শিক্ষাক্রম বিষয়টাখুব সহজে বুঝার জন্য রাফ টাইলারের ৪টি মৌলিক প্রশ্নই যথেষ্ট। প্রশ্ন ৪টি হলো- (১) শিক্ষার উদ্দেশ্য কী হবে? (২) কী কী শিখন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এই উদ্দেশ্য অর্জিত হবে? (৩) এই শিখন অভিজ্ঞতা সংগঠন বা আয়োজন করা হবে কীভাবে? (৪) শিক্ষার উদ্দেশ্য অর্জিত হয়েছে কি না তা মূল্যায়ন করা হবে কীভাবে? অর্থাৎ, মোটাদাগে শিক্ষার উদ্দেশ্য, বিষয়বস্তু, পদ্ধতি এবং মূল্যায়নের সমষ্টিই হলো কারিকুলাম বা শিক্ষাক্রম। শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করার পরেই মূলত আসল কাজ শুরু। তবে শুরুতে এই কাজটা করা জরুরী, ক্বিবলা ঠিক করার মতন। এরপর এই লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যই পরের ধাপের জন্য গাইড হিসাবে কাজ করে।
নীতি নির্ধারক থেকে শিক্ষার্থী পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে শিক্ষাক্রম হাত বদল হয়।বিভিন্ন পর্যায়ের হিসাব করলেশিক্ষাক্রমকে মোটাদাগে ৩(তিন) ভাগে ভাগ করা যায়। ইনটেন্ডেড কারিকুলাম, ইমপ্লিমেন্টেড/ ইন্যাক্টেড কারিকুলাম, এটেইন্ড/ এচিভড কারিকুলাম।
ইনটেন্ডেড কারিকুলাম (কাঙ্ক্ষিত শিক্ষাক্রম): নীতি নির্ধারক কিংবা রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষা রূপায়নের উদ্দেশ্যে যে কারিকুলাম প্রত্যাশা করেন, সেটাই ইনটেন্ডেড কারিকুলাম। এটা বাস্তবসম্মত কিংবা বাস্তবতা বিবর্জিত কিংবা অতি উচ্চাকাঙ্খীও হতে পারে। বাস্তবসম্মত না হলে তখন শিক্ষাক্রমটি বাস্তবায়ন করা দুরূহ হয়ে পড়ে। দলিল হিসেবে শিক্ষাক্রম বিশ্বমানের হলেও বাস্তবায়ন করার সক্ষমতার অভাবে এই কারিকুলাম জাতিকে নিরাশ করে।
ইমপ্লিমেন্টেড কারিকুলাম (বাস্তবায়িত শিক্ষাক্রম): লিখিত শিক্ষাক্রম শিক্ষকের হাত ধরে শ্রেণীকক্ষে যখন বাস্তবায়ন হয়, সেটা হলো বাস্তবায়িত শিক্ষাক্রম। নিজে নিজে পড়ে এবং প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞানের আলোকে যে শিক্ষক যতটুকু বাস্তবায়ন করতে পারেন, সেটুকু হলো এই বাস্তবায়িত কারিকুলাম। আমাদের দেশের সমাজ বাস্তবতায় শিক্ষকগণ যে পরিবেশে যেভাবে কাজ করেন তাতে ইনটেন্ডেড কারিকুলামের পুরোটা বাস্তবায়ন করতে পারেন না। ফলে,এই দ্বিতীয় ধাপে আসতে গিয়েই শিক্ষাক্রমের বেশ কিছুটা খোয়া যায়। বাস্তবায়নের দক্ষতা, জনবল, অর্থ ও উপকরণ যত চ্যালেঞ্জিং হবে ইনটেন্ডেড কারিকুলাম এবং ইমপ্লিমেন্টেড কারিকুলামের মধ্যে তত ফারাক তৈরী হবে।
এটেইন্ড কারিকুলাম (অর্জিত শিক্ষাক্রম): শিক্ষাবিদ ইনটেন্ডেড কারিকুলাম বানালেন, শিক্ষক ইমপ্লিমেন্ট করলেন কিন্তু শিক্ষার্থী শেষমেশ কী পেল বা অর্জন করলো সেটাই মূখ্য। কেননা পরীক্ষা তো আর শিক্ষকের হয় না, পরীক্ষা হয় শিক্ষার্থীর। তাই শিক্ষকের সিলেবাস শেষ হয়ে কোন লাভ নেই, যতক্ষণ না শিক্ষার্থী নিজে সিলেবাস শেষ করতে পারছে। এইখানেও গ্যাপ দেখা যায়। শিক্ষক ক্লাসে যতটুকু দেন বলে দাবী করেন, আর্থসামাজিক কারণসহ আরও হাজারো কারনে আমাদের শিক্ষার্থীরা ততটুকু পায় বলে প্রমাণ হয় না।
এখন, নানা কারনে এই ৩ ধাপের মধ্যে গ্যাপ তৈরী হতে পারে। আপনার উচ্চাকাঙ্খা আপনার ইনটেন্ডেড কারিকুলামকে বাংলাদেশের বাস্তবতা থেকে দূরে সরিয়ে ফিনল্যান্ডে নিয়ে যেতে পারে। আবার হয়ত, দেশের কথা ভেবেই আপনি মধ্যবিত্ত কারিকুলাম বানালেন কিন্তু শিক্ষক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর যে অবকাঠামো এবং উপকরণ দরকার তা আপনি দিলেন না। তাহলে, এই মধ্যবিত্তের কারিকুলাম নিম্নবিত্তের সংসারে গিয়ে ফেইল করবে। এবার আপনি শিক্ষার্থীর কথা একবার ভেবে দেখেন, সে আসলে কতটুকু কী পেলো। শিক্ষার্থীর এই প্রাপ্তি বা অর্জনটুকুই আসল। এর জন্যই এত কষ্ট, এত আয়োজন। শিক্ষার্থীর এই অর্জন দিয়েই শিক্ষাক্রমের সফলতা কিংবা ব্যর্থতা পরিমাপ করতে হবে।
শিক্ষাক্রম তৈরীর সাথে যুক্ত ব্যক্তিবর্গের কারিকুলার এক্টিভিটি, কো-কারিকুলার এবং এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটিস, হিডেন কারিকুলাম সম্পর্কে ভালোরকম বোঝাপড়া থাকা দরকার। নাহলে এই সবকিছু এক শিক্ষাক্রমের মধ্যে ঠেসে দেয়ার প্রবণতা কাজ করে। তখন শিক্ষাক্রমটি নানাবিধ বিষয়বস্তুর ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। একইসাথে এর ফলে শিক্ষার অন্যান্য এজেন্সিগুলোকে খারিজ করে দেয়া হয়। আফ্রিকান একটা প্রবাদ আছে- ইট টেইকস আ ভিলেজ টু রেইজ আ চাইল্ড। অর্থাৎ, পরিবার, প্রতিবেশী, সহপাঠী, খেলার সাথী, সমাজ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, হাট-বাজার, আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদি মাধ্যম থেকেও মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে (উপানুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক উপায়ে)। এই সবকিছুর দায়িত্ব যখন একমাত্র স্কুলের কাঁধে তুলে দেওয়া হয় এবং আনুষ্ঠানিক শিক্ষাকেই কেবলমাত্র শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গণ্য করা হয়, তখন শিক্ষক-শিক্ষার্থী দুইজনেরই নাভিশ্বাস উঠে যায়, অভিভাবক হয়ে পড়ে দিশাহারা।
শিক্ষাক্রমের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শিক্ষক মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। তাই,এই কাজে শ্রেণি শিক্ষকদের যত্নসহকারে সম্মানের সহিত যুক্ত করতে হবে। সচরাচর যেটা ঘটে তা হলো- বড় বড় প্রফেসরদের সাথে স্কুল শিক্ষকদের একই দলে বসিয়ে দেয়া হয়। যেখানে শিক্ষকেরা অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ এবং বাস্তবজ্ঞানের দৌঁড়ে এগিয়ে থাকলেও মন খুলে মতামত দিতে সংকোচ বোধ করেন। তাদের সামনে প্রফেসররা ভুলভাল বললেও তারা একাডেমিক বাহাস করতে সাহস করেন না কিংবা প্রশ্ন তোলেন না। এরকম টেবিল থেকে প্রফেসরদের ভয়েস শিক্ষকদের ভয়েসকে ছাপিয়ে যায়। ফলে নিয়মরক্ষার জন্য স্কুল শিক্ষকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করলেও তাদের মতামত এবং চিন্তাধারা ঠিকঠাক প্রতিফলিত হয় না। পরিণামে যে কারিকুলাম তৈরী হয় তা শিক্ষকদের কাছে অনেকাংশে অপরিচিত এবং কিছুটা অবোধ্য। সেটা পরিচিত করানো এবং বোধগম্য করানোর জন্য আবার প্রশিক্ষণের আয়োজন করার দরকার পড়ে। কেতাবি ভাষায় এটাকে আমরা শিক্ষাক্রম বিস্তরণের প্রশিক্ষণ বলে থাকি। ক্যাসকেড মডেলে পরিচালিত এই প্রশিক্ষণের বিভিন্ন ধাপে প্রশিক্ষকের দক্ষতা, অর্থ এবং সময় কমতে থাকে, ফলে মাঠপর্যায়ের শিক্ষকগণের কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রশিক্ষণের মান কমে যায়। ফলে, এই আয়োজন খুব বেশি যে সফল হয় না তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। জনশ্রুতি আছে যে, ২০১২ সালের শিক্ষাক্রম বিস্তরণের ট্রেনিং ২০২১ সালের কারিকুলাম ফ্রেমওয়ার্ক তৈরির আগ পর্যন্ত শেষ করা যায়নি।
শিক্ষাক্রম তৈরীতে আমাদের অর্থ, সময় এবংশক্তির প্রায় শতভাগ খরচ হয়ে যায়, অথচ তখনও দুটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাকি- নির্দেশনা(ইনস্ট্রাকশন)এবং মূল্যায়ন (এসেসমেন্ট)। শিক্ষাক্রম যেরকমই বানানো হোকনা কেন ঠিকভাবে ইনস্ট্রাকশনের মাধ্যমে যদি সঠিক শিখন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীকে শিক্ষক না নিয়ে যেতে পারেন তাহলে বিশ্বমানের শিক্ষাক্রম বানিয়ে বিশ্বমানের হতাশায় ভুগতে হবে আপনাকে। দিনশেষে শিক্ষাক্রম একটা ডকুমেন্ট হয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপরের তাকেই রয়ে যাবে। তাই এটাকে শিক্ষকবান্ধব করে বানানো উচিৎ, যেন শিক্ষকের উপকারে আসে। আমাদের এইটা কেবল পুস্তক রচনাকারী এবং হাতেগোনা কয়েকজন শিক্ষা গবেষকের কাজে লাগে। অধিকাংশ সময়ে যেহেতু এটা শিক্ষকের কাছে দুর্বোধ্য মনে হয়, শিক্ষক এর সাথে পাঠ্যবইয়ের সংযোগ স্থাপন করতে গিয়ে ঝামেলায় পড়েন,তাইআবার শিক্ষাক্রম এবং পাঠ্যবইয়ের মাঝে সেতু হিসেবে শিক্ষক সহায়িকা বা টিচার গাইড নামক বস্তুর আবির্ভাব হয়।
আপাতত লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট- মূল্যায়ন। এইটার অনেক ধরণ আছে-গাঠনিক, ধারাবাহিক, সামষ্টিক। তবে উদ্দেশ্যের বিচারে মোটামুটি ৩ রকম বলা যায় (নাম শুনলেই উদ্দেশ্য বুঝতে পারবেন)- ১) শিখনের জন্য মূল্যায়ন (এসেসমেন্ট ফর লার্নিং), ২) শিখনই মূল্যায়ন (এসেসমেন্ট এ্যাজ লার্নিং), ৩) শিখনের মূল্যায়ন (এসেসমেন্ট অফ লার্নিং)। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা পরীক্ষাকেন্দ্রিক। এই পরীক্ষাকে কেন্দ্র করেই পড়াশুনা চলে। ফলে ভালো স্কুল বলতে এখন পরীক্ষার প্রস্তুতি কেন্দ্র (টেস্ট প্রিপারেশন সেন্টার) বুঝায়। যে স্কুল যত পরীক্ষা নেয় সেটা তত ভালো স্কুল। আবার অনেক অভিভাবক মনে করেন স্কুলে না গেলেও সমস্যা নাই, কিন্তু কোচিং মিস দেওয়া যাবেনা। এর অবশ্য অন্য ন্যারেটিভও আছে।
আমাদের পাবলিক পরীক্ষা গ্রহণের গুরুদায়িত্ব পালন করে যে শিক্ষাবোর্ডগুলো, মূল্যায়ন সম্পর্কে তাদের বোঝাপড়া এবং দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন করার অবকাশ আছে।তাদের সম্পর্কে জানতে হলে সেখানকার দেয়াল এবং পাবলিক টয়লেটের লেখাগুলো পড়ে আসবেন। হতাশা, আহাজারি আর অভিসম্পাতের জাজ্বল্যমান দলিল ওগুলো। আর প্রশ্নফাঁস এবং এ প্লাস বিক্রির গল্প তো এখন পানসে হয়ে গেছে। এ তো গেল, সামেটিভ এসেসমেন্টের গল্প।
ফরম্যাটিভ এসেসমেন্টের যে ধরণ আমরা চালু করেছি তাতে মূলত শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং হাতেগোনা কিছু শিক্ষককে প্রকারান্তরে জিম্মি করা হয়েছে। ফরমেটিভ এসেসমেন্ট কিংবা গাঠনিক মূল্যায়নের চমৎকার ব্যবস্থা আমরা দেখতে পাই মাধ্যমিক কিংবা উচ্চ মাধ্যমিকের যেসকল বিষয়ে ব্যবহারিক অংশ যুক্ত আছে সেগুলোতে। ধরা যাক “রসায়ন বিজ্ঞান” বিষয়ের কথা। এই বিষয়ের ব্যবহারিক পরীক্ষা হবে ২৫ নম্বরে। পরীক্ষার্থীদের প্রশ্নে উল্লেখিত যেকোনো একটি পরীক্ষণ সম্পন্ন করতে হবে। শিক্ষকদের উপস্থিতিতে লটারির মাধ্যমে পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষণ বণ্টন করা হবে। একজন পরীক্ষার্থী সর্বোচ্চ দুইবার লটারির সুযোগ পাবেন। এতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও রাসায়নিক দ্রব্যাদির নাম ও তত্ত্বে ৩ নম্বর থাকবে। যন্ত্রপাতি সাজানো, যথাযথ ব্যবহার ও কার্যপ্রণালীর জন্য ৪ নম্বর, ধর্ম পরীক্ষা ও ফল লিখনে ৬ নম্বর এবং পরীক্ষার পরিচ্ছন্নতা ও সতর্কতায় ২ নম্বর থাকবে। ব্যবহারিক নোট বুকে কাজের পরিমাপ ও পরিচ্ছন্নতা এবং শিক্ষকের নিয়মিত স্বাক্ষরের ওপর ভিত্তিতে নম্বর দেওয়া হবে। নোটবুকে নম্বর হবে ৫। আর মৌখিক পরীক্ষা হবে ৫ নম্বরে। মৌখিক পরীক্ষার পরীক্ষকরা পরীক্ষণের ওপর জ্ঞান যাচাইয়ে প্রাধান্য দেবেন। তবে, পাঠ্যসূচির অন্তর্গত যেকোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা যাবে।
ব্যবহারিক পরীক্ষার এই নম্বর বন্টন দেখে মনে হবে খুবই কার্যকরী শিখন শেখানো পদ্ধতি অনুসরণ করে শিক্ষার্থীদের তাত্ত্বিক জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি হাতেকলমে ব্যবহারিক দক্ষতা শেখানো হবে। তাত্ত্বিক বিষয়গুলো শ্রেণীকক্ষে পাঠদানের পাশাপশি পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো গবেষণাগারে শিক্ষার্থীরা হাতেকলমে অনুশীলন করবে, শিক্ষক সহায়তাকারীর কিংবা প্রদর্শনকারীর ভূমিকায় থাকবেন। এই পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যে ধাপ অনুসরণ করা হবে তা ব্যবহারিক খাতায় লিপিবদ্ধ করা হবে। চূড়ান্ত ব্যবহারিক পরীক্ষার দিনে শিক্ষার্থীকে দৈবচয়নের ভিত্তিতে যেকোন একটি পরীক্ষা করে দেখাতে হবে, কীভাবে কাজটি করল তা খাতায় লিখতে হবে, একজন বহিঃপরীক্ষকের সামনে মৌখিক পরীক্ষায় উপস্থিত হতে হবে। এই হচ্ছে ব্যবহারিক পরীক্ষা। কত চমৎকার একটা ব্যবস্থা, তাই না?কিন্তু একথা সবাই জানে বাস্তবে কীভাবে এটার অবমূল্যায়ন হয়। বাস্তবে এই ব্যবহারিক পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো বেশিরভাগ স্কুলেই করা হয় না। চূড়ান্ত ব্যবহারিক পরীক্ষার আগে গুটিকয় পরীক্ষা শিক্ষার্থীদেরকে শিখিয়ে পড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হয়। ইতোমধ্যে বাজার থেকে কেনা কিংবা অন্য কাওকে দিয়ে লিখিয়ে-আঁকিয়ে নেয়া ব্যবহারিক খাতাটি স্কুলে জমা দেয় শিক্ষার্থী। চূড়ান্ত পরীক্ষায় গবেষণাগারের পিয়নকে অল্প কিছু উৎকোচের বিনিময়ে দৈবচয়নের ভিত্তিতে প্রাপ্ত টেস্টের নাম জেনে নিয়ে ব্যবহারিকের গাইডবই খুলে পরীক্ষার খাতায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই বিবরণটুকু কাল্পনিক ফলাফলসহ লিখে ফেলা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষকগণ বহিঃপরীক্ষকের আপ্যায়নের নামে পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে পিয়নের মাধ্যমে একটা নির্দিষ্ট অংকের চাঁদা গ্রহণ করেন। স্কুলে যদি কোন শিক্ষার্থীর উপর এই বিষয় শিক্ষক কোন কারণে রুষ্ট না হন এবং কোন শিক্ষার্থী যদি চাঁদা দিতে ব্যর্থ না হয়, তাহলে ব্যবহারিক পরীক্ষায় ২৫ নম্বরের মধ্যে ২৫ পেতে আর কোন বাধা থাকে না। মূল্যায়নে ব্যবহারিক অংশের যে অপব্যবহার দেখা যায় তা আমাদের মূল্যায়ন ব্যবস্থার অন্ধকার দিকটি সামনে নিয়ে আসে। তাহলে সমস্যাটি কোথায়? পদ্ধতিতে নাকি প্রয়োগে? সমস্যার কারণ অনুসন্ধান করে সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে।তা না করে যদি এটাকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে গাঠনিক মূল্যায়নের গুণগান করতে থাকি এবং শিখন-শেখানো পদ্ধতিতে পরিবর্তন না এনে গাঠনিক মূল্যায়নের পরিসর বাড়াতে থাকি তাহলে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক, শিক্ষক এবং স্কুলের কাছে জিম্মি হয়ে পড়বে। আরও বড় বিপর্যয় আসবে।
শিক্ষায় আপনি যেই পরিবর্তনই আনেন না কেন যদি এটা শিক্ষকের কাজকে সহজ করে তবে তারা তা ব্যবহার করবেন। আর যদি কোনভাবে শিক্ষকের কাজকে আরও জটিল, সময়সাপেক্ষ, ব্যয়বহুল এবং শ্রমসাধ্য করে তোলে, তবে শিক্ষক এটাকে বাইপাস করার একটা না একটা উপায় বের করবেই করবে। তাই, শিক্ষা বিষয়ক যেকোনো পরিবর্তনের জন্য এটা একটা লিটমাস টেস্ট যে, নতুন এই পরিবর্তন শিক্ষকের কাজকে সহজ করবে কি না।
লেখক:জি এম রাকিবুল ইসলাম, সহকারী অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত), শিক্ষা প্রশাসন বিভাগ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।