এ বছরের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় ঐতিহ্য থেকে প্রকাশিত হয় রুম্মানা জান্নাতের কবিতার বই ‘মেমোরিজ অব ৩৩ জুলাই।’
২০২৪ এর জুলাই অভ্যুত্থানের নানান ঘটনাকে উপজীব্য করে গদ্য কবিতাগুলো লিখেছেন তিনি। কবিতাগুলোয় শিরোনাম না দিয়ে ব্যবহার করেছেন সাবহেডলাইন। সেখানে কখনো স্লোগান, কখনো কারো কোটেশন ব্যবহৃত হয়েছে। আর কবিতাগুলোয় আছে চিত্রকল্পের অসাধারণ নির্মাণ।
যেমন – ‘আমার যে ছেলেডা মরছে, আমি কি ওরে পামু কোনোদিন কন, কোনোদিন পামু?’- এই উদ্ধৃতিটি ব্যবহার করে প্রথম কবিতাটি লিখেছেন রুম্মানা। এখানে এনেছেন স্বজন হারানোর বেদনাময় স্মৃতিচারণ। একটা লাইন এমন- ‘কোমল তালুর ভিতর একটা পতাকা ধরে বেহেশতি খুশবু হয়ে গেছে আমার বোন!’
এখানে এই বোনের অস্তিত্ব বিলীয়মান নয়, বরং মিলে যাচ্ছে অসীমের সঙ্গে। কিংবা দ্বিতীয় কবিতাটিতে তার লেখা লাইন- ‘তার আনন্দের রঙ বেখবরই থাকে কিন্তু আমি জানি ঘুমের সাবধানতা।’ এই লাইনগুলো চুলচেরা বিশ্লেষণের নয়, বরং অনুভবের।
এমন সূক্ষ্ম সংবেদনশীল অনুভব রুম্মানা তৈরি করেছেন বইয়ের প্রতিটি কবিতায়। ‘যেকোনো হৃদয়ছেড়া ঘটনার পর আমাদের মন ভাবতে থাকে কত সম্ভাবনা ছিল বাতাসে।’ – লাইনটি পড়লে আমরা একে অনুভব করতে পারি বহুমাত্রিকভাবে। গুলিতে আহত ফুসফুস যেমন হাহাকার করে একটু বাতাসের জন্য, শেষবার শ্বাস নিতে চায় বুক ভরে। কবি এখানে ভাইরাল হওয়া স্লোগান ধরনের কাপলেটও ব্যবহার করেছেন। যেমন- ‘এক হয়েছে সারাদেশ খুনি চোদার টাইম শেষ’।
‘যে কীট খোদা হইতে চায়, সে কেমনে জানবে মরে যাব জেনেও একটা দীর্ঘ রাত আমরা কীভাবে হাসিমুখে কাটাই!’- এই লাইনগুলো আমাদের সামনে মেলে ধরে মানুষের মুক্ত হতে চাওয়ার চিরায়ত আকাঙ্খাকে। তবে জুলাইয়ের আন্দোলনের সময়টাকে ধরে রাখা এই বইয়ের মূল উপজীব্য হলেও এর সঙ্গে কবি মিলিয়েছেন সমসাময়িক পৃথিবীর অন্যান্য মুক্তি সংগ্রামকেও। ‘তোমার নারীরা জন্ম দিয়েছে আপেলের বনে শিশিরের হিরা’ কবিতাটিতে এই বিষয়টি ফুটে উঠেছে।পুরো বইটিতে এমন টুকরো টুকরো অনুভব ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। যেমন- ‘কেন কেউ বুঝতেছে না হাত ধরে হাঁটা কত জরুরি!’ অথবা ‘কারণ আমরা জানি, হাত ধরে হাঁটা শুরু করলেই জালিমের পতন, আজাদির হাওয়া।’
কবিতাগুলোয় আছে সুসময়ের প্রত্যাশা ও সেখানে উপনীত হবার জন্য প্রয়োজনীয় ধৈর্য ধারণের কথাও। ‘ঝোল ঝোল মাংসের ভাত এখনি ভাবতে চাই না আমি। জুলুমের কত নিশানা বয়ে যাইতেছে আজও। ফুলতোলা বিকালের কথা ভাবতে ভাল্লাগে না তাই।’ – লাইনগুলো জুলাইকে অতিক্রম করে কতটা প্রাসঙ্গিক হয়ে আছে জুলাই পরবর্তী বাংলাদেশের জন্যও- তা পাঠকমাত্রই অনুভব করতে পারবেন।
‘সারা সকাল ভাসায়া নেয়ার মতো বিষ্টি হইলো। কই, আমাদের রক্তের দাগ তো এতটুকও মুছলো না।’- এই শ্রাবণে এই লাইনগুলো পড়তে পড়তে পাঠক মুখোমুখি হবেন এক অমোঘ সত্যের। যার যায়, সে-ই জানে। তাই জুলুমের দিন পেরিয়ে সুসময় এলেও কিছু কিছু ক্ষত কখনো মুছে যায় না।
‘আমার ভাই মরল কেন খুনি হাসিনার বিচার চাই’- কবিতাটায় যেমন আছে- ‘মর্গ থেকে মর্গ, শুয়োরের থানা আর গোরস্থানে দাঁড়ায়া আমরা ভুলে গেছি নিজের শরীর।’ একটি আসন্ন বিপ্লবের জন্য এভাবেই আমরা নিজেদের ছাপিয়ে অপরের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ি। সেই দাগগুলো আমাদের মন থেকে পুরোপুরি মুছে যায় না। তাই কবি লেখেন- ‘ আমরা কেউ কেউ এখনও মাথা নিচু করে হাঁটি, নখ কামড়াই আর চুলগুলো গত শতাব্দীর দিকে ভাসমান।’
বইয়ের কবিতাগুলোয় বেশ কয়েকবারই এসেছে বেওয়ারিশ লাশের প্রসঙ্গ। এছাড়া, গভীর চিত্রকল্প ও উপমা এক্ষেত্রে অনন্য এক ব্যঞ্জনা তৈরি করেছে। যেমন- ‘যখন আমাদের জীবনে চাঁদই ছিল পথ চিনে চিনে ফেরার আলো, তখন অমাবস্যায় সবাই আগে আগে ফিরে আসতো বাড়ি।’ এরপর এক জায়গায় কবি লিখছেন- ‘আমরা পুরাটা রাস্তায় দেখি চাপ চাপ রক্ত, আর বাড়ির দিকে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা একটা সফল অমাবস্যা।’
একটু গভীরভাবে ভাবলে বোঝা যায়, একটা মানুষ যখন চলে যায় তখন অনেকের জীবনের সব স্বপ্ন শেষ করে, জীবনটাকে আঁধারে ডুবিয়ে চলে যায়। তাই হয়ত কবি সাবহেডলাইন দিয়েছেন- ‘দিস ইজ মাই ফারহান ফাইয়াজ, হি ইজ ডেড নাউ! আই ওয়ান্ট জাস্টিস!’
এই বেদনা আরো বহু লাইনেই প্রকাশিত। যেমন- ‘আমার যে ভাই জন্মের সময় কান্দে নাই আমি তার লাশের সামনে দাঁড়ায়া থাকছি সারারাত।’ প্রিয়জনের এই চলে যাওয়াগুলো এই মানুষগুলোকে আর আগের জীবনে ফিরে যেতে দেয়না৷ দুঃখগুলো স্থায়ী হয়ে থেকে যায় মনে।
একটি কবিতার শুরুতে যেমন আছে-‘আমার ছেলের এখনো ঘেরান আয়ে। এই দেখেন এখনো ঘেরান আসতেছে। আমি জামাটা ধুই নাই।’ – মাতৃত্বের এই তীব্র আবেগ কি কোনো সংবেদনশীল হৃদয়কে স্থির থাকতে দেয়?
‘কবর কি পুরানা হয় কোনোদিন যেখানে লাল জবা ফুটতেছে সারাক্ষণ’- এই লাইনটিতে রক্তমাখা লাশ আর লাল জবার অভেদ কল্পনা আমাদের মস্তিষ্কে এক তীব্র দ্যোতনা তৈরি করে। বন্ধুর স্মৃতি রোমন্থনের কথা এসেছে এভাবে- ‘কাবাবের স্বাদ নয়, প্রাচীন পাথরের ঘ্রাণ নয়, আমি খালি ওই হারানো জুতার লোভে ওই রাস্তায় হাঁটি।’
বইটিতে এসেছে জন্মদাত্রী মা-কে ছেড়ে দেশমাতকাকে মুক্ত করার কথাও। ‘আমার যুদ্ধ তী এটুকুই যেন আমার পেয়ারা গাছটা হইতে পারে বয়সী কাঠের শরীর- কী দ্বিধাহীন প্রত্যয়!
এই প্রত্যয় যেমন আছে, আবার তেমনি অপরাধবোধও আছে। ‘আমি বুঝাইতে পারি না কাউরে যেন অনেকগুলো উপড়ানো চোখ ছলছল করতেছে আমার বেবুঝ জীবনের উপর।’ – এই ট্রমা নিয়েও জুলাইয়ের পরে অনেকে বেঁচে আছেন।
বইয়ে ফিলিস্তিন নিয়ে কয়েকটি কবিতা এসেছে মাঝেমাঝে। জুলাইয়ের লালকে কবি মিশিয়ে দিয়েছেন সেসব কবিতাতেও। যেমন- ‘লাব্বাইক লাব্বাইক ইয়া আকসা লাব্বাইক’ কবিতাটিতে আমরা পাই- ‘সেখানে ঋতুর নাম মুখস্থ করা শিশুগুলো শুধু চিনতেছে লাল!’
আবার ‘আওয়াজ উডা’ কিংবা ‘কথা ক’ এর মতো র্যাপ গানের রেফারেন্সও এসেছে বইটির কবিতায়। গান কীভাবে মুক্তিকে তরান্বিত করে, তা নিয়েও লেখা হয়েছে কবিতা।
তবে জুলাইয়ের বাইরেও অন্যান্য ইস্যু কিছু কিছু কবিতায় উঠে এসেছে। ‘কাঁটাতারের বেবাক ঘাস হইয়া উঠুক স্বর্ণা দাশ’ স্লোগানটি ব্যবহৃত হয়েছে একটি কবিতার সাবহেডলাইনে। সেখানে আছে এমন লাইন- ‘আমরা জালিমের চোখের ভিতর ফুইটা থাকবো হলুদ প্রান্তর হয়ে।’
এর বিপরীতে অসহায়ত্বের কথাও দৃশ্যমান। যেমন- ‘আমার আত্মা এক যুদ্ধপ্রস্তাবের কাছে ছোট হয়ে যাইতেছে ক্রমশ’
তবে শেষ পর্যন্ত কবিতায় উঠে এসেছে মুক্তির ঘ্রাণ ও জীবনের জয়গান। ‘পেছনে পুলিশ, সামনে স্বাধীনতা’ সাব হেডলাইনের কবিতাটা বইয়ের শেষ কবিতা। ‘আসমান একই ছিল, নদীগুলা ভরাট, ভারী ছিলো সবচেয়ে আমাদের মন’- লাইনটা আমাদের মুক্তির দিকে ভারী মন নিয়ে ক্রমাগত এগিয়ে যাওয়াকে নির্দেশ করে। তবে কবি তখনো ভোলেন না শহিদদের। তাই শেষ করেন এমন লিখে- গুলি আর চিৎকার নাই আজ, স্বাভাবিক সকাল আর রাত; তাও যেকোন আলাপে, শান্তি আর সুরের থেকেও ভাইসা আসে, ‘আমার যে ছেলেডা মরছে, আমি কি ওরে পামু কোনোদিন কন, কোনোদিন পামু?’
আর এর মধ্য দিয়েই মেমোরিজ অব ৩৩ হয়ে উঠেছে চিরায়ত আবেদন রাখতে সক্ষম এক বই। জুলাইকে একদম আমাদের আশপাশ থেকে অনুভবের বিশ্বস্ত এক স্মারক।
মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন।
