ঢাবির হলগুলোতে প্রকাশ্য কিংবা গুপ্ত সকল ধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ বলে জানিয়েছেন ঢাবি প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ।গুপ্ত রাজনীতির কথা শুনলে অবচেতন মনে ভেসে ওঠে ছাত্রশিবিরের কথা।এর কারণ কী,কে জানে।তার চেয়েও বড় প্রশ্ন,ছাত্ররাজনীতি বন্ধের আলোচনায় শিবিরের নিরঙ্কুশ নেতৃত্বের হেতু কী?
২০২৪ সালের ১৭ জুলাই ছাত্রলীগের নৃশংসতার জের ধরে ঢাবির হলগুলোতে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়।আজ অবধি আনুষ্ঠানিকভাবে হলগুলোয় ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ থাকলেও ৮ আগস্ট,২০২৫ ছাত্রদল হলগুলোতে আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করে।ঘোষণার পরপরই সোশাল মিডিয়ায় এ নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়।বিকাল থেকে শিক্ষার্থীরা হল প্রশাসনের কাছে হল রাজনীতি নিষিদ্ধের ও প্রস্তাবিত কমিটিতে থাকা শিক্ষার্থীদের বহিষ্কারের দাবি জানাতে থাকে।শিক্ষার্থীদের দেওয়া রাত ১২ টার আল্টিমেটাম না মানায় রোকেয়া হলের শিক্ষার্থীরা হলের তালা ভেঙে রাজু ভাস্কর্যের সামনে অবস্থান নেয় ও মধ্যরাতে ঢাবি উপাচার্যের বাস ভবনের সামনে বসে পড়ে।এমতাবস্থায় প্রক্টরের থেকে উক্ত ঘোষণা আসে।
বুয়েটে আবরার ফাহাদের নৃশংসতম হত্যাকান্ডের পর ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের ঘোষণা আসে।’২৪ এর জুলাইয়ে ঐতিহাসিক ৯ দফার সর্বশেষ দাবিটি ছিল ‘দলীয় লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে।’ তাই দেশে মূল ধারার ছাত্র রাজনীতি নিয়ে একটি চলমান টেনশন বিদ্যমান দীর্ঘদিন ধরেই। ৫ আগস্টের আগে আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস গুলোতে ছাত্ররাজনীতির অস্তিত্ব বলতে ছাত্রলীগের রাজনীতিকেই বোঝাতো।অন্য যেকোনো ছাত্র সংগঠনের রাজনৈতিক অধিকার হরণে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ছিল সিদ্ধহস্ত।সে কারণে একদিকে যেমন ছাত্রলীগের সন্ত্রাসের ভয়ে শিক্ষার্থীরা রাজনীতি বিমুখ হচ্ছিল,ছাত্রলীগও সে বিরাজনীতিকরণকে কাজে লাগিয়ে বাকিদের রাজনৈতিক অধিকার হরণ করে ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক পরিবেশের কবর রচনা করে চলছিল।শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে অভিভাবক-সকলের মনেই গাঁথা হয়ে গিয়েছিল-ছাত্ররাজনীতি মানেই তো সহিংসতায় জড়ানো।তাই জুলাইয়ের ৯ দফা ও ৫ আগস্টের পর সমস্বরে যখন সর্বাত্মক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের পক্ষেই কন্ঠের জোর বেশি শোনা যাচ্ছিল,তখন তাতে অনেকে দ্বিমত করলেও সে দাবির প্রেক্ষাপট নিয়ে বোধ করি কারো সংকোচ ছিল না।
৫ আগস্টের পর ছাত্ররাজনীতির পট পরিবর্তন হয়েছে।ফিরে এসেছে বহুদলীয় গণতন্ত্র।তবে বাধ সাধে সম্প্রতি ঢাবিতে ছাত্রদলের হল কমিটি প্রকাশ।এর জের ধরে হলগুলোকে অরাজনৈতিক রাখার দাবিতে ৮ আগস্ট সারাদিন উত্তাল ছিল ঢাবি ক্যাম্পাস।কিন্তু সোশাল মিডিয়ায় ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে ভোকাল থাকা শিক্ষার্থীদের একাধিক জনের পাওয়া গিয়েছে শিবির কিংবা ছাত্রী সংস্থার সাথে সম্পৃক্ততা।তারা ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’ নামে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধে জোরালো দাবি তুলছে।এ বিষয়ে বাগছাসের সদস্য সচিব মহির আলম তার ফেসবুক ওয়ালে লিখছেন,’ছাত্রদলকে হল কমিটির জন্য যেভাবে প্রশ্নের সম্মুখীন করা হচ্ছে,সেভাবে শিবিরকেও করা উচিত।হলগুলোতে শিবিরের কমিটি অলরেডি এগসিস্ট করে’। তিনি আরো জানান,ঢাবি শিবির সভাপতি এস এম ফরহাদ তাদের জানিয়েছেন হলে হলে শিবিরের টিম থাকার কথা এবং সেটা নাকি অরাজনৈতিক।মহির আলম প্রশ্ন ছোড়েন,শিবির রাজনৈতিক সংগঠন হয়ে টিম কিভাবে অরাজনৈতিক হতে পারে! প্রক্টরের রাজনীতি নিষিদ্ধের ঘোষণায় প্রকাশ্যের সাথে ‘গুপ্ত রাজনীতি’র আলাদা করে উল্লেখ করার মাহাত্ম্য সম্ভবত এখানেই।আমার অবচেতন মন গুপ্ত রাজনীতির কথা শুনলেই কেন শিবিরের কথা ভেবে বসে তার পেছনের উত্তরও হয়তো পাওয়া গেল এর মধ্য দিয়ে।মহিরের উত্থাপিত প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদের বঙ্গদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও জামাত-শিবিরের রাজনৈতিক মনস্তত্বকে বুঝতে পারতে হবে।
স্মরণ করাতে চাই,মাসখানেক আগে জামাত নেতা শফিকুল ইসলাম মাসুদ বলছেন,”আপনি যদি জামায়াতকে শত্রু মনে করেন তাহলে প্রকৃতপক্ষে আপনি কোরয়ানের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হবেন।” এ উক্তি থেকে আমরা ধারণা পেতে পারি ফরহাদ কোন যুক্তিতে শিবিরের হল কমিটিকে অরাজনৈতিক দাবি করছেন।ছাত্রদল যখন বাংলাদেশী জাতীয়বাদ নিয়ে কথা বলে কিংবা বামপন্থীরা যখন আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি তোলে,তখন সেটিকে খুব স্পষ্টভাবে রাজনৈতিক আলাপ বলে চিহ্নিত করা সম্ভব।কিন্তু জামাত-শিবির যখন ইসলামিক কথা বলে ও ইসলামি কথার ভেতরে তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলকারী বক্তব্যগুলো জুড়ে দেয়,তখন সেটিকে রাজনৈতিক আলাপ বলে চিহ্নিত করা দূরহ হয়ে দাঁড়ায়।হাসিনার আমলে চরম নিপীড়নের মুখে শিবিরকে আন্ডারগ্রাউন্ড বা গুপ্ত রাজনীতি আত্মস্থ করতে হয়েছিল।সাদিক কায়েমের শেখ মুজিবের সাথে ছবি কিংবা জয় বাঙলা বলে হাততালি দেওয়ার ভিডিও প্রায়ই সোশাল মিডিয়ায় ভেসে বেড়ায়।তারা ছাত্রলীগের মধ্যে মিশে থেকে ছাত্রলীগের রাজনীতি করে কিভাবে একইসাথে শিবিরের গুপ্ত রাজনীতি চালিয়ে গিয়েছিল সে এক গবেষণার বিষয় হতে পারে।তবে আজ,৫ আগস্ট পরবর্তী বাংলাদেশে শিবির যখন নিজে খোদ একটি রাজনৈতিক সংগঠন হওয়া সত্ত্বেও ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেয় এবং দীর্ঘদিন ধরে রপ্ত করা গুপ্ত রাজনীতি চালিয়ে গণতান্ত্রিক চুক্তির বরখেলাপ ঘটায়,তখন প্রশ্ন ওঠে ছাত্রলীগের সাথে তাদের উদ্দেশ্যের ফারাক ঠিক কতটুকু।ছাত্রলীগ ও হাসিনা যেমন ১৫ বছরের বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া ও চাপাতির ভয় দেখিয়ে অন্যদের ন্যায্য রাজনৈতিক অধিকার হরণ করে নিজে একা রাজনীতির নামে মাফিয়াতন্ত্র কায়েম করেছিল,শিবিরের প্রক্রিয়া ও মাত্রা হয়তো ভিন্ন হতে পারে কিন্তু রাজনীতির মাঠ থেকে প্রতিপক্ষকে সড়িয়ে দিয়ে নিজে গুপ্ত রাজনীতি চালিয়ে যাওয়ার পেছনে যে উদ্দেশ্যের সাদৃশ্য,তাতে খুব বেশি তফাৎ পাওয়া যায় কি?
না,কেবল শিবিরের উপর দায় চাপিয়ে অন্যান্য শিক্ষার্থীদের দাবি থেকে বৈধতা কেড়ে নিতে চাই না।বিরাজনীতিকরণের দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরা প্রকৃতই ছাত্ররাজনীতির প্রতি বিরক্ত।সেই সাথে যখন ছাত্রদলের হল কমিটিতে সদস্য পদ পাওয়া একাধিক জনের সাথে পূর্বে ছাত্রলীগ করার ‘অভিযোগ’ উঠে, সে বিষয়ক ছবি ও স্ক্রিনশট সোশাল মিডিয়ায় ঘুরতে থাকে,তখন সেটি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মাত্রা অনেকখানি বাড়িয়ে দেয়।এর রেশ এতটাই ছিল যে,ছাত্রদল থেকে সেদিনই ছয় জনকে বরখাস্ত পর্যন্ত করা হয়।কিন্তু এ জায়গায় একটি প্রশ্ন থেকেই যায়।ইন্টারনেটে এমন অনেকে ছবি-ভিডিও পাওয়া যায় যেগুলো অভ্যুত্থানের নেতা হাসনাত-সার্জিসের ছাত্রলীগ করার সুস্পষ্ট প্রমাণ।আমরা কিন্তু সেগুলোকে একরকম মেনে নিয়েই তাদেরকে নেতা হিসেবে গ্রহণ করেছি।সেক্ষেত্রে ছাত্রলীগকর্মী যারা ৫ আগস্টের পর একটি সুস্থ রাজনৈতিক পুনর্বাসনের মধ্যে দিয়ে যেতে আগ্রহী,তাদেরকে আমরা সেই সুযোগটা দেবো কিনা সে নিয়ে আলোচনা জারি রাখা দরকার।কেননা এ বিশাল সংখ্যক ছাত্রনেতা,যারা সরাসরি জুলাই মাসে হতাহতের সাথে জড়িত নন,নানা চাপে,না চাইতেও ছাত্রলীগ করতে হয়েছে,তাদেরকে রাজনীতিতে পুনর্বাসন সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ গড়তে একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বলেই মনে করি।
ছাত্রদলের হল কমিটিকে কেন্দ্র করে হওয়া দিনভর উত্তাল ঢাবি ও রাত ৩ টায় আসা উপাচার্যের ঘোষণা আসন্ন ডাকসু নির্বাচনে কোন দলের জন্য কেমন প্রভাব ফেলবে তা সময় ঠিক করবে।তবে ছাত্রদলের আপাত এ হার যে ছাত্রদল প্রার্থীদের জন্য খুব শুভ কিছু বয়ে আনলো না,তা বলা অমূলক হবে না।এক দিকে শিবির ও আরেকদিকে প্রাক্তন ছাত্র ফেডারেশন ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমার যৌথ দাবিতে ছাত্রদলের এ হার ডাকসুতে উমামাকে কিছুটা এগিয়েই দিল কিনা তা আমরা ৯ সেপ্টেম্বর জানতে পারবো।
দেখুন,ছাত্ররাজনীতি হলগুলোতে নিষিদ্ধ করা হলো।ক্যাম্পাসে কিন্তু রাজনীতি দিব্যি চলবে।ক্যাম্পাস কমিটির অধিকাংশ শিক্ষার্থী কিন্তু হলেরই বাসিন্দা।তাই হল কমিটি বিলুপ্ত করে আদতে কতটা লাভবান হওয়া যাবে তা নিয়ে শংকা থেকেই যায়।সাধারণ শিক্ষার্থীরা হল কমিটি দেখে ফুঁসে ওঠার অন্যতম কারণ বোধ করি রাজনৈতিক নেতারা হলে সিট বণ্টন করে দেওয়ার অসুস্থ চর্চা।এতে পক্ষপাত ও দ্বিচারিতা তীব্র হয়ে ওঠে।সেক্ষেত্রে দরকার ছিল হল প্রশাসনের সিট বণ্টন বিষয়ক নীতিমালায় জোর দেওয়া এবং নীতিমালা বাস্তবায়নে কঠোর হওয়া।তা না করে যখন অদূরদর্শী সিদ্ধান্তে হল থেকে গোপন ও প্রকাশ্য রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়,তাতে কেবল গুপ্ত রাজনীতিকেই ক্ষমতায়িত করে তোলা হয়।কেননা যে রাজনীতি ইতোমধ্যে গুপ্ত তাকে আপনি নিষিদ্ধ করছেন কোন ভিত্তিতে?আর গুপ্ত রাজনীতি বলতে প্রক্টর কী বুঝাচ্ছেন সে ব্যাপারেও আমাদের স্পষ্ট হতে হবে।উদাহরণ স্বরূপ,শিবির যদি ইসলামিক আলোচনা করে কিংবা বামপন্থীরা যদি মার্ক্সবাদী পাঠচক্রের আয়োজন করে সেটিকে আমরা রাজনীতি বলতে পারবো কিনা?পারলে সেটি প্রকাশ্য,নাকি গুপ্ত?কোন ক্যাটাগরিতে পড়বে?ফলস্বরূপ বর্তমান রাজনীতিতে বিদ্যমান ট্যাগিং কালচারকে ত্বরান্বিত করবে এই ঘোষণা।এক আপাত সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে নতুন একদল সমস্যার মুখোমুখী হবে হল প্রশাসন ও শিক্ষার্থীরা।
ছাত্রদলের হল কমিটিকে কেন্দ্র করে হওয়া দিনভর উত্তাল ঢাবি ও রাত ৩ টায় আসা উপাচার্যের ঘোষণা আসন্ন ডাকসু নির্বাচনে কোন দলের জন্য কেমন প্রভাব ফেলবে তা সময় ঠিক করবে।তবে ছাত্রদলের আপাত এ হার যে ছাত্রদল প্রার্থীদের জন্য খুব শুভ কিছু বয়ে আনলো না,তা বলা অমূলক হবে না।এক দিকে শিবির ও আরেকদিকে প্রাক্তন ছাত্র ফেডারেশন ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমার যৌথ দাবিতে ছাত্রদলের এ হার ডাকসুতে উমামাকে কিছুটা এগিয়েই দিল কিনা তা আমরা ৯ সেপ্টেম্বর জানতে পারবো।তবে চলমান অস্থিরতায় শিবির সমর্থকদের চাপা উল্লাস বলে দিচ্ছে তারা এ সিদ্ধান্তকে এক বিজয় হিসেবেই দেখছে। চলমান ছাত্ররাজনীতি নিয়ে টেনশনের ব্যাপারটিকে যথার্থভাবে ডিল করা হচ্ছে না।এ কারণেই অমিমাংসিত থাকায় একই ইস্যু বারবার উঠে আসছে।
ইসমাম জামান,ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।