১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে আমরা সাধারণত একটি জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম হিসেবে দেখি—ভাষা, সংস্কৃতি, গণতন্ত্র ও আত্মপরিচয়ের লড়াই। এই দৃষ্টিভঙ্গি আবেগগতভাবে সত্য, কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে অসম্পূর্ণ। কারণ এই যুদ্ধ কেবল একটি রাষ্ট্রের ভেতরের শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ছিল না; এটি সংঘটিত হয়েছিল একটি বৃহত্তর বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে—ঠান্ডা যুদ্ধের উত্তপ্ত ছায়ায়, যেখানে মানবিকতা প্রায়শই কৌশলের কাছে পরাজিত হতো।
প্রশ্ন উঠতেই পারে: বাংলাদেশ কি কেবল দুটি পরাশক্তির রাজনৈতিক দাবার বোর্ডে একটি ঘুঁটি ছিল? নাকি বাঙালির নিজস্ব রাজনৈতিক ইচ্ছা, দীর্ঘদিনের বঞ্চনা ও সংগঠিত প্রতিরোধই ছিল ইতিহাসের প্রধান চালিকা শক্তি?
এই প্রবন্ধে সেই প্রশ্নেরই বিশ্লেষণ করা হবে—বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ঠান্ডা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রেখে, জাতীয় সংগ্রাম ও বৈশ্বিক রাজনীতির পারস্পরিক সম্পর্ক অনুধাবন করার চেষ্টা হিসেবে।
ঠান্ডা যুদ্ধ: দ্বিমেরু বিশ্বের রাজনীতি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী পৃথিবী বিভক্ত হয়ে পড়ে দুটি প্রধান শক্তি বলয়ে— যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা (পুঁজিবাদী ব্লক) এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার সমাজতান্ত্রিক মিত্ররা। এই বিভাজনের কেন্দ্রে ছিল আদর্শগত দ্বন্দ্ব—পুঁজিবাদ বনাম সমাজতন্ত্র। কিন্তু এই দ্বন্দ্ব শুধু অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রশ্ন ছিল না; এটি ছিল রাষ্ট্রক্ষমতা, সামরিক আধিপত্য, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ ও আদর্শিক নিয়ন্ত্রণের প্রতিযোগিতা।
এই যুদ্ধ সরাসরি সামরিক সংঘাতে রূপ নেয়নি বলেই একে বলা হয় “ঠান্ডা” যুদ্ধ; কিন্তু এর প্রভাব ছিল অত্যন্ত উষ্ণ ও রক্তক্ষয়ী। প্রক্সি যুদ্ধ, সামরিক জোট, অর্থনৈতিক সাহায্য, কূটনৈতিক চাপ, গুপ্তচরবৃত্তি এবং সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে পরাশক্তিরা নিজেদের স্বার্থ বাস্তবায়ন করেছে।
এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার সদ্য স্বাধীন দেশগুলো—যারা নিজের রাষ্ট্রীয় পরিচয় গড়ে তোলার সংগ্রামে ছিল—এই দ্বন্দ্বের প্রধান মঞ্চে পরিণত হয়। দক্ষিণ এশিয়াও এর বাইরে ছিল না; বরং ভূরাজনৈতিক অবস্থানের কারণে এটি হয়ে ওঠে একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর অঞ্চল।
পাকিস্তান: ঠান্ডা যুদ্ধের এক ‘প্রিয় মিত্র’পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর থেকেই দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্রে পরিণত হয়। এই ঘনিষ্ঠতা কোনো আদর্শিক মিল থেকে আসেনি; বরং এটি ছিল কৌশলগত। ১৯৫০–৬০-এর দশকে পাকিস্তান যুক্ত হয় SEATO ও CENTO-এর মতো সামরিক জোটে—যেগুলো ছিল মূলত সোভিয়েত সম্প্রসারণ ঠেকানোর জন্য গঠিত।বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে দেয় বিপুল সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা। এই সহায়তা পাকিস্তানকে একটি শক্তিশালী সামরিক রাষ্ট্রে পরিণত করে, কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নয়। বরং রাজনৈতিক আন্দোলন দমনে, সামরিক অবকাঠামো শক্তিশালী করতে এবং কেন্দ্রীয় শাসন কায়েম রাখতে।
এই সহায়তার বড় অংশই ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে এই সহায়তা কার্যত পরিণত হয় দমনযন্ত্রে। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্রের ঠান্ডা যুদ্ধ-নীতির সরাসরি ও বাস্তব প্রভাব পড়ে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক বাস্তবতায়—যেখানে একটি জনগোষ্ঠী পরাশক্তির কৌশলের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার শিকার হয়।
পূর্ব পাকিস্তান: উপনিবেশের মতো শাসন
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের সময়ই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যের বীজ রোপিত হয়। ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা, ভাষাগত পার্থক্য ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতা সত্ত্বেও একটি কৃত্রিম জাতীয় পরিচয় চাপিয়ে দেওয়া হয়।
এই বৈষম্য প্রকাশ পায়—ভাষাগত বৈষম্যে (উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টা), অর্থনৈতিক শোষণে (পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ দিয়ে পশ্চিমের উন্নয়ন) এবং সামরিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতার বঞ্চনায়।
পূর্ব পাকিস্তান কার্যত পরিণত হয় একটি “অভ্যন্তরীণ উপনিবেশে”—যেখানে শাসন চলে দূরবর্তী কেন্দ্র থেকে, জনগণের সম্মতি ছাড়াই।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান—সবই ছিল এই শোষণের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক প্রতিরোধ। কিন্তু ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় সত্ত্বেও ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা যে পথ বেছে নেয়, তা কেবল রাজনৈতিক ব্যর্থতা নয়; এটি ছিল রাষ্ট্রীয় সহিংসতার সচেতন সিদ্ধান্ত।এখানে প্রশ্ন ওঠে—এটি কি কেবল পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সংকট ছিল, নাকি বৈশ্বিক শক্তির নীরব সমর্থন এই দমননীতিকে সম্ভব করেছিল?
যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান: গণতন্ত্র বনাম কৌশল
১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে পাকিস্তানের পাশে দাঁড়ায়—যদিও তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব বাংলায় গণহত্যা চালাচ্ছিল, লক্ষ লক্ষ মানুষ শরণার্থী হয়ে ভারতে পালাচ্ছিল।
এর কারণ কী? কারণ ছিল ঠান্ডা যুদ্ধের কৌশলগত বাস্তবতা। পাকিস্তান ছিল যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের গোপন কূটনৈতিক যোগাযোগে পাকিস্তান ছিল মধ্যস্থতাকারী। ভারত তখন সোভিয়েত ঘনিষ্ঠ।
এই বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গণতন্ত্র বা মানবাধিকার ছিল গৌণ বিষয়। রাষ্ট্রীয় স্বার্থই ছিল মুখ্য। এই অবস্থানের সবচেয়ে শক্ত প্রমাণ মার্কিন কূটনীতিক আর্চার ব্লাডের বিখ্যাত “Blood Telegram”—যেখানে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যাকে ‘নৈতিক দেউলিয়াত্ব’ বলে আখ্যা দেন। কিন্তু ওয়াশিংটন সেই প্রতিবাদ উপেক্ষা করে। এটি দেখায়, ঠান্ডা যুদ্ধের রাজনীতিতে নৈতিকতা কতটা নির্বাসিত ছিল।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের ভূমিকা
অন্যদিকে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখেছিল। এটি শুধু নৈতিক অবস্থান ছিল না; এটি ছিল কৌশলগত হিসাবও।
১৯৭১ সালের আগস্টে স্বাক্ষরিত ভারত–সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি ছিল একটি মোড় ঘোরানো ঘটনা। এটি নিশ্চিত করে যে— ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গেলে সোভিয়েত সমর্থন পাবে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সম্ভাব্য হস্তক্ষেপ ঠেকানো যাবে। সোভিয়েত ইউনিয়ন জাতিসংঘে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একাধিক প্রস্তাব ভেটো দেয়। এই কূটনৈতিক ছাতা না থাকলে যুদ্ধের ফলাফল ভিন্ন হতে পারত।
এখানে লক্ষ্যণীয়—সোভিয়েত সমর্থন মানবিকতার সঙ্গে কৌশলের এক বিরল মিলন ঘটিয়েছিল।
চীন; নীরব কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়
চীন প্রকাশ্যে পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেয় এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে দীর্ঘদিন স্বীকৃতি দেয়নি। জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ আটকে দিয়েছিল।
এর পেছনে মূল কারণ ছিল ভারতবিরোধী অবস্থান এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি শত্রুতা। চীনের দৃষ্টিতে বাংলাদেশ ছিল একটি মানবিক ট্র্যাজেডি নয়, বরং একটি ভূরাজনৈতিক সমীকরণ। এটি ঠান্ডা যুদ্ধের সবচেয়ে নির্মম বাস্তবতা—মানুষ নয়, মানচিত্রই ছিল সিদ্ধান্তের কেন্দ্রে।
বাংলাদেশ: কেবল একটি দাবার ঘুঁটি?
এই সমস্ত বৈশ্বিক শক্তির টানাপোড়েনে সহজেই মনে হতে পারে—বাংলাদেশ ছিল কেবল একটি যুদ্ধক্ষেত্র। কিন্তু এই ধারণা আংশিক সত্য।কারণ, যদি কেবল পরাশক্তির রাজনীতিই নির্ধারক হতো, তাহলে নয় মাসের গণপ্রতিরোধ গড়ে উঠত না। মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ ইতিহাস বদলাতে পারত না। সাত মার্চের ভাষণ একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারত না
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কেন্দ্রে ছিল জনগণের রাজনৈতিক ইচ্ছা। আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করেছে, কিন্তু তারা যুদ্ধ সৃষ্টি করেনি।
মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—বাঙালিরা নিজেরাই ইতিহাসের চালক ছিল। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, নারী—সবাই যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। মুজিবনগর সরকার রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে তোলে। সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ (গান, কবিতা, প্রচারপত্র) যুদ্ধকে গণআন্দোলনে রূপ দেয়।
এই এজেন্সি ছাড়া কোনো আন্তর্জাতিক সমর্থনই কার্যকর হতো না। বিশ্ব রাজনীতি সুযোগ তৈরি করতে পারে, কিন্তু ইতিহাস লেখে জনগণই।
স্বাধীনতার পর: ঠান্ডা যুদ্ধের ছায়া রয়ে গেল
১৯৭১-এ যুদ্ধ শেষ হলেও ঠান্ডা যুদ্ধের ছায়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে রয়ে যায়। ১৯৭৫-এর রাজনৈতিক পরিবর্তন, সামরিক শাসনের উত্থান, পররাষ্ট্রনীতিতে ভারসাম্য রক্ষার চাপ-এসবই প্রমাণ করে যে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও বৈশ্বিক শক্তির প্রভাব থেকে পুরোপুরি মুক্ত ছিল না। স্বাধীনতা মানেই পরিপূর্ণ সার্বভৌমত্ব নয়, বিশেষ করে ঠান্ডা যুদ্ধের যুগে।
তাহলে প্রশ্নের উত্তর কী? উত্তর হলো, বাংলাদেশ কেবল একটি যুদ্ধক্ষেত্র ছিল না।কিন্তু এটাও সত্য যে, বাংলাদেশ একটি বৈশ্বিক ক্ষমতার সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিল—নিজের ইচ্ছার বাইরে।
মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের লড়াই, কিন্তু সেই লড়াই সংঘটিত হয়েছিল ঠান্ডা যুদ্ধের নিষ্ঠুর বাস্তবতায়। পরাশক্তিরা নিজেদের স্বার্থ দেখেছে, কিন্তু ইতিহাসের গতিপথ নির্ধারণ করেছে বাংলার মানুষই।একাত্তর তাই শুধু একটি যুদ্ধ নয়— বরং এটি প্রমাণ করে, ছোট একটি জাতিও বৈশ্বিক রাজনীতির মাঝখানে দাঁড়িয়ে নিজের ভবিষ্যৎ নিজে লিখতে পারে।
মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন।
