বড়দিন মানেই আজ আমাদের চোখে যে ছবিটি ভেসে ওঠে, তা প্রায় অভিন্ন—একজন হাসিখুশি, গোলগাল চেহারার বৃদ্ধ, সাদা দাড়ি, লাল কোট, কোমরে কালো বেল্ট, মাথায় লাল টুপি। তিনি শিশুদের জন্য উপহার নিয়ে আসেন, স্লেজে চড়ে উড়ে বেড়ান, আর তার চারপাশে থাকে আনন্দ, উষ্ণতা ও উৎসবের রং। এই চেহারার নাম সান্তা ক্লজ। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই সান্তা কি চিরকাল এমনই ছিলেন? লাল রঙের এই সান্তা কি ধর্মীয় ঐতিহ্যের স্বাভাবিক ফল, নাকি আধুনিক বিজ্ঞাপন জগতের এক সফল নির্মাণ?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের যেতে হয় বড়দিনের ধর্মীয় ইতিহাস, ইউরোপীয় লোককথা, শিল্পকলার বিবর্তন এবং সর্বোপরি—বিশ শতকের কর্পোরেট বিজ্ঞাপনের ভেতরে। আর এই পুরো যাত্রাপথে একটি নাম বারবার সামনে আসে: কোকাকোলা।
বড়দিনের শিকড়: ধর্মীয় উৎসব থেকে লোকজ সংস্কৃতি
বড়দিনের সূচনা খ্রিষ্টধর্মে যিশু খ্রিষ্টের জন্মোৎসব হিসেবে। বাইবেলে যিশুর জন্মের নির্দিষ্ট তারিখ উল্লেখ নেই, তবু চতুর্থ শতাব্দীতে ২৫ ডিসেম্বরকে বড়দিন হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ধর্মীয় উৎসবের সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে ইউরোপের শীতকালীন লোকাচার—আলো জ্বালানো, উপহার দেওয়া, পরিবারে মিলিত হওয়া।
এই উপহার দেওয়ার ধারণার সঙ্গে জড়িয়ে আছে সেন্ট নিকোলাস নামের এক ঐতিহাসিক চরিত্র। তিনি ছিলেন চতুর্থ শতাব্দীর এক খ্রিষ্টান বিশপ, যিনি গরিবদের সাহায্য করতেন, শিশুদের প্রতি ছিলেন দয়ালু। ইউরোপের নানা অঞ্চলে তার গল্প লোককথার রূপ নেয়। ডাচদের কাছে তিনি ‘সিন্টারক্লাস’, জার্মানিতে ‘সেন্ট নিকোলাস’, আর ইংরেজি সংস্কৃতিতে ধীরে ধীরে তিনি হয়ে ওঠেন ‘সান্তা ক্লজ’।
তবে এই সান্তা তখনো আমাদের পরিচিত লাল পোশাকের হাসিখুশি বৃদ্ধ নন। কখনো তিনি ছিলেন গম্ভীর ধর্মযাজক, কখনো লম্বা-পাতলা, কখনো আবার সবুজ বা বাদামি পোশাকে।
সান্তার রূপান্তর: শিল্পী ও কবিদের হাতে
উনিশ শতকে আমেরিকায় সান্তার চরিত্র নতুনভাবে গড়ে উঠতে শুরু করে। ১৮২৩ সালে প্রকাশিত ক্লিমেন্ট ক্লার্ক মুরের কবিতা A Visit from St. Nicholas (যা সাধারণভাবে “’Twas the Night Before Christmas” নামে পরিচিত) সান্তার ব্যক্তিত্বে বড় পরিবর্তন আনে। এখানে সান্তা হয়ে ওঠেন ছোটখাটো, চঞ্চল, হাসিখুশি এক চরিত্র—যিনি চিমনি দিয়ে ঘরে ঢোকেন।
পরবর্তী সময়ে চিত্রশিল্পী থমাস ন্যাস্ট (Thomas Nast) ১৮৬০ ও ১৮৭০-এর দশকে সান্তার নানা চিত্র আঁকেন। তিনি প্রথমবারের মতো সান্তাকে উত্তর মেরুতে বসবাসকারী, উপহার বিতরণকারী এক পূর্ণাঙ্গ চরিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। ন্যাস্টের আঁকায় সান্তার পোশাক কখনো লাল, কখনো সবুজ—কোনো নির্দিষ্ট রঙ তখনো স্থায়ী হয়নি।
অর্থাৎ, বিশ শতকের শুরু পর্যন্ত সান্তা ছিলেন এক ধরনের ‘ফ্লুইড’ চরিত্র—রূপ বদলাতেন সময় ও সংস্কৃতি অনুযায়ী।
বিশ শতক ও বিজ্ঞাপনের যুগ
বিশ শতক ছিল শিল্প, প্রযুক্তি ও গণমাধ্যমের বিস্ফোরণের সময়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা ও ইউরোপে শিল্প উৎপাদন বাড়ে, শহরায়ণ ঘটে, মানুষের হাতে আসে অতিরিক্ত আয়। এই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জন্ম নেয় ভোক্তা সংস্কৃতি।
এখন আর শুধু প্রয়োজন মেটানোর জন্য পণ্য কেনা হয় না—পণ্য কেনা হয়ে ওঠে পরিচয়, আনন্দ ও সামাজিক মর্যাদার অংশ। আর এই নতুন ভোক্তাকে আকর্ষণ করার প্রধান অস্ত্র ছিল বিজ্ঞাপন।
পত্রিকা, পোস্টার, বিলবোর্ড, পরে রেডিও ও টেলিভিশন—সবখানেই বিজ্ঞাপন মানুষের আবেগকে লক্ষ্য করে তৈরি হতে থাকে। যুক্তি নয়, অনুভূতি—এই হয়ে ওঠে বিজ্ঞাপনের ভাষা।
বিশ শতকের প্রথমার্ধে আমেরিকায় ভোক্তা সংস্কৃতির উত্থান ঘটে। শিল্পোন্নয়ন, গণমাধ্যমের বিস্তার, ম্যাগাজিন ও বিলবোর্ড বিজ্ঞাপন মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে ওঠে।
বিজ্ঞাপনকারীরা দ্রুত বুঝে যান—বড়দিন আবেগের দিক থেকে সবচেয়ে শক্তিশালী সময়। পরিবার, নস্টালজিয়া, শৈশব, দান, উষ্ণতা—সব আবেগ একসঙ্গে উপস্থিত থাকে এই উৎসবে।
ফলে বড়দিন হয়ে ওঠে কর্পোরেট গল্প বলার সবচেয়ে কার্যকর মঞ্চ। একটি পণ্য যদি বড়দিনের আনন্দের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে, তবে সেটি মানুষের স্মৃতিতে স্থায়ী হয়ে যায়।
এই জায়গাতেই বড়দিন ধীরে ধীরে ধর্মীয় উৎসব থেকে ব্র্যান্ডেড উৎসবে রূপ নেয়। কর্পোরেট ব্র্যান্ডগুলো বড়দিনকে নিজেদের গল্প বলার মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। বড়দিন মানে পরিবার, উষ্ণতা, আনন্দ—এই আবেগের সঙ্গে নিজেদের পণ্য জুড়ে দেওয়া ছিল বিজ্ঞাপনের প্রধান লক্ষ্য। আর এই কাজটি সবচেয়ে সফলভাবে করেছিল কোকাকোলা।
কোকাকোলা ও সান্তা: এক ঐতিহাসিক জুটি
কোকাকোলা বিশ শতকের শুরু থেকেই নিজেকে শুধু কোমল পানীয় হিসেবে নয়, বরং একটি অনুভূতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। তাদের বিজ্ঞাপনের ভাষা ছিল—বন্ধুত্ব, পরিবার, আনন্দ, একসঙ্গে সময় কাটানো।
বড়দিন এই দর্শনের সঙ্গে নিখুঁতভাবে মিলে যায়।
১৯৩০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনৈতিক মন্দা (Great Depression) চলছে। মানুষ হতাশ, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। এই সময়ে কোকাকোলা বড়দিনের বিজ্ঞাপনে যে বার্তা দেয়, তা হলো—ছোট ছোট আনন্দের মধ্যেই জীবনের উষ্ণতা খুঁজে নেওয়া।
কোকাকোলা প্রথম বড়দিন-ভিত্তিক বিজ্ঞাপন দেয় ১৯৩০-এর দশকে। তবে প্রকৃত বিপ্লব ঘটে ১৯৩১ সালে, যখন শিল্পী হ্যাডন সান্ডব্লম (Haddon Sundblom) কোকাকোলার জন্য সান্তার একটি সিরিজ ইলাস্ট্রেশন আঁকেন।এই সান্ডব্লম-সান্তাই আজকের পরিচিত সান্তার আদর্শ রূপ।
লাল রঙের উজ্জ্বল কোট, সাদা পশমের কলার, হাসিখুশি, মানবিক মুখ, শিশুদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ, ক্লান্তির পর কোকাকোলা পান করে তৃপ্তি।
কোকাকোলার বিজ্ঞাপনে সান্তা আর দূরের কোনো রহস্যময় চরিত্র নন—তিনি পরিবারের একজন, আমাদের মতোই মানুষ, শুধু একটু বেশি দয়ালু ও আনন্দময়।
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লক্ষণীয়: কোকাকোলার ব্র্যান্ড রঙও লাল। সান্তার পোশাকের লাল রঙ কোকাকোলার বোতল, লোগো ও ভিজ্যুয়াল আইডেন্টিটির সঙ্গে নিখুঁতভাবে মিলে যায়। ফলে বিজ্ঞাপন ও উৎসবের প্রতীক একে অপরের সঙ্গে গাঁথা হয়ে যায়।
কোকাকোলা কি সান্তাকে ‘আবিষ্কার’ করেছে?
একটি প্রচলিত ধারণা হলো—কোকাকোলাই নাকি সান্তার লাল পোশাক তৈরি করেছে। বাস্তবতা একটু জটিল।সান্তার লাল পোশাকের ধারণা কোকাকোলার আগেও ছিল, কিন্তু তা ছিল অনিয়মিত ও অসংহত। কোকাকোলার কৃতিত্ব হলো—এই রূপটিকে স্ট্যান্ডার্ডাইজ করা। বিজ্ঞাপন, ম্যাগাজিন, পোস্টার ও পরে টেলিভিশনের মাধ্যমে তারা সান্তার এই রূপকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়।
একই ছবি বারবার দেখলে মানুষের কল্পনায় সেটাই ‘স্বাভাবিক’ হয়ে যায়। কোকাকোলা ঠিক সেটাই করেছে—সান্তার বহু সম্ভাব্য রূপের মধ্য থেকে একটি রূপকে স্থায়ী করে দিয়েছে।
বড়দিনের বদলে যাওয়া অর্থ
কোকাকোলার বিজ্ঞাপনের পর বড়দিন আর শুধু গির্জা-কেন্দ্রিক উৎসব থাকেনি। এটি হয়ে ওঠে—
পারিবারিক পুনর্মিলনের সময়,উপহার বিনিময়ের মৌসুম,কেনাকাটার উৎসব,আবেগঘন বিজ্ঞাপনের সময়।বড়দিনের গল্পে যিশুর জন্মের পাশাপাশি জায়গা নেয় সান্তা, উপহার, খাবার, পানীয়। ধর্মীয় আবহের সঙ্গে যুক্ত হয় ভোক্তাবাদ।
এখানে কোকাকোলা একা নয়—অন্যান্য ব্র্যান্ডও বড়দিনকে নিজেদের মতো করে ব্যবহার করেছে। তবে কোকাকোলার সাফল্য ছিল সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ও সাংস্কৃতিকভাবে গভীর।
এই পরিবর্তন নিয়ে সমালোচনাও কম নয়। অনেক ধর্মীয় চিন্তাবিদ মনে করেন, বড়দিনের মূল আধ্যাত্মিক তাৎপর্য হারিয়ে গেছে কর্পোরেট আগ্রাসনে। সান্তা, উপহার আর বিজ্ঞাপনের ভিড়ে যিশুর জন্মের বার্তা চাপা পড়ে যাচ্ছে।
আবার কোনো কোনো সংস্কৃতিবিদ ও সমালোচকরা বলেন, এটি এক ধরনের সাংস্কৃতিক উপনিবেশবাদ—যেখানে একটি আমেরিকান কর্পোরেট কল্পনা পুরো বিশ্বের বড়দিনের চেহারা নির্ধারণ করে দিচ্ছে। ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা, এমনকি এশিয়ার দেশগুলোতেও বড়দিন মানেই এখন কোকাকোলা-ঘরানার সান্তা।
তবু কেন এই সান্তা এত জনপ্রিয়?
সমালোচনা সত্ত্বেও লাল রঙের সান্তা আজও জনপ্রিয়। কারণ তিনি—
ভয়ের নয়, উষ্ণতার প্রতীক।ধর্মীয় বিভাজনের ঊর্ধ্বে।শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক—উভয়ের কাছেই গ্রহণযোগ্য। আনন্দ ও দানশীলতার সহজ প্রতিচ্ছবি।এই সান্তা আমাদের কঠিন বাস্তবতা থেকে একটু আশ্রয় দেন—একটা কল্পনার জগৎ, যেখানে কেউ নিঃস্বার্থভাবে দেয়।
বিজ্ঞাপন, সংস্কৃতি ও আমাদের স্মৃতি
লাল রঙের সান্তা কেবল একটি চরিত্র নন—তিনি আধুনিক বিশ্বের এক সাংস্কৃতিক দলিল। তিনি দেখান, কীভাবে বিজ্ঞাপন আমাদের উৎসব, স্মৃতি ও কল্পনাকে গড়ে তুলতে পারে। কোকাকোলার বিজ্ঞাপন বড়দিনকে ‘বদলে দিয়েছে’—এই বদল ভালো না খারাপ, তা বিতর্কের বিষয়। কিন্তু বদল যে হয়েছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
আজ বড়দিন এলেই আমরা যখন লাল রঙের সান্তাকে দেখি, তখন আমরা আসলে শুধু এক উৎসব নয়—দেখি শত বছরের ইতিহাস, শিল্প, বাজার অর্থনীতি আর মানুষের আবেগের মিলিত প্রতিফলন।আর সেই প্রতিফলনের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে থাকেন—এক বোতল কোকাকোলা হাতে, হাসিমুখে—লাল রঙের সান্তা।
মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন।
