ্যাত প্রক্টর তানভীর হায়দার আরিফ এবং প্রোভিসি ড. মো. কামাল উদ্দিনের ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকার দৃশ্যটি কোনো সাহসিকতার পরিচয় দেয় না, বরং তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলে। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের এত বড় সংকট চলাকালে প্রক্টর ও প্রোভিসির কাজ কি শুধু ক্যামেরার সামনে পোজ দেওয়া? তাদের এই ‘ফুটেজখোরি’ প্রমাণ করে যে, তাদের কাছে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নয়, বরং নিজেদের ইমেজ রক্ষা করাই ছিল আসল উদ্দেশ্য।
প্রশাসনের এই প্রহসন আরও স্পষ্ট হয় যখন আমরা দেখি, সংঘর্ষের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ পরীক্ষা চলছিল। এর ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পুরো দল একাডেমিক ভবনের দিকে ব্যস্ত ছিল। এটা কি নিছকই কাকতালীয়? নাকি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই সংঘাতকে পরিকল্পিতভাবে নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয়েছে, যা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপ্রস্তুত অবস্থাকে আরও প্রকট করে তুলেছে? একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের উচিৎ ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে সংঘর্ষের শান্তিপূর্ণ সমাধান করা, উপজেলা চেয়ারম্যান এবং স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে বসে দ্রুত একটি কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। কিন্তু তারা তা না করে নিজেদের ‘শহীদ’ প্রমাণ করার জন্য সংঘর্ষের কেন্দ্রে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন।
প্রোভিসির মিডিয়ার সামনে কান্না কোনো অভিভাবকের কান্না ছিল না। একজন সত্যিকারের অভিভাবক এমন পরিস্থিতিতে ক্যামেরার সামনে কান্নাকাটি না করে শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করার চেষ্টা করেন। সেই কান্না ছিল একটি নাটক, যা টিভিতে প্রচারিত সস্তা সিরিয়ালের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। এই কান্না প্রশাসনিক ব্যর্থতার কান্না নয়, বরং এটি ছিল নিজেদের ব্যর্থতাকে আবেগ দিয়ে ঢেকে রাখার এক নির্লজ্জ চেষ্টা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ ধরনের আচরণ সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য এবং তা নৈতিকতার সব সীমা অতিক্রম করে। যখন এই ধরনের ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয় না, তখন এটি শিক্ষার্থীদের কাছে একটি ভুল বার্তা দেয়। এটি প্রমাণ করে, বিশ্ববিদ্যালয়ের নৈতিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং এখানে মেধা ও যোগ্যতার চেয়ে রাজনৈতিক আনুগত্যই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়াও, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন তার শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেয়ে নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থানকে বেশি গুরুত্ব দেয়। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা তাদের কাছে ‘ফুটেজ’ এবং ‘টিভি সিরিয়ালের’ চেয়েও কম মূল্যবান। এটি কেবল একটি প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, এটি নেতৃত্বের নৈতিক অবক্ষয়, যেখানে একজন নেতা তার দায়িত্বকে উপেক্ষা করে ব্যক্তিগত প্রচারের নেশায় মত্ত হন। এই পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা তাদের নেতৃত্বকে ‘প্রিয় ষ্যাঁড়’ বলে যে উপাধি দিয়েছে, তা অত্যন্ত যৌক্তিক এবং যথার্থ।
এই সংকটের আরেকটি দিক হলো ভিন্ন মতাদর্শের শিক্ষার্থীদের ‘ডিহিউম্যানাইজ’ করা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ‘বাম’ বলে হেয় করা হচ্ছে, যা তাদের মানবিক অধিকারকে অস্বীকার করার একটি নির্লজ্জ অপপ্রয়াস। এই কৌশলটি বিগত ফ্যাসিবাদী আওয়ামী রেজিমে ভিন্নমতাবলম্বীদের ‘শিবির’ বলে হেয় করার মতোই একটি রাজনৈতিক কৌশল। যখন কোনো ছাত্রকে তার রাজনৈতিক আদর্শ দিয়ে চিহ্নিত করা হয়, তখন তার উপর যেকোনো ধরনের নির্যাতনকে বৈধতা দেওয়া সহজ হয়। এই ডিহিউম্যানাইজেশনের ফলে প্রশাসন নির্দ্বিধায় শিক্ষার্থীদের দাবি উপেক্ষা করতে পারে এবং তাদের প্রতি কঠোর হতে পারে।
যদিও এতো সংকটের মাঝেও একটি উজ্জ্বল দিক হলো ছাত্রসমাজের ঐক্য। বামপন্থী সংগঠন, স্টুডেন্টস এলায়েন্স ফর ডেমোক্রেসি (স্যাড), জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র মজলিসের মতো ভিন্ন মতাদর্শের ছাত্রনেতারা একযোগে এই দাবির প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছেন। এটি প্রমাণ করে যে, যখন শিক্ষার্থীদের অস্তিত্ব সংকটাপন্ন হয়, তখন রাজনৈতিক বিভাজন গৌণ হয়ে যায়। এই ঐক্য প্রশাসনকে একটি পরিষ্কার বার্তা দিয়েছে যে, তাদের নিপীড়নমূলক কৌশল আর কাজ করবে না। শিক্ষার্থীরা বুঝতে পেরেছে, তাদের প্রধান শত্রু কোনো রাজনৈতিক দল নয়, বরং এই অযোগ্য ও দায়িত্বহীন প্রশাসন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চলমান অনশন কেবল ক্যাম্পাসের ভেতরের খবর নয়, এটি আজ জাতীয় গণমাধ্যমের শিরোনাম। দ্য ডেইলি স্টার, প্রথম আলো, সমকাল, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, দ্য কমন রান এবং টাইমস অফ বাংলাদেশের মতো শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমগুলো এই অনশনকে গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছে। এটি প্রমাণ করে এই সংকটের ব্যাপ্তি কতটা বিস্তৃত।
কিন্তু এই সত্যের লড়াইয়ে একটি অন্ধকার দিকও আছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (চবিসাস) বা তাদের মতো কিছু সংবাদকর্মীর ভুল তথ্য ছড়ানোর চেষ্টা এই লড়াইকে আরও জটিল করে তুলেছে। তারা প্রশাসনকে রক্ষা করতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে নেমেছেন। কিন্তু তাদের এই কৌশল বারবার ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, শিক্ষার্থীরা শুধু প্রচলিত গণমাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল থাকেনি, বরং তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করে নিজেদের কণ্ঠস্বরকে ছড়িয়ে দিয়েছে।
এই আন্দোলন কেবল কিছু দাবি আদায়ের জন্য নয়, এটি বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বিরাজমান রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, অযোগ্য প্রশাসন এবং জবাবদিহিতার অভাবের বিরুদ্ধে এক সম্মিলিত প্রতিরোধ। এই গণ-আদালতে ছাত্রসমাজ বিচারপ্রার্থী, আর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছে সেই প্রশাসন, যারা তাদেরই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ। এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কেবল প্রক্টরের পদত্যাগ যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন একটি সুদূরপ্রসারী সমাধান, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন এবং শিক্ষার্থীদের অধিকারকে নিশ্চিত করবে।
সমাজের শত অনিয়ম, নিপীড়ন আর অবিচারের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে লড়ে যাওয়া এই মানুষগুলো চিরকালই একা। তাদের লড়াইয়ের ইতিহাস যেন এক অন্তহীন করুণ গাথা। সুদূর নীলফামারীর অচেনা শ্রমিকের রক্ত ঝরলে সবার আগে প্রতিবাদ জানায় এরাই, যখন অন্য নেতারা নিজেদের ক্ষমতার হিসেব কষতে ব্যস্ত থাকেন। অনলাইনে যখন নারীদের নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করা হয়, তখন প্রতিবাদে গর্জে ওঠে এরাই, যখন তথাকথিত ‘জনপ্রিয়’ নেতারা নিশ্চুপ থাকেন। ঋণের বোঝা সইতে না পেরে কোনো কৃষক আত্মহত্যা করলে, সেই নীরব আর্তনাদের আওয়াজ হয়ে ওঠে এরাই।
বড় বড় জনবল আর সমর্থন নিয়ে চলা নেতারা যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকেন, তখন এই মানুষগুলোই আপনাদের জন্য লড়ে যায়। যখন আপনার জীবনে অন্যায় নেমে আসবে, তখনও দেখবেন এরাই সবার আগে আপনার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, আর আপনার প্রিয় নেতারা তখনো নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়েই থাকবে। এই মানুষগুলোর লড়াইয়ের পথ বড়ই নিঃসঙ্গ, কিন্তু তবুও তারা লড়ে যায়। তাদের এই একা হয়ে লড়ে যাওয়ার সাহস আর দৃঢ়তা কেবল করুণার নয়, শ্রদ্ধারও দাবি রাখে। শিক্ষার্থীদের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটছে, কিন্তু আমার বুঝা আসে না, এ কোন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন প্রশাসন? নাকি জেগে জেগে ঘুমোচ্ছেন তাঁরা? তাহলে তো হাজার ডেকেও জাগানো অসম্ভব।
এই পুরো ঘটনাটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে একটি কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে: আপনারা কি একটি জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র পরিচালনা করছেন, নাকি একটি রাজনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্র? যদি আপনারা শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও একাডেমিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে না পারেন, তবে এই প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বই প্রশ্নবিদ্ধ।
সাজিদ সামী চৌধুরী।লেখক,সম্পাদক, দ্য কমন রান।শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, চিটাগাং ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি।