০.০৬ মাইক্রন মাপের এক ভাইরাস গ্রাস করে নিয়েছে জনপদের পর জনপদ। বিলীন হয়েছে মানব কোলাহল। শহরমুখী মানুষ ছুটেছে গৃহপানে। এতো শিক্ষা,দীক্ষা, উন্নয়ন, অবকাঠামো কিছুই আটকাতে পারেনি এই অভুতপূর্ব দূর্যোগ। অথচ মাসছয়েক আগেও কেউ ভাবেনি এদিন আসবে। নিউইয়র্ক থেকে নীলফামারি কেউই বাদ পরেনি এ দূর্যোগ থেকে।
বর্তমান তরুণ প্রজন্ম তুলনামূলকভাবে একটি স্থিতিশীল সময়ের সন্তান হিসাবে কাটিয়েছে, অন্তত আমাদের এখনও পর্যন্ত জীবন। আমরা মন্বন্তর দেখিনি, স্বাধীনতা যুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ বা উদ্বাস্তু মানুষদের হাহাকারও দেখার সুযোগ হয়নি। কিন্তু এই করোনাভাইরাস আমাদের ভয়ানক অদ্ভুত বাস্তবতার সম্মুখীন করেছে । যে আমরা চিরকাল শিখে এসেছি, প্রকৃত মানুষ হতে হলে অন্য মানুষের কাছে যেতে হয়, তাঁর পাশে দাঁড়াতে হয়, আজ সেই ধারণাই আমূল বদলে গিয়েছে। মানুষের থেকে দূরে থাকাই আজ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর শ্রেষ্ঠ উপায়। এত দিন মুখের উপরে মুখোশকে আমরা জেনে এসেছি নেতিবাচক অর্থে, আর আজ সেই মুখোশই সব থেকে ইতিবাচক দিক আমাদের জীবনে।
তাই সময় হয়েছে মানবজাতির নিজ দর্পণে আবিষ্কার করা। যেখানে উন্নয়নের নামে পৃথিবীর মৃত্তিকা, জল, বায়ু, অরণ্য কিছুই বাদ পড়েনি আমাদের রোষানল থেকে। ঘায়েল পরিবেশ আর আহত প্রতিবেশ নিয়ে পৃথিবী টিকেছিলো কোনমতে। আর প্রকৃতির সবচেয়ে বুদ্ধিমান সন্তানরাই তার বিনাশ করেছে প্রতিনিয়ত। প্ল্যাস্টিক আর তেলে বিষিয়েছি জল, কারখানার ধোঁয়ায় পুড়িয়েছি বায়ু। চিত্তানন্দে আর চামড়ার লোভে পর্যুদস্ত হয়েছে প্রাণীকুল। উজাড় করেছি বন কিন্তু প্রাণীরা হারিয়েছে নিজ বাসভূম। গাছেরা নেই, নিশ্চুপ হয়ে গেছে পাখীরা। নদীদের পথ বদলে গড়েছি সুরম্য নগরী। থেমে গেছে সহস্র প্রজাতির মাছেদের বংশগতি। বাঁধের নামে গুড়িয়ে দিয়েছি শতবর্ষী পাহাড়। ভাসিয়ে দিয়েছি বিস্তীর্ণ অঞ্চল। পর্যটনের লোভে ভীড় বেড়েছে, প্ল্যাস্টিক আর অপচনশীল দ্রব্যে আহত করেছি সমুদ্রকে। পৃথিবীর সবকিছু যেন বিকিয়েছে স্বার্থপরতার কাছে।
পৃথিবীর হাতে হয়ত দৃশ্যমান কোন ‘Reset’ বাটন নেই। কিন্তু তবুও, প্রকৃতির প্রতিশোধ বলে একটা বিষয় তো আছেই। হয়ত প্রকৃতি মাতাও তার অন্যান্য সন্তানদের বাঁচাতে মরিয়া হয়ে একটা ধাক্কা দিলো সবচেয়ে সক্ষম সন্তানকে। সেকারনেই ‘লকডাউনে’ পুরো মানবজাতি ঘরবন্দী। অন্যদিকে চীনভূমে কার্বনডাই অক্সাইড বছরের শুরুতেই ২৫% কমে গিয়েছিলো। হয়ত পুরো বিশ্বেই এ অবস্থা বিরাজ করছে। তারই জের ধরে ভারতবাসী ৩০ বছর বাদে হিমালয় অবলোকন করছেন। পাঞ্জাবের জালান্দার থেকে এ পর্বত কম করে হলেও ২০০ কিলো দূর। এ উদাহরণের তালিকা দিতে গেলে অনেক লম্বা হয়ে যাবে। তবে বলে রাখা ভালো ২৪০ বছর পর ইংল্যান্ডের আকাশে দেখা দিয়েছে হোয়াইট টেইলড ঈগল বা সি-ঈগল।
ভাইরাসে বিপর্যস্ত ইতালিতে মানুষ যখন ঘরবন্দী। দূষণের মাত্রার পারদ অবধারিতভাবেই নেমে গেছে। তাই ভেনিসের খালগুলো দখল করে নিয়েছে রাজহাঁস, মাছ ডলফিন । উড়িষ্যার গহিরমাথা আর ঋষিকুল্যা সৈকতজুড়ে এবার প্রায় আট লাখ কচ্ছপের প্রায় ছয় কোটি অলিভ রিডলের ডিম। জাপানের নারা শহরের রাস্তায় নেমে এসেছে বিরল শিখা হরিণ। পানামার সান পেলিপে শহরের সমুদ্রসৈকতের তীরেও এসেছে মাংসাশী রেকুনের দল। ক্যালিফোর্নিয়ার ওকল্যান্ডের একটি স্কুলের মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছে টার্কি মুরগির ঝাঁক। কেরালার রাস্তায় দেখা মিলছে ৩০ বছর আগে শেষদেখা বিরল মালাবার লার্জ স্পটেড সিভেট(গন্ধগোকুল)। দেরাদুনে খেলার মাঠে ঘুরে বেড়ায় একপাল বড়হরিণ। দিল্লি পার্শ্ববর্তী নয়ডার রাস্তায় দেখামেলে বিরল নীলগাইয়ের (এন্টিলোপ)।
মানুষও এই প্রকৃতিরই অংশ। মানুষের যেসব কার্যক্রম প্রকৃতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, সেগুলো মানবসভ্যতাকেও ছেড়ে কথা বলে না। অদৃশ্য বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্যই টিকিয়ে রাখছে আমাদের অস্তিত্ব। এই করোনা বিপর্যয় আমাদের অস্তিত্বকে নতুন করে ভাবার ও বোঝার সুযোগ করে দিয়েছে।
‘সময়’ আজ আমাদের শিক্ষক। শিখে নিতে হবে আমাদের। এমন এক অনন্য অর্থনৈতিক কাঠামো পৃথিবীময় গড়ে তুলতে হবে যেখানে বেঁচে থাকবে প্রাণ আর নিরাপদ রবে প্রকৃতি। তবেই শেষ হবে শোধবোধ খেলা।
আসিফ আদনান, মুক্তিফোরামের একজন সংগঠক