শরীফ ওসমান গণি বিন হাদি প্রকাশ্যে শরীফ ওসমান হাদি বা ওসমান হাদি; এই জনপদের ধূসর আকাশে তিনি ছিলেন এক ঝড়ের নাম, আবার শ্রাবণের শেষে এক টুকরো রোদেলা দুপুরের নামও। আজ যখন তিনি আমাদের মাঝ থেকে চিরতরে বিদায় নিয়েছেন, তখন কেবল একজন প্রখর ধীসম্পন্ন রাজনৈতিক কর্মীকেই আমরা হারাইনি, আমরা হারিয়েছি এক মৃত্তিকাসংলগ্ন ছাত্রনেতাকে, যিনি সার্বভৌমত্ব আর ইনসাফের প্রশ্নে কোনোদিন মাথা নত করতে শেখেননি।
তাঁর লড়াইটা কেবল রাজপথের শ্লোগানে সীমাবদ্ধ ছিলো না; তিনি লড়েছিলেন এক গভীর নন্দনতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে। তথাকথিত প্রগতিশীলতার মোড়কে লুকিয়ে থাকা সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদের বিপরীতে তিনি গড়ে তুলেছিলেন এক বিকল্প কণ্ঠস্বর; যাকে আমরা ‘ইনকিলাব কালচারাল সেন্টার’ হিসেবে জানি।
শরীফ ওসমান হাদি ছিলেন সেই বিরল প্রতিভা, যিনি নিজের শেকড়কে ভুলে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখেননি। তাঁর আধ্যাত্মিক আর্তি আর রাজনৈতিক দ্রোহ মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল তার ছোট্ট রাজনৈতিক জীবনে।বাইনারি রাজনীতির এই সময়ে তিনি একাধারে ছিলেন বাউলপ্রেমী ও নবী (সা.)-এর আশেক। তাঁর চেতনার গভীরে একদিকে প্রতিধ্বনিত হতো লালন সাঁইয়ের একতারার সুর, অন্যদিকে হৃদস্পন্দনে অনুরণিত হতো আধ্যাত্মিক অনুভূতির বার্তা।
ইনকিলাব সেন্টারে যখন ভাবের গানের আসর বসতো তখন সেই সুর কেবল গান হয়ে থাকত না, তা হয়ে উঠতো জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের আধ্যাত্মিক আরজি। আর যখন সালাওয়াতের পবিত্র ধ্বনিতে ফুটে উঠতো কৃতজ্ঞতা আর আত্মসমর্পণ।
তিনি বিশ্বাস করতেন, এ দেশের মাটির মুক্তির লড়াই কোনো বিজাতীয় দর্শনে নয়, বরং আমাদের আপন ঐতিহ্যের মাঝেই লুকিয়ে আছে।
তিনি ‘সীমান্ত শরীফ’ ছদ্মনামে কাব্যচর্চা করতেন, আর তাঁর ‘লাভায় লালশাক পুবের আকাশ’ কাব্যগ্রন্থটি কেবল কতোগুলো কবিতার সংকলন ছিলো না, বরং তা ছিলো ইনসাফ ও সাম্য প্রতিষ্ঠার এক শৈল্পিক ইশতেহার। তাঁর বিশ্বাস ছিলো, ইনসাফ মানে কেবল আদালতের বিচার নয়, ইনসাফ মানে প্রতিটি নাগরিকের মর্যাদা আর আত্মপরিচয়ের স্বীকৃতি।
শরীফ ওসমান হাদির রাজনৈতিক দর্শনের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ ছিল আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে আপসহীন অবস্থান। তিনি কেবল দেশের অভ্যন্তরের অনাচার নিয়ে ভাবতেন না, বরং তাঁর সতর্ক দৃষ্টি ছিল সীমান্তের ওপারেও। ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের যে রক্তচক্ষু এই জনপদকে দাসে পরিণত করতে চায়, সেই চক্ষু উপড়ে ফেলার এক দুর্জয় স্বপ্ন তিনি লালন করতেন। তাঁর কাছে সার্বভৌমত্ব ছিল এক পবিত্র আমানত, যা কোনো পরাশক্তির কাছে বিকিয়ে দেওয়ার বস্তু নয়। দিল্লির দাদাগিরি আর সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে তিনি গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন এক অভেদ্য বুদ্ধিবৃত্তিক প্রাচীর।
তিনি বিশ্বাস করতেন, এ দেশের প্রতিটি ইঞ্চি মাটি আর নদীর হিস্যা বুঝে নিতে হলে প্রয়োজন এক প্রবল জাতীয়তাবাদী জাগরণ—যে জাগরণ কোনো বেনিয়া শক্তির তোয়াক্কা করবে না। তাঁর সেই লড়াই ছিল এক মুক্ত, স্বাধীন ও মর্যাদাবান বাংলাদেশের স্বপ্ন, যেখানে কোনো বহিঃশক্তির ইশারায় এদেশের ভাগ্য নির্ধারিত হবে না।
২০২৫ সালের ১২ ডিসেম্বরের সেই অভিশপ্ত দুপুরের রক্ত আর ১৮ ডিসেম্বরের সেই নিথর প্রস্থান আমাদের এক বিশাল ঋণের জালে আবদ্ধ করে গেলো। শহীদ হাদি চলে গেছেন সত্য, কিন্তু তিনি রেখে গেছেন তাঁর অসমাপ্ত বিপ্লব আর এক সুতীব্র সার্বভৌমত্বের আকাঙ্ক্ষা।
হে চির-তরুণ যোদ্ধা, আপনার শুরু করা এই সংগ্রাম যেন কোনোদিন থেমে না যায়।
শহীদ শরীফ ওসমান হাদি, আপনাকে লাল সালাম! আপনার স্মৃতি অম্লান হয়ে থাকুক আমাদের লড়াইয়ের পথ চলায়।
আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে, ইনসাফের এই যুদ্ধে আসছে ফাগুন আমরা দ্বিগুণ হবো, আমরা সবাই হাদি হবো।
সাজিদ সামী চৌধুরী।লেখক,সম্পাদক, দ্য কমন রান।শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, চিটাগাং ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি।
