আর দশটা পাঁচটা শারীরিক উপসর্গের মত পিরিয়ড বা মাসিক ও একটি মেয়ের জীবনের একটি অতি স্বাভাবিক ঘটনা। একটি মেয়ের নিয়মিত ও সুস্থ-স্বাভাবিক মাসিক নিশ্চিত করে তার নিরাপদ মাতৃত্ব। তবুও বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের বিভিন্ন জায়গাতেই এই পিরিয়ড জিনিসটাকে খুব বাজে ভাবে ট্যাবু করে রাখা হয়। নিরাপদ মাসিক যে একটি মেয়ের অধিকার এটা মনে হয় অনেকে এখনো ভাবতেই পারেন না। বর্তমানে শহরাঞ্চল এবং মোটামোটি শিক্ষিত যারা আছেন অনেকেই বিষয়গুলো কিছুটা সচেতন হচ্ছেন। তবে গ্রামাঞ্চল এবং কিছুটা দুর্গম অঞ্চলে গেলে এখনো সেই করুণ চিত্রই দেখা যায়। মহিলাদের মাসিক নিয়ে যথাযথ ধারণা নেই, তারা অস্যাস্থকর কাপড় বা ন্যাকড়া ব্যাবহার করে থাকেন, আবার এগুলো তারা ঠিকমত রোদেও শুকান না। আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় নারী শ্রমিকেরা পিরিয়ডের প্রথম দিনগুলোতেও প্রচণ্ড পেট ব্যাথা এবং স্বাস্থ্যঝুকি নিয়ে কাজ করে যান। গার্মেন্টসগুলোতে বর্তমানে ভালো টয়লেটের ব্যাবস্থা দেখা গেলেও অন্যান্য কলকারখানা এবং বিভিন্ন পাবলিক সেক্টরগুলোতে স্বাস্থ্যকর মহিলা টয়লেটের দেখা মেলা ভার। আর টয়লেটের দেখা মিললেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেগুলোর অবস্থা হয় খুবি অস্বাস্থ্যকর এবং তাতে থাকে না কোন প্যাড ডিসপোসালের ব্যাবস্থা।
এইতো গেল সার্বিক পিরিয়ড বা মাসিক নিয়ে আলাপচারিতা। এবার আসুন কথা বলা যাক করোনাকালীন আমাদের মাসিক তথা প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে। বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশ বর্তমানে যেখানে খ্যাদ্যেরই তীব্র সংকট সেখানে এই বিষয়টিকে যে বিলাসিতা হিসেবে মনে করা হবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের প্রজনন স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে চাইলে এই বিষয়টিকে আমাদের কখনোই এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়। নিত্য প্রয়োজনীয় পন্যের পাশাপাশি নিরাপদ মাসিকের জন্য প্রতিমাসে একজন নারীর জন্য পর্যাপ্ত পরিমান প্যাড, ট্যাম্পুন বা কাপ এগুলোও খুবই প্রয়োজনীয়। ইন্ডিয়ার ডাইজেস্টার ম্যানেজমেন্ট ২০০৫ এক্টে বলা আছে মহামারীর সময় নিত্য প্রয়োজনীয় পন্য সহজলভ্য রাখতে হবে এবং এগুলোর সঠিক মূল্য নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়াও ইউনিসেফের গাইডলাইনেও প্যাডকে নিত্য প্রয়োজনীয় পন্যের তালিকাভুক্ত করে এর সহজলভ্যতা এবং সাপ্লাই নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এ নিয়ে এখন পর্যন্ত কোন ঘোষণা বা উদ্যোগ দেখা যায়নি।
প্রত্যন্ত অঞ্চল বা নিম্নআয়ের মহিলাদের স্বল্পমূল্যে প্যাড সরবরাহ করার জন্য কিছু সেচ্ছাসেবি সংগঠন এবং এনজিও কাজ করে থাকে, তারা নিজেরা প্যাড তৈরি করে স্বল্পমূল্যে সেগুলো সর্বরাহ করে থাকে। কিন্তু লকডাউন এবং কাঁচামাল স্বল্পতার কারণে এটাও এখন আর সম্ভব হচ্ছে না। কাজেই নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো যাদের এখন নিজেদের ভাতের ব্যাবস্থা করার সামর্থ্য নেই সেখানে প্যাড যোগার করতেও যে তাদের ঝামেলা পোহাতে হবে এটা আন্দাজ করা কঠিন কিছু নয়। তার উপর পিরিয়ড জিনিসটি যেভাবে আমাদের দেশে ট্যাবুটাইজড করা ভাত-ডাল চাইতে পারলেও কেউ যে প্যাড মুখ ফুটে চাইবেন না এটাও সহজেই বোঝা যায়। তাই সকল স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং যারা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদিগুলো পৌছে দিয়ে পরিবারগুলোকে সাহায্য করছেন তাদের অনুরোধ করবো সাহায্য পৌছে দেওয়ার সময় এই বিষয়টিও পরেরবার মাথায় রাখবেন। কারণ কেউ মুখফুটে না বললেও খাদ্য বস্ত্রের মত একটি নিরাপদ মাসিক ও একটি মেয়ের মৌলিক অধিকার।
এবার চলে আসা যাক আরো গুরুত্বপূর্ণ একটি আলাপে। পরিসংখ্যানের তথ্য বলছে বাংলাদেশে নারী ডাক্তারের সংখ্যা হচ্ছে ৫৩% এবং নারী নার্সের সংখ্যা হচ্ছে ৯৩%। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে হাসপাতাল গুলোতে কিন্তু নারীদেরই আধিপাত্য। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে নারী আধিপাত্য থাকা সত্ত্বেও নারী স্বাস্থ্যকর্মীদের মাসিক ব্যাবস্তাপনার ক্ষেত্রে হাসপাতালগুলোর কোন সহযোগিতা দেখা যায় না। ওয়ার্ডগুলোতে কোন প্যাডের ব্যাবস্থা রাখা হয় না যেখানে কর্মীদের ৯০%ই নারী এবং তাদের প্রত্যেকেরই কিন্তু মাসে একবার মাসিক হচ্ছে। আর এই করোনার সময় যখন ডাক্তার নার্স সকলকে রোস্টার ডিউটি করতে হচ্ছে এই সময়তো চ্যালেঞ্জটা আরো কঠিন। কারণ প্রত্যেককে পিপিই পরে স্বাস্থ্যসেবা দিতে হচ্ছে এবং পিরিয়ডের সময় এই কাজটি খুবই কঠিন। যেটা চীনের ডাক্তার এবং নার্সদের অবস্থ্যা দেখলেই বোঝা যায়। হাসপাতালের ম্যানেজমেণ্ট স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করলেও তারা তাদের নারী স্বাস্থ্যকর্মীদের কথা একদমই ভাবেননি। তারা হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত প্যাডের ব্যাবস্থা রাখেননি। এ কারণে নারী স্বাস্থ্যকর্মীদের তাদের পিরিয়ড বন্ধ্য রাখার জন্য দিনের পর দিন পিল খেয়ে কাজ করতে হয়েছে। যা তাদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এছাড়াও পিরিয়ডের প্রথম দিকে অনেকের প্রচন্ড ব্যাথা হয় এবং এ সময় নারীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও কম থাকে। তাই কাজ ভাগ করার সময় হাসপাতালের অথোরিটির এই বিষয়গুলো মাথায় রাখা অবশ্যই জরুরি। তাদের মাথায় রাখা উচিত তারা যদি তাদের কর্মীদের সকল বিষয়গুলো মাথায় রেখে তাদের কাজ ম্যানেজমেন্ট করতে পারেন এটি তাদের কাজের পরিবেশের গুনগতমান বাড়াবে বৈকি কমাবে না।
শেষ করার আগে চীনের আরেকটি উদাহরণ টেনেই শেষ করতে চাই। চীনের হাসপাতালের বেশ কিছু ছবি ভাইরাল হয় যেখানে দেখা যাচ্ছিল কিছু গর্ভবতী ডাক্তাররা কাজ করছেন এবং অনেক ডাক্তাররা কাজ করতে করতে নিচে বসে কান্না করছেন। এরপর এক সাংবাদিক রিপোর্টে দেখা যায় যেখানে এক মহিলা ডাক্তার কথা বলতে বলতে চিৎকার করে ওঠেন- “আমি পিরিয়ডের পেট ব্যাথায় মারা যাচ্ছি আমি আর কাজ করতে পারছি না”। এই ছবি আর ভিডিওগুলো আমরা অনেকেই শেয়ার করেছি, সকলেই তাদের হিরো তকমা দিয়ে আমাদের দায়িত্ব শেষ করে ফেলেছি। কিন্তু একবার ভাবুন আমাদের অনেকের পরিবারেই ডাক্তার রয়েছে এবং কোন ডাক্তারই কিন্তু নিজের জীবনের ঝুকি নিয়ে অন্যকে সেবা দেবার জন্য আইনত বাধ্য নন তবুও তারা কাজ করে যাচ্ছেন। তাই হাসপাতাল গুলোতে ডাক্তারদের কাজের পরিবেশ নিরাপদ করার জন্য জোর দেওয়া আমাদের প্রত্যেকেরই নৈতিক দায়িত্ব। আর না হলে যেখানে ডাক্তাররাই নিরাপদ নয় সেখানে রোগীরাও নিরাপদ থাকবে না এটা হওয়াটাই কিন্তু স্বাভাবিক।
তথ্যসূত্র:-
1. Prothom Alo
3. BBC
5. IRC WASH