টক শো থেকে চায়ের দোকানে বট আইডি বা বটনেটের ভূমিকা নিয়ে সরগরম রাজনৈতিক আলাপ। বট আইডি দিয়ে অনলাইনে নিত্য নতুন বয়ান সৃষ্টি করে অফলাইনে সেগুলো দিয়ে প্রতিপক্ষ ঘায়েল করার নয়া রাজনৈতিক মেরুকরণ হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্র সংসদ ও জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বট আইডি দিয়ে প্রতিপক্ষ ঘায়েলের রাজনীতির চর্চা বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্রমশ। অথচ যে ভুয়া আইডির আসল পরিচয় কারো কাছে জানা নেই এমন প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রযন্ত্র কি নীরব দর্শকের ভূমিকায়? ভুয়া আইডি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একে-অপরের ওপর দায় চাপানোর ফলে সৃষ্টি হচ্ছে তথ্যসন্ত্রাস। যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অর্থাৎ নির্বাচন প্রক্রিয়ার ওপর জনগণের আস্থার পারদে প্রভাব ফেলছে।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন সহদেশের বিভিন্ন ছাত্রসংসদকে কেন্দ্র করে দায় চাপানোর সংস্কৃতি সৃষ্টি হয়েছে রাজনীতিতে। আলী হুসেন নামের একজন শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে একজন প্রার্থীর বিরুদ্ধে রিট করায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক নারী শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের হুমকি দেন। এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল ও শিবির উভয়পক্ষ ঐ শিক্ষার্থীকে একে-অপরের প্রতিনিধি বলে দায় চাপিয়ে দেয়।যার ফলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক সৌহার্দ্য ধীরে ধীরে কফিনে রুপান্তর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ঢাকা পোস্ট নিউজ পোর্টালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, পরবর্তীতে অভিযুক্ত শিক্ষার্থী আলী হুসেনকে তদন্ত কমিটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৬ মাসের জন্য বহিষ্কার করেছে এবং তার কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা পায়নি।
২০২৪ সালে আগষ্ট মাসে ঢাকা ট্রিবিউনের Dismiss Lab কর্তৃক প্রকাশিত গবেষণার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১২তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এবং পরে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সমর্থনে বিরোধীদের পেইজে ভুয়া প্রোফাইল থেকে অনেক মন্তব্য করা হয়েছিল। একটি বট নেটওয়ার্কের মাধ্যমে মোট১,৩৬৯টি ভুয়া ফেসবুক প্রোফাইল শনাক্ত করা হয়েছে গবেষণায়।
২০২৫ সালের জুলাই মাসে দ্যা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডে Dismiss Lab কর্তৃক প্রকাশিত গবেষণার প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ভুয়া খবর ও বিভ্রান্তিকর কনটেন্ট ছড়ানোর ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক প্রযুক্তির ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে।
নির্বাচনের আগে এই সমস্ত বটনেট ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্ভর ভিডিওর কারণে দেশে গণতন্ত্র চর্চা ব্যাহত, ভোটারদের মধ্যে বিভ্রান্তি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আকাশপথ -স্থলপথ-নৌপথের জন্য রাষ্ট্র বাজেট করলেও অবাধ তথ্যপ্রবাহ ও প্রযুক্তির উৎকর্ষতার জন্য সাইবার স্পেসে বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন। শুধু বরাদ্দ বাড়ালে হবে না, পাশাপাশি রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিকভাবে সমন্বয় করতে হবে বটনেট প্রতিরোধে।
বটনেট আধিপত্য দেশের সীমানা পেরিয়ে গেলে আইনের সমন্বয় প্রয়োজন। কারণ একটা দেশের আইন অন্য দেশে সাধারণত প্রযোজ্য হয়না। বুদাপেস্ট কনভেনশন অন সাইবার ক্রাইম চুক্তি একাধিক দেশের মধ্যে বটনেট প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে পারে। দেশী-বিদেশী আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগকারী সংস্থা একসঙ্গে কাজ করলে ম্যালওয়্যার নেটওয়ার্ক অর্থাৎ সার্ভার ও ডোমেইন নিষ্ক্রিয় করা সম্ভব।
জাতিসংঘ গ্লোবাল মেকানিজম ফর সাইবার স্পেস প্রতিষ্ঠা করে, যা অনলাইন দুনিয়ার জন্য রাষ্ট্রের বিধিমালা তৈরিতে সহায়তা করবে।
সরকারি-বেসরকারী সমন্বয় এবং আন্তর্জাতিক আইন ও প্রযুক্তির যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ভুয়া আইডির সৃষ্ট তথ্য সন্ত্রাস মোকাবেলা করা যাবে।
বট আইডি শনাক্ত বা ভুয়া তথ্য প্রতিরোধে রাষ্ট্রকে স্বাধীন ও মুক্তমত প্রকাশের সুযোগ রেখে যথাযথ সাইবার নীতি প্রণয়ন করা উচিত।শিক্ষা ব্যবস্থায় সাইবার স্পেস সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কার্যকর পাঠদানের বিষয়ে রাষ্ট্রকে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।
মাহমুদ তানজীদ,সাবেক গণমাধ্যম কর্মী, গবেষক ও শিক্ষার্থী।