বাংলাদেশের সংবিধানের ২ক অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হলেও সকল ধর্মের সমান অধিকার ও মর্যাদার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ময়মনসিংহের ভালুকায় দীপু চন্দ্র দাসের সাথে ঘটে যাওয়া পৈশাচিক ঘটনা আমাদের সেই সাংবিধানিক অঙ্গীকারকে উপহাস করছে। স্রেফ একটা গুজবের ভিত্তিতে একজন মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করে গাছে ঝুলিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে এটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রকাঠামোতে এক ভয়াবহ অসহিষ্ণুতা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি শিকড় গেড়েছে।
বর্তমান সময়ে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করে গুজব ছড়ানো এবং তার ভিত্তিতে ‘মব জাস্টিস’ বা গণপিটুনির মাধ্যমে প্রাণহানি ঘটানো একটি নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দীপু চন্দ্র দাসের ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখা গেছে। র্যাব ও অন্যান্য তদন্ত সংস্থাগুলোর ভাষ্যমতে, ধর্ম অবমাননার কোনো প্রমাণ না পাওয়া সত্ত্বেও একদল উন্মত্ত জনতা কেবল হুজুগের বসে আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। যখন গুজবই সত্যের জায়গা দখল করে নেয় এবং সাধারণ মানুষ বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তখন সেই সমাজে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা তলানিতে গিয়ে ঠেকে। এই প্রবণতা কেবল সংখ্যালঘুদের জন্য নয়, বরং রাষ্ট্রের আইনি কাঠামোর জন্যই চরম হুমকি।
অনেকে মনে করেন অভিযুক্তকে তাৎক্ষণিক শাস্তি দেওয়াই ধর্মের রক্ষা, কিন্তু তারা ভুলে যান যে রাষ্ট্র ও ধর্ম কোনোটিই এই বর্ববরতাকে সমর্থন করে না। বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে ধর্মীয় অবমাননার বিচার করার সুনির্দিষ্ট বিধান রয়েছে। ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির (Penal Code) ২৯৫এ ধারা অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে এবং বিদ্বেষমূলকভাবে কোনো শ্রেণির ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে, তবে তার জন্য সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। এছাড়া দণ্ডবিধির ২৯৮ ধারায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার জন্য এক বছরের কারাদণ্ডের কথা উল্লেখ আছে। আইন অনুযায়ী যেখানে অপরাধীকে শাস্তির আওতায় উপায় রয়েছে, সেখানে অভিযুক্তকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করাই ছিল একমাত্র আইনসংগত ও সভ্য পথ। কিন্তু তা না করে যে নৃশংসতা ভালুকায় দেখানো হয়েছে, তা প্রমাণ করে আমরা আইন ও বিচার ব্যবস্থার তোয়াক্কা করছি না। একজন মানুষকে জীবন্ত বা মৃত পুড়িয়ে মারা কোনো ধর্ম বা সভ্য দেশের আইন সমর্থন করে না। এটি ধর্মীয় আবেগ নয়, বরং চরম অসহিষ্ণুতা ও পৈশাচিকতার বহিঃপ্রকাশ। পবিত্র কুরআনেও বলা হয়েছে, “যে ব্যক্তি নিরপরাধ কাউকে হত্যা করল, সে যেন দুনিয়ার সমস্ত মানুষকেই হত্যা করল।” (সূরা মায়িদাহ: ৩২)।
দীপু চন্দ্র দাসের এই করুণ মৃত্যু আমাদের সমাজের এক অন্ধকার দিক উন্মোচিত করেছে। আমরা এমন এক সমাজে বাস করছি যেখানে অন্যের জীবন নেওয়া এখন অত্যন্ত সহজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পরমতসহিষ্ণুতা এবং সহাবস্থানের যে ঐতিহ্য আমাদের ছিল, তা আজ সংকটের মুখে। যখনই কোনো সংখ্যালঘু ব্যক্তি কোনো অভিযোগের সম্মুখীন হন, কোন ধরণের বিচার প্রক্রিয়ার সুযোগ না দিয়ে তাকে তখনই শারীরিকভাবে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করা হয়। এই অসহিষ্ণুতা কেবল ব্যক্তিগত আক্রোশ নয়, বরং দীর্ঘদিনের বিচারহীনতার ফল। অতীতে রামু, নাসিরনগর বা শাল্লার মতো ঘটনায় অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় আজ উন্মত্ত জনতা নিজেকে আইনের ঊর্ধ্বে মনে করছে।
সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা কেবল উৎসবের সময়ে মণ্ডপ পাহারা দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি নিশ্চিত হবে তখন, যখন আর ঐ পাহারাটুকুও দেবার প্রয়োজন থাকবে না। সে সুদূর ভবিষ্যতের কথা। বর্তমানে, রাষ্ট্রকে অবশ্যই এই ‘মব কালচার’ বা গণ-আদালতের সংস্কৃতি কঠোর হাতে দমন করতে হবে। অবিলম্বে সরকারকে ভালুকার হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের অধীনে এনে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।এছাড়াও, দণ্ডবিধির যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করে জনগণকে বোঝাতে হবে যে, আইন হাতে তুলে নেওয়া একটি গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ। বাংলাদেশ কেবল একটি বিশেষ ধর্মের মানুষের নয়, এটি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে এদেশের প্রতিটি নাগরিকের। দীপু চন্দ্র দাসের মরদেহে যে আগুন জ্বলছে, তা আসলে আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনারই দাহ। যদি এখনই আমরা এই অসহিষ্ণুতার বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলতে না পারি, তবে আজ যে আগুন সংখ্যালঘুদের ঘরে লেগেছে, তা কাল আপনার ঘর পর্যন্ত পৌঁছে যাবে।
অপরাজিতা দেবনাথ, এডভোকেট, ঢাকা জজ কোর্ট
