“অনেকদিন গল্প লেখা হচ্ছে না”
বেশ কিছুদিন ধরে শুভ্রকে এই চিন্তা কুরে কুরে খাচ্ছে।
সারাদিন অফিসে ভুংভাং লিখতে লিখতে আর সৃজনশীল কিছু করা হচ্ছে না। পত্রিকার চাকরিটা সে নিয়েছিলো যাতে নিজের লেখালেখি কিছুটা আগায়। এখন সারাদিন মার্ডার আর রেইপের কাহিনী সম্পাদনা করা লাগে।
বিট চেঞ্জ করতে হবে। সাহিত্য বা রাজনীতি, এসব কিছুতে ঢুকতে হবে। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে শুভ্র অফিসে ঢুকলো। বসের অফিসে গিয়ে দেখলো বস তখনও আসেননি। তিনি আসেন লাঞ্চের পরে। তখনই তাকে ধরতে হবে। আপাতত সেলিম ভাইয়ের সাথে একটা সিগারেট খাওয়া জরুরি। তারপর ব্যাক টু রেইপ এন্ড মার্ডার।
সেলিম ভাই সিনিয়র জার্নালিস্ট। এই পত্রিকায় বিশ বছর ধরে আছেন। পত্রিকা ইন্ডাস্ট্রির আগাগোড়া সব জানেন। তার সাথে শুভ্রর বেশ জমে।
সিগারেট শুভ্র কেনেনা। প্যাকেট কিনে ফেললে বেশি খাওয়া হয়ে যায়। দিনের শুরুতে একটা আর শেষে একটা সে সেলিম ভাইয়ের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে খায়। এতে পয়সাও বাচে, সিগারেট খাওয়াও কম হয়।
সিগারেট খাওয়া হয় সিড়িঘরের জানালার সামনে। তিনতলা অফিস, চারতলার সিড়িঘরে বিড়িখোরদের আড্ডা। ওইখানে এখনও ভাড়া হয়নি। ভাড়া হলে নির্ঘাত বিড়িখোরদের তাড়িয়ে দেয়া হবে। তখন তাদের জায়গা হবে অফিসের পাশের অলিগলিতে।
“নতুন কি লিখছো?” সেলিম ভাই সিগারেট ঠোটে নিয়ে বললেন।
“কিছু না। নতুন কোন গল্পের প্লট নাই। সারাদিন রগরগে এইসব স্টোরি নিয়ে কাজ করি, ঘুমের মধ্যেও এইসবই দেখি। ভাল্লাগেনা আর।”
“আরে মিয়া কাজকে এতো সিরিয়াসলি নিলে হবে? কাজ করবা পেটের জন্য। মনের জন্য লিখবা। বড় গল্প লেখা চাপ। ছোটছোট কবিতা লিখে নিজের আত্মাটাকে বাচিয়ে রাখো।”
“আপনি লেখেন? আপনার আত্মার কি অবস্থা?”
“আমার আর আত্মা। বিবাহিত মানুষের জীবন বোঝো? বাচ্চাকাচ্চার পিছনে দৌড়েই জীবন তামাতামা। কবিতা আমি লিখতাম প্রেম করার সময়। তোমার ভাবিকে পটানোর জন্য দিস্তার পর দিস্তা শেষ করেছি। এখন তোমার যৌবন। তোমার প্রেয়সির জন্যে লেখো। কেনো? কেউ নেই?”
শুভ্র একটু লজ্জা পেয়ে যায়। হুট করে আলাপ এইদিকেই মোড় নিলো? অবশ্য আর কাউকে বলা যাক আর না যাক, সেলিম ভাইকে বলাই যায়। অভিজ্ঞ মানুষ। তার উপদেশ হয়তো কাজে লাগবে।
“আমার জানালা দিয়ে একটুখানি আকাশ দেখা যায় সেলিম ভাই, বুঝলেন কিছু?”
“বুঝেছি, পাশের বাড়ির সেলিনা, তার সাথে খেলিনা–তাই তো?”
“সেলিনা নাকি? নাম জানিনা। ছাদে আসে। দেখতে পাই। কিন্তু আর কিছুই জানিনা।”
“ওমা! তা কেনো? হাতটাত নাড়ো না?”
“সাহস হয় না ভাই। সে বিরাট বড়োলোকের মেয়ে। বাবা রাজনীতি করে। স্বেচ্ছাসেবক পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোসাদ্দেক চৌধুরী। তার মেয়ে। আমার মতন চুনোপুটি তার কাছে পাত্তা পাবে না।”
“আরে তুমি বড়ো বাপের মেয়েদের কাহিনিই জানো না। তারা বড়ো বড়ো লোকেদের সাথে থেকে থেকে তাদের নিয়ে বিরক্ত। বাপ মায়ের কথার বিরুদ্ধে যাবে, পথের একটা ছেলেকে—আই মিন পাশের মেসের একটা ছেলেকে পছন্দ করে ফেলবে, এটাই ওদের কাছে থ্রিল।”
“তাহলে কি করা যায়? চিৎকার করে তো আর কথা বলতে পারি না। বখাটে ছেলেদের মতন পথরোধ করে দাঁড়ালে তো প্যাদানি খাবো।”
“আরে তুমি ভুলে যাচ্ছো তোমার ক্ষমতা। তুমি ক্রিয়েটিভ মানুষ। জার্নালিস্ট। তোমার আছে এই পত্রিকা। ওদের বাসায় কোন পত্রিকা নেয়, জানো?”
“তা জানি। হকারের সাথে আমার ভালো সম্পর্ক। আমাদের পত্রিকাই রাখে। তাই তো চেষ্টা করি আমার নাম চেহারা সহ কোন লেখা ছাপানো যায় কিনা। তা তো আর হয় না। খালি নাম পরিচয় ছাড়া নিউজ বের করি।”
“দেখো, মাথাটা খাটাও। লাভ উইল ফাইন্ড আ ওয়ে।”
সেলিম ভাইয়ের সিগারেট শেষ। শুভ্রর তখনও কয়েকটান বাকি। তবু সে সিগারেটটা নিভিয়ে নিজের ডেস্কের দিকে পা বাড়ালো। যাবার পথে একবার এডিটরের রুমে উঁকি দিলো। কি আশ্চর্য! এডিটর উপস্থিত। হয়তো কোন বিশেষ ঝামেলা লেগেছে। এর মাঝে কি শুভ্রর ঢোকা উচিত হবে? সাতপাঁচ বেশি না ভেবে শুভ্র সিদ্ধান্ত নিলো যে সে কথাটা বলেই ফেলবে আজকে। আর ভালো লাগে না।
“স্যার আসবো?”
“শুভ্র! ইয়াং ম্যান, কেমন আছেন? আসুন বসুন। দিনকাল কেমন যাচ্ছে।”
“জ্বি স্যার, ভালো।”
“কোন বিশেষ দরকারে?”
“না মানে, স্যার, তেমন কোন দরকার না। তবে বলছিলাম যে অনেকদিন তো নিউজরুমে আছি। ভালো অভিজ্ঞতা হচ্ছে স্যার। তবে চাকরিতে ঢোকার সময় যে বলেছিলাম যে সাহিত্য বা রাজনীতি বিট আমার কাজ করার ইচ্ছে, আর আপনিও বলেছিলেন যে বাই রোটেশন ওইসব বিটে কাজ পাবো। পরে তো আর সেটার কিছু হলো না।”
“হ্যাঁ। তা আমি বলেছিলাম ঠিক। কিন্তু আপনি তো জানেন, যে নিউজরুম কি পরিমান বিজি যাচ্ছে আজকাল। এর মাঝে তোমার মত ক্যাপাবল হ্যান্ড আমি কেমন করে ছাড়ি বলেন?”
“স্যার একটূ দেখেন। অন্য যেকোন ডিপার্টমেন্টে যদি ছোটখাটো কিছুও লেখানো যায়।”
“আচ্ছা, নিজের নাম ছাপার অক্ষরে দেখার ইচ্ছে?”
“সেরকম বলতে পারেন স্যার।”
“হুম! সেরকম কিছু তো আমার হাতে নেই। তবে একটা জিনিস আছে। জানিনা আপনার পছন্দ হবে কিনা। আমাদের শনিবারের হরোস্কোপ লিখতো যে শিহাব সাদিক, সে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। আপনি চাইলে তার জায়গায় ঢুকতে পারেন। ছাপার অক্ষরে নাম যাবে।”
হরস্কোপ, মানে রাশিফল? জ্যোতিষবিদ্যা নিয়ে শুভ্রর তেমন কিছুই জানা নেই। খালি জানে দুই হাত একসাথে করলে যদি একটা চাঁদ হয়, তবে সুন্দরি বউ পাওয়া যায়। সেই হিসেবে শুভ্রর ভাগ্য অতি সুপ্রসন্ন। তার হাতে পাকিস্তানের পতাকার মতন চাঁদ ওঠে।
“ঠিক আছে স্যার। আমি রাজি।”
“গুড, ভেরি গুড। আমারও থাকলো, আপনারও থাকলো। এই শনিবার থেকে লেখা শুরু করে দেন। লিখে সুলতানকে পাঠিয়ে দেবেন। আমাকে সিসিতে রাখবেন। ওকে?”
“ওকে স্যার।”
এডিটরের রুম থেকে বেরিয়ে নিজের ডেস্কে, মানে একতলা নিচে এলো শুভ্র। কাজ শুরুর আগে একবার ফেসবুকে ঢুঁ মারলো। ঢুকতেই তার মাথা খারাপ হবার জোগাড়। পিপল ইউ মে নো-তে এটা কে? পাশের বাসার মেয়েটা না? হ্যাঁ! তাই তো! ফেসবুক এলগোরিদম মাথা নষ্ট একটা জিনিস। কেমন করে একটু আগেই তার কথা বললো আর এখন সে হাজির। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দিতে গিয়েও দিলো না শুভ্র। শুধু তার প্রোফাইল লিংকটা কপি করে নিজের মেসেঞ্জারে পাঠিয়ে রাখলো। আর দেখে নিলো তার জন্মতারিখ। ১২ মে, অর্থাৎ বৃষ রাশির জাতিকা। আচ্ছা, দেখা যাক এই তথ্য নিয়ে কি করা যায়। এখন তো রাশিফল শুভ্ররই হাতে। কে জানে এই মেয়ে রাশিফলে বিশ্বাস করে কি না। নাম ইশরাত জিনাত।
পরের শুক্রবার শুভ্র সেই সপ্তাহের রাশিফল লিখতে বসলো। ইন্টারনেটের এদিকে ওদিকে ঘেঁটে অনুবাদ করে সব রাশি লিখে ফেলে, বৃষ রাশির রাশিফলে শুভ্র ঢুকিয়ে দিলো “নতুন প্রেমের সম্ভাবনা। মনের মানুষের নামের অদ্যাক্ষর হবে শ। নীল রঙ শুভ। পছন্দের মানুষকে পেয়ে যেতে পারেন খুব কাছের অপ্রত্যাশিত কোন জায়গায়।”
বাড়ি ফিরেই শুভ্র সরাসরি ছাদে চলে গেলো। গায়ে নীল শার্ট। ছয়টায় মেয়েটা ছাদে আসে। শুভ্র ঠিক সময়ে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। সেই সময়েই রাস্তা দিয়ে একটা মিছিল যাচ্ছিলো। কার যেন চামড়া তারা তুলে নেবে। দিনকাল বেশ টালমাটাল। সরকারবিরোধী আন্দোলন তুমুল আকার ধারণ করছে। এইজন্যেই শুভ্র রাজনীতি বিটটা চেয়েছিলো। অবশ্য যা পেয়েছে তাও কম নয়। কে জানে, ভাগ্য খুলেও যেতে পারে। অন্যের ভাগ্য সে লিখেছে। নিজের রাশিতেও লিখে দিয়েছে, “প্রেমযোগ শুভ।” দেখা যাক নিজের ভাগ্য নিজে ঠিকঠাক লিখেছে কিনা।
ইশরাত ছাদে এলো ছয়টা পনেরোতে। তার হাতে পত্রিকা। হ্যাঁ, শুভ্রর পত্রিকাই। কোন পাতায় আছে তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, তবে মাঝামাঝিই মনে হচ্ছে। সে কি রাশিফল পড়ছে? শুভ্রর নাম কি পড়বে সে?
শুভ্র ধীরে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করলো। ইশরাতের প্রোফাইলে ঢুকলো। একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালো। তারপর একটা মেসেজ।
“এটাই কি আপনি?”
হয়তো ইশরাত নিজের মনেই ফোনটা বের করলো। তবু শুভ্রর মনে হলো তার মেসেজ দেখার জন্যেই সে মোবাইল বের করেছে।
শুভ্রর ধারণা ঠিক। কারণ মুহুর্তেই ইশরাত রিপ্লাই দিলো, “মানে?”
শুভ্র লিখলো, “সামনের ছাদে তাকান।”
ইশরাত আসলেই সামনের ছাদের দিকে তাকালো। তাকিয়েই দেখতে পেলো একটা ছেলে তার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছে।
“ও! এটা আপনি?”
“হ্যাঁ”
“শুভ্র আকাশ আপনার আসল নাম?”
“আসল নামই, তবে নিজের দেয়া। আমি এই নামে লেখালেখি করি”
“আচ্ছা। ভালো। কি লেখেন?”
“এই, গল্প, কবিতা, রূপকথা।”
“রূপকথা! কি রূপকথা?”
“এইযে আপনার রূপের কথা লিখবো, সেইটা হবে একটা রূপকথা।”
“বাহ! ফ্লার্ট তো ভালোই করতে পারেন।”
“এ ঈশ্বরের দান। ফেলনা কিছু নয়।”
“আপনার শার্টটা সুন্দর। নীল রঙ আমার পছন্দ।”
“আমারও পছন্দ।”
“আর কি পছন্দ?”
“আপনাকে।”
“আচ্ছা? কতদিন ধরে প্ল্যান করেছেন এই লাইন?”
“অনেকদিন। তাও ভালো ফেসবুক মিলিয়ে দিয়েছে। নাহলে কোনদিনও লাইন মেরে উঠতে পারতাম না।”
“ফেসবুক মিলায়নাই। ভাগ্য মিলিয়েছে।”
“ভাগ্য আবার কি? ভাগ্য বলে কিছু নাই। যা কিছু হয় মানুষের কর্মের জন্য হয়। ভাগ্য বিফল মানুষের কল্পনা মাত্র।”
“আপনি ভাগ্যে বিশ্বাস করেননা?”
“না।”
“রাশিতে?”
“রাশি, জ্যোতিষবিদ্যা–এইসব ভুজুং ভাজুং। পত্রিকাওয়ালারা বানিয়ে লিখে দেয়। এর কোন মানে নাই।”
“আচ্ছা! আমি তো আরও ভাবলাম আমার রাশিতে ছিলো বলে আপনার সাথে পরিচয় হলো।”
“মানে?”
“মানে আজ পত্রিকায় দেখলাম আমার প্রেম হবে শ দিয়ে শুরু এমন নামের ছেলের সাথে। আমি ভাবছিলাম আপনিই সেই ছেলে।”
“ও তাই! তাহলে আমি রাশিতে বিশ্বাস করি। আলবাত করি। একশো পার্সেন্ট করি।”
ইশরাত হেসে দিলো। তারপর তারা দুইজন চ্যাট করতে লাগলো। সারাদিন, সারারাত। ফোনে কথা বলতে লাগলো ঘন্টার পর ঘন্টা। ভিডিও চ্যাটও হলো কয়েকবার। কিন্তু দেখা হচ্ছে না। শুভ্র সারাদিন অফিসে থাকে, আর সন্ধ্যার পর ইশরাত বেরোতে পারেনা। শুধু শুক্রবার রাশিফল লিখে শনিবারে শুভ্রর ছুটি। তাই ওরা ঠিক করলো শনিবার বিকেলে একসাথে টিএসসিতে যাবে। সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে ঘুরে বেড়াবে।
আজকাল রাজনীতির কিছু স্টোরি তাকে এডিট করতে দিচ্ছে সুলতান ভাই। এডিটর কিছু বলেছেন হয়তো। রাজনীতির অবস্থা টালমাটাল। যেকোনদিন দেশে ভয়াবহ কিছু ঘটে যাবে। কালকের মিছিলে গুলি চলেছে। চারজন মারা গিয়েছে, বিশজনের মতন আহত। কি হবে কেউ কিছু বলতে পারছে না
শুক্রবারটা শুভ্র পারই করতে পারছে না কোনভাবে। শনিবারের উত্তেজনায় সবকিছু কেমন গুলিয়ে গেছে। কাজে মনোযোগ নেই। তবু করে যাচ্ছে রোবটের মতন। আজকাল রাজনীতির কিছু স্টোরি তাকে এডিট করতে দিচ্ছে সুলতান ভাই। এডিটর কিছু বলেছেন হয়তো। রাজনীতির অবস্থা টালমাটাল। যেকোনদিন দেশে ভয়াবহ কিছু ঘটে যাবে। কালকের মিছিলে গুলি চলেছে। চারজন মারা গিয়েছে, বিশজনের মতন আহত। কি হবে কেউ কিছু বলতে পারছে না। এর মাঝেও শুভ্র কোনভাবেই ইশরাত ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছে না। যে রাজনীতি তাকে এতো টানতো, তাও ইশরাতের কাছে ম্লান লাগছে। এ কোন ইশ্বরী এলো তার জীবনে!
এইসব ভাবতে ভাবতে শুভ্র খেয়ালই করেনি কখন সম্পাদক এসে তার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়েছে। তার ডাকে শুভ্রর দিবাস্বপ্ন ভাংলো।
“কি ব্যাপার শুভ্র, কেমন আছেন।”
“হ্যাঁ? ও! জ্বী স্যার ভালো।”
“দেশের অবস্থা কি বুঝছেন?”
“খুবই খারাপ অবস্থা স্যার। দমবন্ধ করে ধরেছে। এখন সবকিছু ভেঙ্গে পড়া ছাড়া আর কোন গতি নাই।”
“হুম! সেইজন্যেই আপনার কাছে আসা। আমি চাই এই সপ্তাহের রাশিফলটা একটু অন্যরকম হোক।”
“কিরকম অন্যরকম স্যার।”
“আমি চাই আপনি একটা জাতীয় রাশিফল লেখেন। মানে দেশের রাশিফল। সেখানে একটা আভাস দেবেন কি আসছে তাই নিয়ে। আপনি ক্রিয়েটিভ মানুষ! আপনাকে এর বেশি বলার দরকার নেই। তবে মনে রাখবেন এই পত্রিকা কোটি কোটি মানুষ পড়ে। তাদের ওপর আপনার একটা প্রভাব তৈরি হয়েছে। আপনার রাশিফল পড়ে মানুষজন আমাকে বলেছে যে আপনার হাতে জাদু আছে। যা বলেন সব ফলে যায়। তো আপনি লেখেন দেশে কি হবে। দেখা যাবে সেটাও ফলে গেছে!”
“জ্বী স্যার।”
শুভ্র একটু আড়মোড়া ভেঙ্গে বসলো। এই প্রজেক্টটা তার পছন্দ হয়েছে। নতুন কিছু করা যাবে। আর আসলেই যদি স্যারের কথা সত্যি হয়, যদি তার রাশিফলে মানুষ প্রভাবিত হয়, তাহলে কিছু একটা করা তার দায়িত্ব। তাই শুভ্র লিখলো–
“এই সপ্তাহের জাতীয় রাশিফল।
সবকিছু ভেঙ্গে পড়ছে। যা কিছু পবিত্র ছিলো, সব অপবিত্র করা হয়েছে। এখন একটা পালটা আঘাত আসবে। যাদের কিছু নেই, তারা যাদের সব আছে তাদেরকে পদানত করবে। যে যা কিছু করেছে, তার সবটার হিসাব দিতে হবে। যে যেভাবে অন্যায় করেছে, সে তেমনিভাবে অন্যায়ের প্রতিদান পাবে। পরিবর্তন আসবে, তবে তার আগে আসবে ভাঙ্গন।
লেখা শেষে শুভ্র সুলতান ভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দিলো। তারপর বাড়ির দিকে রওনা দিলো। অফিস থেকে বের হয়েই সে ইশরাতকে মেসেজ দিলো।
“কাল হচ্ছে তো?”
“হ্যাঁ।”
“কি পরবে?”
“নীল। তুমি?”
“নীল।”
“আচ্ছা। তোমাকে একটা কথা বলার ছিলো।”
“কি?”
“তোমার আসল নাম কি শুভ্র সোলায়মান? তুমি কি দৈনিক জাগরণে কাজ করো।”
“ও! ধরে ফেলেছো তাহলে?”
“হ্যাঁ। তুমি কি ইচ্ছে করে উলটাপালটা রাশিফল লিখে আমাকে পটানোর চেষ্টা করেছো?”
“হ্যাঁ। তো, এখন কি? সব ক্যান্সেল?”
“আরে ধুর বোকা। ক্যান্সেল হবে কেন? আমি আরও খুশি হয়েছি। তুমি আমাকে পাবার জন্য কতো ফন্দিফিকির করেছো তাই দেখে মজা পেয়েছি।”
“আচ্ছা। বাসায় গিয়ে ফোন দিচ্ছি।”
বাসায় গিয়ে শুভ্র ইশরাতের সাথে কথা বলে। সারারাত কথা বলে। ভোরের দিকে ঘুমাতে যায়। দেখা করার কথা বিকেলে। বিকেল পর্যন্ত শুভ্র মড়ার মতন ঘুমায়। এর মধ্যে তার পাড়ায় কি হয়ে গেছে সে কিছুই জানতে পারে না।
বিকেলে শুভ্র সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের গেটে দাঁড়ায়। ইশরাত আসেনা। ফোনও ধরে না। মেসেজেরও রিপ্লাই দেয় না। শুভ্রর চিন্তা হয়। কি হলো? সব ঠিক আছে তো?
তিন ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে শুভ্র ঘরে ফিরে আসে।
পরেরদিন আবার অফিসে যায়। অফিস থমথম করছে। অনেকেই আসেনি। দেশের অবস্থা ভালো না। শুভ্রকে অনেকটা রাস্তা হেটে আসতে হলো। জায়গায় জায়গায় টায়ার পুড়ছে।
ডেস্কে বসতেই শুভ্র মেইল চেক করল। নতুন স্টোরি পড়ার আগে আরেকবার মেসেঞ্জার দেখে নিলো। না, ইশরাতের কোন খবর নেই।
সুলতান ভাইয়ের পাঠানো ফাইল খুলতেই শুভ্রর বুকটা ধক করে উঠলো। হেডলাইন–মোহম্মদপুরে স্বেচ্ছাসেবক পার্টি নেতার বাড়িতে হামলা।
ভেতরে লেখা–
“মোহম্মদপুরে স্বেচ্ছাসেবক পার্টির নেতা মোসাদ্দেক চৌধুরির বাড়িতে হামলা করেছে একদল দুর্বৃত্ত। মনে করা হচ্ছে, বিরোধী দলের পালটা আঘাত কর্মসূচির সাথে এর যোগ থাকতে পারে। হামলায় মোসাদ্দেক চৌধুরি নিহত হয়েছেন। একইসাথে তার কন্যা ও স্ত্রীকে ধর্ষণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। উল্লেখ্য যে, মোসাদ্দেক চৌধুরীর বিরুদ্ধে একাধিক ধর্ষণের অভিযোগ রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, সেইসব ধর্ষণের সূত্র ধরেই পালটা আঘাত কর্মসূচির কর্মীরা এই ঘৃণ্য দুর্ঘটনাটি ঘটিয়েছে।”
ততক্ষণে সেলিম ভাই শুভ্রর চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়েছেন। নিউজটা সাংবাদিকসুলভ দ্রুততায় পাঠ করে তিনি বললেন, “দিনের শুরুতেই একইসাথে মার্ডার আর রেইপের নিউজ! না শুভ্র! তোমার রাশিফলেই কোন গড়বড় আছে।”
সমাপ্ত।
অনুপম দেবাশীষ রায় মুক্তিপত্রের প্রধান সম্পাদক ও ইউনিভার্সিটি অফ অক্সফোর্ডের পিএইচডি শিক্ষার্থী
Leave A Reply