‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করলেন ড. ইউনূস। ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’টার বাস্তবতা আসলে কী হবে, সে বিষয়ে যা যা বলেছিলাম আগে, ঘোষণাপত্রটি ঠিক তাই তাই হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কিছু নোক্তা দিয়ে রাখা জরুরি।
১.
বলছিলাম: এই ঘোষণাপত্র ইন্টেরিম সরকারের আইনি, সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক বৈধতা পুনঃর্ব্যক্ত করবে। সেটাই হয়েছে।
‘জনগণের দাবি অনুযায়ী‘ শব্দবন্ধের মাধ্যমে এই সরকারের ব্যাপারে জাতীয় ঐক্যমত্য পুনঃর্ব্যক্ত হয়েছে। এবং ঘোষণাপত্রটি কবে থেকে কার্যকর হয়েছে/হবে, তা নির্দিষ্ট না হওয়ার ফলে, ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত ইন্টেরিম সরকারটি এই ঘোষণাপত্রের ‘সাংবিধানিক ফলাফল’ হতে পারেনি। তার লিগালিটি নেসেসিটি ডকট্রিন অনুযায়ী ১০৬ অনুচ্ছেদের ভিত্তিতেই সীমিত হয়ে থাকছে।
১০৬ অনুচ্ছেদের ভিত্তিতে নেসেসিটি ডকট্রিন অনুযায়ী এই সরকারের গঠন ‘স্ট্রিক্টলি’ সাংবিধানিক না হলেও, ‘Constutionally Defensible’ হয়েছে। কারণ, ১০৬ অনুচ্ছেদ ‘Authority-Conferring’ ক্লজ না হলেও, প্রধানমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে, আদালতের পরামর্শে, এটি রাষ্ট্রপতিকে গুড ফেইথে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার দেয়।
তবে ১০৬ অনুচ্ছেদের এই ব্যাখ্যা ও আদালতের রায় আপিল বিভাগে কন্টেস্টেড হতে পারে কিনা— তা সংবিধান বিশেষজ্ঞরা ভালো বলতে পারবেন।
২.
ঘোষণাপত্রে কিছু সংস্কারের আশ্বাস আছে, এবং নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে সংবিধানসহ অন্য সকল সংস্কার কার্যকরের কথা বলা হয়েছে।
এ ব্যাপারে প্রথম কথা হল, ২২ নং ক্লজে ‘…ফ্যাসিবাদী শাসনের পুনরাবৃত্তি রোধ, আইনের শাসন এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে’র পরে ‘জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনে গৃহীত জুলাই সনদের ভিত্তিতে’ শব্দবন্ধটা থাকতে পারত। তাতে জুলাই সনদ একটা সাংবিধানিক স্বীকৃতির আওতায় আসার সম্ভাবনা তৈরি হত।
দ্বিতীয়ত, নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে সকল সংস্কার কার্যকর করার ক্লজ থাকায়, টেকনিক্যালি, যাবতীয় সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের একমাত্র পদ্ধতি হয়ে দাঁড়িয়েছে নির্বাচিত সংসদ। ফলে গণভোট, এলএফও কিংবা অধ্যাদেশের মাধ্যমে কোনো সংস্কার বাস্তবায়নের ইশারা বা সুযোগ, এই ঘোষণাপত্র অনুযায়ী, নেই।
এবং সম্ভবত সেকারণেই ‘জুলাই সনদ’ শব্দবন্ধটিরে এক্সপ্লিসিটলি এই ঘোষণাপত্রে রাখা হয় নাই। কারণ এটি বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক চলমান; নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে ‘জুলাই সনদ’র বাস্তবায়নের বিপক্ষে অনেকেই।
তবে ‘প্রতিশ্রুত প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কার’কে ‘জুলাই সনদ’র প্যারালাল হিসেবে ব্যাখ্যা করার সম্ভাবনা পুরো মাত্রায় থেকেই যাচ্ছে।
এই ক্লজ ঘোষণাপত্রটিরে পুরাপুরি ‘নির্বাচনপন্থী’ করে তুলছে, এবং জুলাই সনদের বাস্তবায়ন সংক্রান্ত বিতর্কটির ব্যাপারে এক ধরনের ডিসাইসিভ পজিশন নিয়ে নিয়েছে। অন্য রাজনৈতিক দলগুলা এখন কীসের ভিত্তিতে গণভোট বা এলএফও বা অধ্যাদেশ চাইবে— জানি না। সম্ভবত তারা বলতে পারে, এখানে ‘জুলাই সনদ’ শব্দটা নেই।
৩.
ঘোষণাপত্রটিতে শহিদদের একটা অ্যাপ্রোক্সিমেট সংখ্যা বলা হয়েছে— প্রায় এক হাজার। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় গেজেটে প্রকাশিত শহিদদের সংখ্যার দিকেই ইঙ্গিত করা হইছে সম্ভবত, কারণ জাতিসংঘের রিপোর্টে নিহতের সংখ্যা বলা হয়েছে ১৪০০।
অন্যদিকে আহতদের কোনো অ্যাপ্রোক্সিমেট সংখ্যাও বলা হয় নাই।
অর্থাৎ, সরকার এখনও শহিদ ও আহতদের একটা সুষ্ঠু তালিকা প্রণয়নে ব্যর্থ হয়েছে; এবং এই ব্যর্থতার ছাপ ঘোষণাপত্রটিতে মুদ্রিত হয়ে থাকল।
৪.
আরো কয়েকটা ব্যাপার নিয়ে হয়ত বলা যায়, তবে সেগুলো খুব মেজর কোনো ইস্যু না। বলাও অর্থহীন।
বলছিলাম: এই ঘোষণাপত্র অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিদ্যমান বাস্তবতারে পাল্টাবে না। বরং আনুষ্ঠানিক করবে কেবল। তাই হয়েছে।
ফলে এই ঘোষণাপত্রটি ‘আইনি ক্ষমতাসম্পন্ন সাংবিধানিক দলিল’ হয় নাই; বরং ‘সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় অনুমোদিত একটা রাজনৈতিক ডকুমেন্ট’ হয়েছে। এটা জুলাইকে পুরাতন আইনি ও সাংবিধানিক কাঠামোর আওতায় এনে, একটা আনুষ্ঠানিক গণ-অভ্যুত্থানে রূপ দিয়েছে।
এবং কার্যকরের তারিখ উল্লেখ না থাকা ও সংসদের মাধ্যমে সংবিধানের তফসিলে এটি অন্তর্ভুক্ত করার ক্লজের মাধ্যমে, খোদ ঘোষণাপত্রটি ন্যূনতম আইনি কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলছে; এমনকি পরবর্তী সংসদের সময় থেকে এটিরে কার্যকর ধরা হবে কিনা, তাও নিশ্চিত না। আসলে, এটি ‘কার্যকরযোগ্য’ বা ‘বলবৎযোগ্য’ কোনো আইনি দলিলই হয়নি; বরং এই ঘোষণাপত্র স্রেফ জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের একটা অফিশিয়াল জাতীয় ও রাজনৈতিক স্বীকৃতিমূলক এবং জনগণের বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষার স্মারকমূলক ডকুমেন্টে পরিণত হয়েছে।
৫.
এবং অভ্যুত্থানের এক বছর পর, ছাত্র-জনতার নয়া বিপ্লবী ঐক্য ও আকাঙ্ক্ষা ভেঙেচুরে পুরাতন রাজনৈতিক বন্দোবস্তে ঢুকে পড়ার পর, দেশে মিলিটারি ও সিভিল ব্যুরোক্রেসির একচ্ছত্র রাজত্ব কায়েম হওয়ার পর, পুরান সংবিধানের আওতায় শপথ নেওয়া ইন্টেরিমের দেওয়া এই ঘোষণাপত্র এমনই হওয়ার কথা ছিল। এরচাইতে বেশিকিছু, এই ইন্টেরিমের, দেওয়া সম্ভবই ছিল না।
তবে এরমধ্যেও আশার ব্যাপার হলো, অবশেষে জুলাই একটা ঘোষণাপত্র পেল। রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক ঐক্যমত্যের ভিত্তি পেল। বিপ্লবীদের আইনি সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি আসলো। জুলাইয়ের গণ-আকাঙ্ক্ষা যে একটা ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকাঠামোরে ভেঙেচুড়ে নতুন করে গড়তে চাইছিল, এটি তার দলিল হয়ে রইল। জুলাই যা হতে পারত, কিন্তু হয় নাই— কার্যকরের তারিখহীন, আইনি ক্ষমতাহীন, এই ঘোষণাপত্রটি তারই জ্বলজ্বলে স্মারক হয়ে থাকল।
নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে এটিকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি (ভিত্তি না) দেওয়া হবে মর্মে বলা হয়েছে। হলে ভালো। সেক্ষেত্রে এই জুলাই ঘোষণাপত্র কেবল ভুলে যাওয়া রাজনৈতিক দলিল না, সংবিধানের তফসিল হিসেবে থেকে যাবে, আলোচিত হবে, পর্যালোচিত হবে।
এবং এই দলিল থেকে অনাগত দিনের বিপ্লবীরা প্রেরণা ও শিক্ষা— দুইটাই নেবে নিশ্চয়ই।
তুহিন খান,কবি ও লেখক।