ভারতের ‘কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট’এক বিশাল আঞ্চলিক অবকাঠামো প্রকল্প, যার উদ্দেশ্য হলো ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোকে সমুদ্রপথে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করা। এই প্রকল্পটি ভারতের মিজোরাম রাজ্য থেকে মিয়ানমারের সিত্তে বন্দর পর্যন্ত এবং সেখান থেকে নদী ও সড়কপথে যুক্ত হয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে প্রবেশ করবে।
এই প্রকল্পের তিনটি প্রধান অংশ আছে:
১. সমুদ্রপথ: ভারতের কোলকাতা বন্দর থেকে মিয়ানমারের সিত্তে বন্দরে পণ্য যাবে।
২. নৌপথ: সিত্তে বন্দর থেকে কালাদান নদী ধরে প্যালেতওয়া পর্যন্ত নৌপথ।
৩. সড়কপথ: প্যালেতওয়া থেকে মিজোরাম সীমান্ত পর্যন্ত প্রায় ১১০ কিমি দীর্ঘ সড়কপথ।
পুরো প্রকল্পটির ধারণা আসে ২০০৩ সালে। ২০০৮ সালে ভারত ও মিয়ানমার এর একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর করে।প্রকল্প বাস্তবায়ন ও অর্থায়নের মূল দায়িত্ব ভারতের। ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ইরকন এবং ইন্ডিয়া পোর্টস গ্লোবাল লিমিটেড(আইপিজিএল) এই প্রকল্প বাস্তবায়নে যুক্ত।
প্রকল্পটি কেন গুরুত্বপূর্ণ?
এই প্রকল্প ভারতের জন্য অত্যন্ত কৌশলগত ও অর্থনৈতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি কারণে:
১. চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ এর মোকাবিলা
ভারত এই প্রকল্পের মাধ্যমে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)-এর একটি বিকল্প পথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নিজেদের অবস্থান মজবুত করতে চায়। চীন ইতোমধ্যে মিয়ানমার হয়ে বঙ্গোপসাগরে প্রবেশাধিকার পেয়েছে। কালাদান প্রকল্প ভারতের সেই ঘাটতিকে পূরণ করছে।
২. সাতছড়ি রাজ্যগুলোর বিকাশ ও একীভূতকরণ
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোকে সরাসরি মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করার উপায় খুব সীমিত—একমাত্র “শিলিগুড়ি করিডোর” (চিকেনস নেক) ব্যবহার করা হয়। এই পথ সামরিক ও বাণিজ্যিক উভয় দিক থেকেই ঝুঁকিপূর্ণ ও দীর্ঘ। কালাদান প্রকল্প এই নির্ভরতা কমাবে।
৩. পণ্য পরিবহন খরচ ও সময় কমানো
ভারত উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্য পৌঁছাতে যেখানে ১৫০০ কিলোমিটার পথ ব্যবহার করত, এখন তা কমে দাঁড়াবে ৮০০ কিলোমিটারেরও কম। এতে সময় ও খরচ দুই-ই কমবে।
৪. অঞ্চলভিত্তিক প্রভাব বিস্তার
এই প্রকল্প ভারত-মিয়ানমার সম্পর্ককে ঘনিষ্ঠ করবে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতের ভূরাজনৈতিক উপস্থিতি জোরদার করবে।

কালাদান প্রকল্পের মাধ্যমে মিয়ানমারের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ গড়ে তুলতে চায় ভারত, ছবি: বে অব বেঙ্গল পোস্ট
এর সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক কী?
বাংলাদেশ সরাসরি এই প্রকল্পের অংশ না হলেও এর প্রভাব বাংলাদেশের ওপর অনেকভাবেই পড়তে পারে।
১. বিকল্প পথ হিসেবে ভারতের উপর নির্ভরতা কমানো
ভারত অতীতে তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য বাংলাদেশের ট্রানজিট সুবিধা চাইত। বাংলাদেশ তা কিছু সীমিত আকারে দিলেও কালাদান প্রকল্প ভারতের জন্য নতুন বিকল্প খুলে দিয়েছে। ফলে বাংলাদেশের ভূ-অবস্থানগত বিশেষত্ব কিছুটা কমে যাবে।
২. বন্দর প্রতিযোগিতা
বাংলাদেশের মোংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য সম্ভাব্য বাণিজ্য পথ হতে পারত। কিন্তু সিত্তে বন্দর চালু হলে ভারত হয়তো নিজের নির্মিত বন্দরই ব্যবহার করবে। এতে বাংলাদেশের সম্ভাব্য আয়ের উৎস কমে যেতে পারে।
৩. নিরাপত্তা ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতি
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে (যেখানে সিত্তে ও প্যালেতওয়া অবস্থিত) রোহিঙ্গা সঙ্কট চলমান। এই অঞ্চলে ভারতীয় সামরিক ও বাণিজ্যিক তৎপরতা বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশের নিরাপত্তা ভারসাম্যে পরিবর্তন আসতে পারে।
৪. প্রত্যক্ষ বাণিজ্য সংযোগ
এটি উল্লেখযোগ্য যে, ভারত এখন বাংলাদেশকে পণ্য পরিবহনের জন্য ব্যবহার করছে—আখাউড়া-আগরতলা ও চট্টগ্রাম-মেঘালয় পথে। কিন্তু কালাদান প্রকল্পে নিজেদেরই বিকল্প তৈরি করে নিচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের কৌশলগত শক্তি কমে যেতে পারে।
প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ভারতের কী লাভ?
এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ভারত বহুমুখীভাবে লাভবান হবে।যেমন-
১. ভূরাজনৈতিক আধিপত্য
ভারতের বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ সঞ্জয় বহাদুর বলেন, “চীনের মিয়ানমার কৌশলকে মোকাবিলায় ভারতের এই প্রকল্প অত্যন্ত কৌশলগত পদক্ষেপ। এটি শুধু বাণিজ্য নয়, প্রতিরক্ষা কৌশলের অংশ।”
২. সামরিক তৎপরতার সুবিধা
ভারতের জন্য উত্তর-পূর্বাঞ্চলে দ্রুত সৈন্য ও সামগ্রী পাঠানো সহজ হবে এই পথ দিয়ে। শিলিগুড়ি করিডোরের উপর চাপ কমবে।
৩. বাণিজ্য প্রবাহ বৃদ্ধি
ভারতের বাণিজ্যিক সংস্থাগুলো উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্য পরিবহনে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ খরচ সাশ্রয় করতে পারবে। এতে অঞ্চলটির শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান বাড়বে।
৪. মিয়ানমারের উপর প্রভাব বৃদ্ধি
ভারত মিয়ানমারে অবকাঠামো নির্মাণ করে একটি দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্ক তৈরি করছে, যা মিয়ানমারকে চীনের একক প্রভাব থেকে কিছুটা আলাদা করতে সাহায্য করবে।
এতে বাংলাদেশের কী ক্ষতি?
কালাদান প্রকল্প ভারতের লাভ হলেও বাংলাদেশের কিছু কৌশলগত এবং অর্থনৈতিক ক্ষতির ঝুঁকি রয়েছে।
১. কৌশলগত অবস্থানের অবমূল্যায়ন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, “বাংলাদেশ ভূরাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ করিডোর হিসেবেই ভারতের নজরে ছিল। কালাদান প্রকল্প চালু হলে সেই গুরুত্ব কমে আসবে। ভারতের ‘অলটারনেট প্যাসেজ’ চালু হয়ে গেলে আমাদের রাজনৈতিক লিভারেজও কমে যাবে।”
২. বাণিজ্যিক ক্ষতি ও ট্রানজিট রাজস্ব হারানো
যদি ভারত নিজেদের পথেই পণ্য পাঠাতে পারে, তবে বাংলাদেশের রেল ও নদীপথে ট্রানজিট ফি থেকে যে সম্ভাব্য রাজস্ব আসত, তা হারাতে হতে পারে।
৩. বন্দর প্রতিযোগিতা
চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ভারতের জন্য যে সম্ভাব্য ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট কেন্দ্র হতে পারত, সিত্তে বন্দরের বিকল্প উপস্থিতি এই ভূমিকা হ্রাস করবে।
৪. নিরাপত্তা উদ্বেগ
মিয়ানমারের রাখাইনে ভারতীয় তৎপরতা বৃদ্ধি, সামরিক সহযোগিতা এবং অবকাঠামোর উন্নয়ন ভবিষ্যতে চীন-ভারত প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে আরও তীব্র করতে পারে। এতে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চলে একটি নতুন ধরনের নিরাপত্তা চাপ সৃষ্টি হতে পারে, যার পরোক্ষ প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে।
সার্বিক বিচারে, ভারতের কালাদান প্রকল্প একটি কৌশলগত, অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক উদ্যোগ, যা শুধু ভারত নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যৎ গতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশের জন্য এই প্রকল্প একদিকে যেমন উদ্বেগের কারণ, অন্যদিকে তা একটি নতুন কৌশলগত বাস্তবতা তৈরি করছে—যেখানে নিজেদের ভূ-অবস্থানগত গুরুত্ব ধরে রাখতে হলে বাংলাদেশকেও নতুনভাবে চিন্তা করতে হবে। বিকল্প বাণিজ্য পথ, নতুন কূটনৈতিক যোগাযোগ এবংআঞ্চলিক ভারসাম্য রক্ষায় বাংলাদেশের সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারা এখন সময়ের দাবি।
কালাদান প্রকল্পের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থান নির্ধারণে স্বচ্ছ ও সাহসী কূটনীতি নির্মাণ এবংআঞ্চলিক বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে ভবিষ্যতের পথ নির্ধারণকরতে হবে—এটাই বাংলাদেশের জন্য এই প্রকল্প থেকে পাওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।
মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন।