১.
জুলাই শাহবাগ বা শাপলা— কোনোটারই ধারাবাহিকতা না। জুলাই স্রেফ শাহবাগের বা শাপলার এন্টিথিসিসও না। জুলাই একটা সিন্থেসিস। শাপলা-শাহবাগের রক্তাক্ত লড়াই থেকে জন্ম নেওয়া একটা নতুন পরিসর।
২.
শাহবাগ ও শাপলা— কোনোটাই সরলরৈখিক, একাট্টা ও জল-অচল ধরনের বর্গ না। সমস্ত ‘সেক্যুলার’ ফোর্স শাহবাগ, ফলত খারাপ, ফ্যাসিস্ট ও জালিম; এবং সমস্ত ‘ইসলামিস্ট’ ফোর্স শাপলা, ফলত ভালো, গণতান্ত্রিক/কম ফ্যাসিস্ট ও মজলুম— শাহবাগ-শাপলার এই ধরনের তত্ত্বায়ন চরম মাত্রার ইতিহাসবিকৃতি ও ফলস কনশাসনেসের উপর দাঁড়ানো। এই তত্ত্বায়ন বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ।
শাহবাগে বহু মানুষ স্রেফ যুদ্ধাপরাধের বিচার চাইতে গিয়েছিলেন। শাপলায় বহু মানুষ স্রেফ রাসুলের (সা.) অবমাননার বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়েছিলেন। এবং যেহেতু এই দুইটা ব্যাপার মিউচুয়ালি এক্সক্লুসিভ না, তাই একই মানুষ শাহবাগে ছিলেন, আবার শাপলায়ও গেছেন— এমন নজির অনেক। শাহবাগ ও শাপলার ‘গণ-ইতিহাস’ লেখা হলে সেই দিকটা স্পষ্ট হবে।
৩.
যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবি ছিল একটা সার্বজনীন দাবি। জামায়াতে ইসলামি তাদের একাত্তর থিসিসের কোনো পর্যালোচনা কিংবা পুনর্মূল্যায়ন ছাড়াই রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হওয়ায়, যুদ্ধাপরাধের ইস্যুটি ক্রমে জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠতে থাকে। আ. লীগ যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রশ্নটাকে আরো জটিল, বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। এতে শাহবাগেরও দায় আছে।
কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যুতে শাহবাগের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জের জুলাইয়ের উপর চাপিয়ে, জুলাইকে পুরাতন বাইনারির মধ্যে ঢুকানো যাবে না। জুলাই ইনজাস্টিসের প্রতিকার হিশাবে আসছে বটে; কিন্তু যুদ্ধাপরাধের ইনডেমনিটি হিশাবে আসে নাই।
৪.
‘শাহবাগ’র বিপরীতে শাপলা চত্বরের যে জমায়েত, সেখানে কিন্তু যুদ্ধাপরাধের ব্যাপারে কোনো কথাই ছিল না। হেফাজতের যে ১৩ দফা এই সমাবেশের মূল ডকুমেন্ট, সেখানে যুদ্ধাপরাধের দায়মুক্তির কোনো তর্ক ছিল না। বরং যুদ্ধাপরাধের একটি সুষ্ঠু বিচার আলেমরাও চাইতেন। ফলে যুদ্ধাপরাধের কথা বলা মানেই ‘শাহবাগি’ হওয়া না।
একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকা, তৎকালীন অবস্থানের পর্যালোচনাহীন পুনর্বাসন, একাত্তরের অবস্থানটিকে নিজেদের মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক চিন্তায় আত্মীকরণ, যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবি, নিও-এথিজম এবং ওয়র অন টেররের প্রেক্ষিতে ‘ইসলাম বনাম মুক্তিযুদ্ধ’র বয়ানের (যে বয়ান তৈরিতে জামায়াত ও আওয়ামিপন্থী বুদ্ধিজীবীরা কমবেশি একই ধরনের ভূমিকা পালন করেছেন) উপর দাঁড়িয়ে যে ইসলামফোবিক সাংস্কৃতিক রাজনীতির ধারা তৈরি হয়েছিল, শাপলার প্রধান শক্তি হেফাজতে ইসলাম গণজাগরণ মঞ্চকে সেই ধারার একটি শক্তি হিশেবে পাঠ করে, এবং তাদের বিরুদ্ধে মাঠে নামে।
৫.
জামায়াত একাত্তরে নিজেদের অবস্থানকে ইসলামের মুখোমুখি করায় একাত্তর ও ইসলাম— দুটিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একাত্তর আ. লীগের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে; অন্যদিকে একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের বয়ানকে পুঁজি করে দেশে একটি ইসলামফোবিক সাংস্কৃতিক রাজনীতির ভাষা গড়ে উঠেছে। এতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রগঠন ও জাতিগঠনের প্রক্রিয়া মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জুলাইয়ের ঘাড়ে ভর করে যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে নিজেদের দলীয় ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ কেউ না নিলেই ভালো। তাতে জুলাই বিতর্কিত হওয়ার হাত থেকে বেঁচে যাবে। আওয়ামী ও ভারতীয় বয়ানের খপ্পর থেকেও বাঁচবে।
৬.
সম্প্রতি টিএসসিতে ছাত্রশিবিরের জুলাইকেন্দ্রিক একটি প্রোগ্রামে যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডিতদের ছবি প্রদর্শিত হলে, এটি নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। এ প্রসঙ্গে কয়েকটা কথা:
ক. ছাত্রশিবির জুলাইয়ের পরে সারাদেশে অসংখ্য আয়োজন করেছে; কেউ বাধা দেয় নাই। ফলে এই অনুষ্ঠানকে ঘিরে তৈরি হওয়া বিতর্কটিরে নিছক ‘শিবিরবিরোধিতা’র জায়গা থেকে প্রচারের অবকাশ নাই। ‘ইসলামবিরোধিতা’র জায়গা থেকে প্রচারের তো প্রশ্নই ওঠে না।
খ. ঢাবি শিবিরের বক্তব্য মোতাবেক, তারা বিচারিক হত্যাকাণ্ডের উদাহরণ হিসেবেই ছবিগুলো প্রদর্শন করেন। এই বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, খোদ শিবির এই নেতাদের সম্পূর্ণ ‘দায়মুক্ত’ মনে করে না। বরং বিচারটিকে প্রশ্নবিদ্ধ মনে করে। এ মনে করার সঙ্গত কারণ আছে।
কিন্তু এই প্রশ্নবিদ্ধ বিচারকে কেন্দ্র করে শিবির যদি তাদের সম্পূর্ণ ‘দায়মুক্ত’ মনে করে এবং প্রচার করে, তাহলে সেটি একটি ভিন্ন বয়ান। শিবির-সংশ্লিষ্টদের যুক্তিপদ্ধতিতে এই দুটি বিষয়ে কোনো স্পষ্ট বিভাজন দেখা যায় না। এ ব্যাপারে তাদের অবস্থান অস্পষ্ট।
গ. ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, জুলাইয়ের পর একাত্তরের দায় চুকিয়েই নতুনভাবে রাজনীতি শুরু করা উচিত জামায়াত ও শিবিরের।
৭.
টিএসসির ঘটনায় যারা প্রতিবাদ করেছেন, তাদের একাংশ নানাভাবে শাহবাগে সক্রিয় ছিলেন; এবং পরবর্তীতে শাহবাগের ব্যাপারে ক্রিটিক্যাল হয়েই তারা জুলাইয়ে এসে পৌঁছেছেন। তাদের তরফেও যুদ্ধাপরাধের বিচার ও শাহবাগের ভূমিকার পুনর্মূল্যায়ন জরুরি। আ. লীগ একটা প্রশ্নবিদ্ধ বিচারের মাধ্যমে খোদ যুদ্ধাপরাধ প্রশ্নটিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। আ. লীগের সেই দায় নিয়ে তাদের কথা বলা উচিত। পাশাপাশি, শাহবাগের ব্যাপারে তাদের স্পষ্ট ক্রিটিক্যাল অবস্থান নেওয়া উচিত।
আ. লীগ ও আওয়ামিপন্থীরা যে গভীর অপরায়ন, নিপীড়ন আর দমনমূলক ভাষা ও যুক্তিপদ্ধতি প্রয়োগ করে যুদ্ধাপরাধ প্রশ্নটিকে নিজেদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থে ব্যবহার করেছে, সেটির সাথে দূরত্ব রচনায় সক্ষম চিন্তা, ভাষা ও যুক্তিপদ্ধতি তৈরি করতে হবে।
এটাও মনে রাখতে হবে, নজরদারিমূলক মাফিয়া পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রক্ষমতার হাতে কাউকে উদোম জীবন বা বেয়ার লাইফ হিশেবে তুলে দেওয়া যাবে না। যুদ্ধাপরাধের বিচারের একটি আইনি প্রক্রিয়া এখনও চলমান, এবং সেটি যেন সুষ্ঠুভাবে চলমান থাকে, সেটাই আমরা চাই। কিন্তু বর্তমান জামায়াত ও শিবির যদি একাত্তরের থিসিস পরিবর্তন নাও করে, সে থিসিস প্রচার করে, তার মোকাবেলা চিন্তা ও চর্চার সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পাটাতনেই হওয়া উচিত। সে মোকাবেলার স্বতঃস্ফূর্ত গণচরিত্র থাকা উচিত; সে মোকাবেলা রিঅ্যাকশনারি না, একটা ভিশনারি রাজনীতির ভিত্তিতেই হওয়া উচিত। নজরদারিমূলক সর্বগ্রাসী রাষ্ট্র কিংবা ক্ষমতার কাছে সে মোকাবেলার ভার তুলে দিলে কী পরিণতি হয়, শাহবাগ ও শাপলা তারই প্রমাণ।
ফলে প্রশাসন বা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মাধ্যমে না, বরং চিন্তা ও চর্চার সামাজিক-সাংস্কৃতিক-বুদ্ধিবৃত্তিক পাটাতন থেকেই রাজনৈতিক বিরোধীদের মোকাবেলা করা উচিত। এটা জুলাইয়ের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।
৮.
পাশাপাশি এটিও খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার যে, শাহবাগে সক্রিয় না থাকা, শাহবাগের বিরোধী পক্ষে থাকা এবং জুলাইয়ের নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তি ও বর্গের বিশাল একটি অংশ এই ঘটনার প্রতিবাদ করেছে। জুলাইয়ের পর এদের সকলকে ‘শাহবাগি’ ট্যাগ দিয়ে মোকাবেলা করা যাবে না। ফলে কেন এটা ঘটে বা ঘটছে— এ ব্যাপারে জামায়াত-শিবিরের নতুন করে ভাবা জরুরি।
৯.
যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিপরীতে ধর্ম নিয়ে আসলে, বিরোধীদের ‘নাস্তিক’, ‘মুরতাদ’, ‘শাহবাগি’ ট্যাগ দিলে, পুরাতন জটিলতাই ফিরে আসবে কেবল। দেশে নতুন নতুন ‘রাজনৈতিক’ ও ‘সাংস্কৃতিক’ নাস্তিক ও মুরতাদ বর্গ তৈরি হবে। এটা সমাজ ও রাষ্ট্রে ভয়াবহ অস্থিরতা তৈরি করবে। ধর্ম দিয়ে এই দায়ের মোকাবেলা করতে গেলে খোদ জামায়াতও ভবিষ্যতে বিপদের মুখে পড়তে পারে।
মনে রাখা দরকার, দেলোয়ার হোসাইন সাইদীকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার অভিযোগেই গ্রেফতার করা হয়েছিল। তাছাড়া বাঙলাদেশে মূলধারার উলামারা জামায়াতের তাত্ত্বিক ভিত্তি মওদুদিবাদকে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক একটি ভ্রান্ত মতবাদ মনে করেন। জামায়াতের রাজনৈতিক চর্চাকেও ‘ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক’ মনে করেন ইসলামপন্থী বিভিন্ন বর্গ।
ফলে বিরোধীদের ধর্ম দিয়ে মোকাবেলা করার সংস্কৃতি তৈরি করলে, ভবিষ্যতে খোদ জামায়াত-শিবিরেরও সেই সংস্কৃতির শিকার হওয়া মোটেই অস্বাভাবিক না।
১০.
‘শাহবাগের বিচার’ নামক একটা ধারণার কথা শোনা যাচ্ছে এখন। এর মাধ্যমে ‘শাহবাগি’ নামক সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক বর্গটির আইনি বর্গে রূপান্তরের একটা আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে।
‘শাহবাগ’র বিচার চাওয়ার আগে, আমাদের কিছু পরিষ্কার বোঝাপড়ায় আসা লাগবে। একটি বৃহত্তর আন্দোলনকে বিচারের আওতায় আনা যায় কিনা— তা নিয়ে ভাবা লাগবে। শাহবাগের বিচার করার জন্য অন্তত কয়েকটা জটিল কাজ সম্পন্ন করা লাগবে:
ক. ‘শাহবাগি’ শব্দের বিচারযোগ্য আইনি সংজ্ঞা প্রণয়ন। এক্ষেত্রে কারা ‘শাহবাগি’ তা নির্ধারণ করতে হবে। এবং সেই সংজ্ঞা মোতাবেক সাধারণভাবে ‘শাহবাগি’ হওয়াটা অপরাধ কিনা, তা বিবেচনা করতে হবে। এ প্রক্রিয়ায়, যারা শাহবাগে পুরোপুরি সক্রিয় ছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে রাজনৈতিক থিসিস চেঞ্জ করেছেন, তাদের ব্যাপারটিও বিবেচনায় আনতে হবে।
খ. ‘শাহবাগি’ সংজ্ঞার আওতায় প্রত্যেক অপরাধীর নির্দিষ্ট ফৌজদারি অপরাধ শনাক্তকরণ।
গ. শাহবাগ-শাপলার সাথে সংশ্লিষ্ট যুদ্ধাপরাধ ইস্যু, ব্লগার হত্যাকাণ্ড, শাপলা হত্যাকাণ্ড ও সকল সহিংসতার নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচার।
ঘ. আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিতর্কিত রায়গুলোর নিরপেক্ষ তদন্ত ও পুনর্মূল্যায়ন।
ঙ. একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশনের মাধ্যমে শাহবাগ ও শাপলার সামগ্রিক ঘটনায় অংশগ্রহণকারী পক্ষগুলোর কার্যক্রমের ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি, এবং এর ভিত্তিতে যথাযথ বিচার ও জাতীয় পুনর্মিলনের রূপরেখা প্রদান।
এই কাজগুলি না করে ‘শাহবাগের বিচার’ করা যাবে না আসলে। কেবল পথেঘাটে ‘শাহবাগবিরোধী’ মব করে ছাত্রলীগ স্টাইলে হামলা চালানো যাবে। কিংবা সাংস্কৃতিক রাজনীতির বর্গ হিশেবে নতুন নতুন ‘শাহবাগি’ পুনরুৎপাদন করা যাবে।
দেখা যাচ্ছে, ‘শাহবাগি’ মর্মে কিছু লোককে দায়ী করা হচ্ছে, আবার শাহবাগে ব্যাপক সক্রিয় অনেককে নিয়ে আলোচনাই হচ্ছে না। এবং এটা ঘটছে জুলাই-পরবর্তী নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রেক্ষিতে। ফলে ‘শাহবাগের বিচার’ নামক ব্যাপারটিও যুদ্ধাপরাধের বিচারের মতো একটা নির্দিষ্ট দলের রাজনৈতিক এজেন্ডায় পরিণত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
এসব কারণে ‘শাহবাগবিরোধিতা’ একসময় কাঠামোগত জুলুমের হাতিয়ারেও রূপান্তরিত হতে পারে। ‘শাহবাগি’ ধারণাটা এক ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ‘হোমো স্যাকের’ গোষ্ঠী উৎপাদনের ফ্যাসিস্ট টুল হয়ে উঠতে পারে। এর আলামত অলরেডি দৃশ্যমান। ‘শাহবাগবিরোধিতা’র ঘাড়ে চড়ে এ ধরনের প্রবণতা সমাজে তৈরি হলে, আবারো শাহবাগ-শাপলার রাজনীতি, এবং এর ফলস্বরূপ রাষ্ট্রের ফ্যাশিস্ট রূপান্তরের সুযোগ তৈরি হতে পারে।
১১.
‘প্রতি-শাহবাগ’ বা ‘কাউন্টার-শাহবাগ’র কথা বলছিলাম আমি, ২০১৮ সালে। বলছিলাম যে, একটা রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বর্গ ‘শাহবাগ’রে সদা জিন্দা রাখতে চায়, এবং নিজেদের এথিকো-পলিটিকাল এজেন্ডার বাইরে থাকা অন্য সবাইরে ‘শাহবাগি’ মর্মে ক্যান্সেল করে, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লড়াইয়ে একচ্ছত্র আধিপত্য তৈরি করতে চায়। এই ‘প্রতি-শাহবাগ’ শাহবাগেরই অল্টার ইগো।
পরে অনেকেই প্রতি-শাহবাগের শিকার হয়ে এরে চিনতে পারছেন। ২০২৫ সাল নাগাদ ‘শাহবাগি’ ট্যাগের শিকার হইছেন বিভিন্ন দলমতের অসংখ্য ব্যক্তিবর্গ। শাহবাগের অনেক প্রত্যক্ষ বিরোধী, এমনকি জুলাইয়ের নেতৃত্বকেও যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে কথা বলায় এই ট্যাগ দেওয়া হয়েছে।
জুলাইয়ের পরের অবস্থাকে আমি বলি ‘পোস্ট-শাহবাগ-শাপলা এরা’। পোস্ট-ইডিওলজি অর্থে না; ওই মতাদর্শিক বিন্যাসটার নয়া গণতান্ত্রিক রূপান্তর ও বিনির্মাণ অর্থে।
১২.
জুলাইয়ের পর শাহবাগ ও শাপলার পুরাতন বন্দোবস্তরেই আবার ফিরায়ে আনার চেষ্টা চলমান। দুই বর্গেরই সনাতন শক্তি জুলাইয়ের ফ্রেশ এনভায়রনমেন্টরে, ফ্রেশ প্রজন্মরে ওই পুরাতন বন্দোবস্তের মধ্যে ঢুকাতে উদ্যত। এ-কাজে পতিত ফ্যাশিস্ট শক্তি যে খুব বেশি অখুশি, তা না। বরং এই পুরান দ্বন্দ্ব তার আরাধ্যই বটে; তারই তৈরি করা কালচারাল ট্র্যাপ এটি। এই ট্র্যাপই তার রাজনৈতিক পুনর্বাসনের অস্ত্র।
১৩.
ইসলামিস্টরা যদি সকল ইডিওলজিকাল শত্রুর বিরুদ্ধে ‘শাহবাগবিরোধিতা’র কামান দাগায়, তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিকভাবে, সেটা বুমেরাং হবে। ‘শাহবাগ’ মানে যদি হয় ইসলামিস্ট ফোর্সের বাইরের অন্য সকল ফোর্স, ‘শাহবাগবিরোধিতা’র আড়ালে যদি চাপা পড়ে যায়, বরং জায়েজ হয়ে ওঠে, শাহবাগবিরোধী অংশের অন্তর্গত নানাবিধ ফ্যাশিস্ট প্রবণতা, ‘শাহবাগ’র জুলুমের প্রতিশোধ নিতে যদি শুরু হয় ‘শাহবাগবিরোধী’ পালটা জুলুম— তাইলে সেটাই হবে নতুন সময়ের শাহবাগি রাজনীতি। সেক্ষেত্রে ‘শাহবাগি’ শব্দটাও অদূর বা দূর ভবিষ্যতে ‘রাজাকার’ শব্দের ভাগ্য বরণ করতে পারে।
১৪.
শাহবাগ ও শাপলা— দুটি আন্দোলনই শেষমেশ ফ্যাসিস্ট শক্তির দখলে চলে যাওয়ায়, এবং শাপলার হত্যাকাণ্ডের কারণে, ফ্যাসিবাদের আমলে এই দুটি মুভমেন্টের ক্রিটিকাল হিস্ট্রিওগ্রাফি নির্মাণ সম্ভব হয় নাই। সে কাজটি এখন করা উচিত।
শাহবাগ-শাপলার প্রেক্ষাপট ও মতাদর্শিক ভিত্তি, তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি, উভয় পক্ষের সিভিল সোসাইটির বোঝাপড়া ও যুক্তিতর্ক, ‘ডিপ স্টেট’র সম্ভাব্য সংযুক্ততা— সবই নতুনভাবে বিশ্লেষিত হওয়া উচিত। পাশাপাশি, তৈরি করতে হবে এই আন্দোলন দুটির ‘গণ-ইতিহাস’।
১৫.
যুদ্ধাপরাধ ইস্যুকেন্দ্রিক তীব্রতর সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক বিভাজনের কারণে, রাষ্ট্রীয় জুলুম ও বলপ্রয়োগের মাধ্যমে জামায়াত-শিবিরের প্রতি ঘটা গভীরতর অপরায়ণের কারণে, জামায়াতে ইসলামির মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক চিন্তা-চর্চার পর্যালোচনা এদেশে প্রায় হয় নাই বললেই চলে। জামায়াতকে স্রেফ ‘যুদ্ধাপরাধী’ হিশেবেই ব্যাখ্যা ও মোকাবেলা করার একটা শক্তিশালী রাজনৈতিক ধারা গড়ে উঠেছে।
যুদ্ধাপরাধের মীমাংসা অবশ্যই জরুরি। কিন্তু তারচে জরুরি হলো, জামায়াতের তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক চর্চার পর্যালোচনা। সেটাই বরং বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেবল জামায়াতের না, পলিটিকাল ইসলামসহ অন্যান্য ইসলামপন্থী ধারার সাথেও নিবিড়, গভীর ও অবজেক্টিভ ‘এঙ্গেজমেন্ট’ জরুরি, যা এদেশের বিদ্ব্যৎসমাজে প্রায় অনুপস্থিত। জাতীয় সংকট উত্তরণের পথে এ এক বিরাট বাধা।
এই পরিস্থিতি তৈরির পেছনে দুই পক্ষেরই কমবেশি দায় আছে। এই পরিস্থিতি ও অচলায়তনটা ভাঙতে হবে৷ জ্ঞানের পরিমণ্ডলে এ ধরনের একটি চর্চা ফলিয়ে তুলতে না পারলে, জাতীয় জীবনে তা ঘটিয়ে তোলা সম্ভব হবে না।
বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক ডানপন্থার একটা নতুন যুগ শুরু হয়েছে। এই ডানপন্থা নতুন, আনকোরা। একে আগের জ্ঞান, যুক্তি, ভাষা ও চিন্তাপদ্ধতি দিয়ে বোঝা যাবে না। একটা প্যারাডাইম শিফট ঘটছে। আবার ট্রাম্পের দেশে মামদানিরাও তো দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, তাই না? এই পাটাতনে দাঁড়িয়ে আমরা কেমন রাষ্ট্র চাই আর কোন রাজনীতি সেরকম রাষ্ট্র নিশ্চিত করতে পারে— তা নিয়ে নতুন করে ভাবা দরকার। স্রেফ ‘যুদ্ধাপরাধ’র মতো একটা পুরাতন, জটিল ও রক্তাক্ত ইস্যু দিয়ে এই নতুন দিনের রাজনৈতিক কর্মসূচি সাজানো যাবে না। দরকার বিদ্যমান রাষ্ট্রকল্প ও বন্দোবস্তগুলোর প্রবল পর্যালোচনা, তীব্র ব্যবচ্ছেদ ও সৃজনশীল প্রস্তাবনা। দরকার নতুন বোঝাপড়া ও প্রস্তুতি; নতুন সংস্কৃতি ও রাজনীতি; নতুন মোলাকাত ও মোকাবেলা।
১৬.
যে ‘ফ্যাসিজম’র বিরুদ্ধে জুলাই হলো, সে ‘ফ্যাসিজম’ কী জিনিস, কীভাবে তা গড়ে-বেড়ে উঠল, তাতে কার কতটুকু দায়, তা বুঝতে পারতে হবে। ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রকাঠামো হাসিনার বাপের সম্পত্তি না; এটি একটি ব্যক্তি-নিরপেক্ষ কাঠামো। এই কাঠামোর গড়নে দায় আছে অনেক পক্ষের।
ভুলে গেলে চলবে কেন যে, শাহবাগের মতো শাপলায়ও ফাঁসির দাবি উঠেছিল। কুখ্যাত ডিজিটাল সিক্যুরিটি আইন করে একদিকে যেমন মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়, অন্যদিকে ৪ জন ব্লগারকেও গ্রেফতার করা হয়। ডিজিটাল সিক্যুরিটি আইনটিরে একদিকে যেমন ‘মুক্তিযুদ্ধবিরোধী’ শক্তির বিরুদ্ধে কাজ লাগানো হয়, তেমনি ‘ধর্মবিরোধী’ শক্তির বিপক্ষেও কাজে লাগানো হয়। শাহবাগ, শাপলা বা জুলাই— কোনটাই একদিনে গড়ে ওঠে নাই। এর দীর্ঘ প্রেক্ষাপট বুঝতে না পারলে, আমরা গোড়ার সমস্যাগুলা বুঝব না।
জুলাইয়ের পরে সব পক্ষেরই তাই ‘ফ্যাসিবাদ’ নিয়ে নতুন বোঝাপড়া জরুরি।
জুলাই বাংলাদেশের পুরাতন বাইনারির বাইরে গিয়া কল্পনা করতে পারছে। ইডিওলজিকাল দ্বন্দ্বের বাইরে গিয়া মানবিক মর্যাদা ও নাগরিক অধিকারের ভিত্তিতে একটা নতুন রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা ভাবতে পারছে।
পুরাতন ভাবাদর্শিক লড়াই রাজনৈতিক ও আইনি পরিসরে, ফলত রাষ্ট্রীয় পরিসরে, আবারো যদি প্রধান হয়ে ওঠে, তাইলে জুলাইয়ের নতুন বাসনার প্রতিফলন ব্যাহত হবে। আর সেটি যেন না হয় তা নিশ্চিত করতে, সব পক্ষেরই নিজ নিজ দায়ের পুনর্মূল্যায়ন করে, দরদি হয়ে উঠতে হবে। জুলাইয়ের স্পিরিটটা বোঝা তাই খুবই জরুরি। এটা বুঝতে না পারলে, নতুন বন্দোবস্তের বিকাশ সম্ভব হবে না।
তুহিন খান,কবি ও লেখক।