গত বুধবার (২১ মে) চিফ অফ আর্মি স্টাফের দরবারের বক্তব্য সকল মিডিয়াতে প্রকাশিত হয়েছে, ঘটনাটি আপনারা জানতে পেরেছেন কারণ মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স চাইছে আপনি ঘটনাটা জানেন।
তারা চাইছে আপনি জানেন, মানবিক করিডোর নিয়ে সরকারের সাথে সামরিক বাহিনীর বিরোধ তৈরি হয়েছে।
কিন্তু গত সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে আরেকটা মেজর ঘটনা ঘটেছে, যেটা সরকারের সাথে আর্মির বিরোধের প্রধান ইস্যু। আর্মির উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ চায়নি যে আপনি সেটা জানেন।
কিন্তু, আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে মানবিক করিডোর সাইড শো, প্রধান ইস্যু হচ্ছে, জেনারেল কামরুলকে দিয়ে জেনারেল ওয়াকারকে রিপ্লেস করার একটি ঘটনা । সেদিন একটা তথ্য ছড়ায় যে চিফ অফ আর্মি স্টাফকে সরাতে একটা চিঠি তৈরি করে প্রেসিডেন্টের অফিসে পাঠানো হচ্ছে।
সেই রাতে আর্মিতে কিছু নড়াচড়া হয়।
এটা সেই দিনের ঘটনা, যেদিন বিকেলে ইন্টারনেট ৪০ মিনিটের জন্য বন্ধ ছিল।
আমি পরের দিন কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিক, বিশ্লেষক এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লোকজনের সাথে কথা বলে বোঝার চেষ্টা করি আমি যেটা শুনেছি সেটা গুজব কিনা।
খুব ওয়েল-প্লেসড বেশ কয়েকজন মানুষ আমাকে ঘটনাটা কনফার্ম করেছে। এমনকি এই ঘটনার পরের দিন বিএনপির সালাহউদ্দিন সাহেব নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানকে উল্লেখ করে একটা ছোট করে বিবৃতিও দেন।
আমি ফেসবুকে লেখালেখি খুব একটা করি না। এবং তথ্য প্রকাশ করা আমার স্কিল না। আমি একজন ইকোনমিস্ট, কিন্তু প্রয়োজনে পলিটিকাল অ্যানালিসিস করি একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে।
কিন্তু আমি দেখলাম, বেশ কয়েকটা পত্রিকার প্রধান সাংবাদিক জানেন, ইউটিউবাররা জানে (তারা প্রায়ই ক্যু’র আওয়াজ দিচ্ছিলেন এবং মানুষ হেসে উড়িয়ে দিচ্ছিল), কিছু রাজনীতিবিদ জানেন কিন্তু কেউ ঘটনাটা নিয়ে কথা বলছেন না। তাই আমি মনে করেছি এটা নিয়ে আমার আলাপ করা উচিত। কারণ ঘটনার সূত্র কি সেটা না বুঝলে আমাদের ব্যাখ্যা ভিন্ন জায়গায় যাবে।
ঘটনাটির সূত্রপাত নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানের নিয়োগের পর। তিনি পিএসও ওয়ান জেনারেল কামরুলের সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক তৈরি করেন।
যেহেতু খলিলের নিয়োগকে বাংলাদেশ আর্মির সিনিয়র কিছু অফিসার পিনাকিদা, ছোটন ভাই ও ফরহাদ মজহারসহ কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির গ্র্যান্ড ডিজাইন হিসেবে দেখে, তখন তারা জেনারেল কামরুলের সাথে সম্পর্কটাকে জেনারেল ওয়াকারের জন্যে হুমকি হিসেবে দেখেন।
খলিল যেদিন হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে নিয়োগ পান, সেদিন পিনাকিদা একটা ভিডিও তৈরি করে বলেন যে পিনাকি যদি অর্জুন হয় তাহলে খলিল হলো কৃষ্ণ। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৃষ্ণ যেভাবে অর্জুনকে পরামর্শ দিয়ে বিজয়ী করে, খলিল তেমনি পিনাকিকে পরামর্শ দেয়।
এইটা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি। আমি বলছি না, এটা ঠিক বা ভুল।
ফলে, খলিল যখন ড. ইউনূসের প্রচণ্ড আস্থা অর্জন করেন এবং জেনারেল কামরুলের সাথে বিশেষ সম্পর্ক গড়ে তোলেন তখন আর্মি জেনারেল কামরুলকে এএফডি থেকে ট্রান্সফার করার জন্যে চিঠি পাঠায় বা আবেদন করে ।
প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে সেই অনুরোধ কার্যকর করা হয়নি বরং বলা হয় একটু অপেক্ষা করতে।
এই অনুরোধ দুইবার করা হয় এবং দুইবারেই প্রধান উপদেষ্টার অফিস থেকে বলা হয় অপেক্ষা করতে।
সেই দিন (এক্স্যাক্ট ডেট খেয়াল নেই, যেদিন বিকেলে ইন্টারনেট ডাউন হলো) একটা গুজব ছড়ায় যে, জেনারেল ওয়াকারকে টারমিনেট করার বিষয়ে একটি নোট প্রধান উপদেষ্টার অফিস থেকে রাষ্ট্রপতির অফিসে পাঠানো হয়েছে।
একটা তথ্যমতে জেনারেল ওয়াকার এমনকি তার স্টাফের কাছ থেকেও বিদায় নেন। এবং জানান যে তাকে যেতে হবে।
এইটা সিনিয়র অফিসারদের মধ্যে প্রচণ্ড রিঅ্যাকশন তৈরি করে।
আর্মি তখন নড়াচড়া করে।
এবং এক্স্যাক্টলি কী কী ঘটে তা জানি না, কিন্তু ক্যান্টনমেন্টের ইউনিটগুলোকে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়।
সেই রাতে আমি রমনার পাশেই একটা ডিনারের দাওয়াতে ছিলাম, একজন উচ্চপদস্থ সরকারি বন্ধুর বাসায়। তিনি বলেন, কিছু টের পাচ্ছেন? রাস্তা বন্ধ। আমি আর্মির গাড়ি যেতে দেখলাম।
আর্মির সেই গতিবিধি সরকারের মধ্যে প্রচণ্ড নার্ভাসনেস তৈরি করে।
দূতাবাসগুলো সক্রিয় হয়। এবং সিচুয়েশন কুল ডাউন করার চেষ্টা করা হয়।
কিন্তু এর মধ্যেই আর্মি সম্পূর্ণ আক্রমণাত্মক মোডে চলে গেছে এবং পরের দিনগুলোতে আর্মি চিফ বিভিন্ন স্তরের কমান্ড নিয়ে বিভিন্ন রকম মিটিং করে—যার অনেক কিছু বিভিন্ন মিডিয়াতে এসেছে এবং আর্মিতে সরাসরি ক্যু শব্দটা উচ্চারিত হয় বিভিন্ন লেভেলে।
এই রাতগুলোতেই কনক সারওয়ারসহ বিভিন্ন ইউটিউবাররা ক্যু হতে পারে, সতর্ক থাকুন ইত্যাদি আলাপ তৈরি করেছেন। আপনারা গুজব বলে হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কিছু হচ্ছিল।
তো এই ঘটনাগুলোর ধারাবাহিকতায় গত দিনের দরবারে জেনারেল ওয়াকারের আলোচিত স্পিচ—যেখানে তিনি স্পষ্টভাবে নির্বাচন ও করিডোর নিয়ে মতামত দিয়েছেন—যা আমরা মনে করি, একটা ক্যু’র সমান, সেই লেভেলে চলে এসেছে।
কিন্তু সেই দিনটি ছিল বাংলাদেশ আর্মির সাথে সরকারের সম্পর্কের টার্নিং পয়েন্ট।
জুলকারনাইন সায়ের বাংলাদেশ আর্মির ভেতরে কী হচ্ছে তা জানার জন্যে সবচেয়ে অথেন্টিক সোর্স। সায়ের একটা স্ট্যাটাসে এই বিষয়ে কিছু লিখেছেন, কিন্তু আমি সারপ্রাইজড যে সায়ের ঘটনাটা আরও ডিটেইলে লেখেন নাই।
অথচ ঘটনাটা অনেকেই জানেন।
জেনারেল ওয়াকারের বুধবারের দরবার একটি ক্যুর সমান। এবং যার পরিণতিতে আজকে অসংখ্য সোর্স মতে প্রফেসর ইউনূস তার ক্লোজ সার্কেলে রিজাইন করার কথা বলেছেন, যেটা মনে হচ্ছে অনেক বুঝিয়ে উনাকে ঠেকানো হয়েছে
সেনাবাহিনী প্রধানকে সরানোর চেষ্টা অনেক সময় উন্নয়নশীল দেশে সরকার পতনের সঙ্গে সম্পর্কিত। ১৯৭৭ সালে পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো জেনারেল জিয়া-উল-হককে সরাতে চাইলে জিয়া অভ্যুত্থান করে তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেন ও পরে ফাঁসি দেন। ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানে নওয়াজ শরিফ মুশাররফকে সেনাপ্রধানের পদ থেকে সরাতে গেলে সেনাবাহিনী তাকে হটিয়ে ক্ষমতা নিয়ে নেয় এবং মুশাররফ দেশ চালান। ২০১৩ সালে মিশরে, রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ মোরসি সামরিক বাহিনীর উপরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন এবং সেনাপ্রধান জেনারেল সিসিকে সরানোর চিন্তা করেন। এরপর সেনাবাহিনী অভ্যুত্থান ঘটায় ও মোরসিকে সরিয়ে দেয়, পরে সিসি নিজেই রাষ্ট্রপতি হন।
বাংলাদেশ পাকিস্তান না। বাংলাদেশের মিলিটারি ৯০-এর পর থেকে সরকারের প্রতি লয়াল থেকেছে এবং বাংলাদেশের মানুষের কাছে মিলিটারি টেকওভারের কোনো ধরনের লেজিটিমেসি নেই। এইটা মিলিটারিও জানে। কিন্তু যেমনটা বলেছি, জেনারেল ওয়াকারের বুধবারের দরবার একটি ক্যুর সমান।
এবং যার পরিণতিতে আজকে অসংখ্য সোর্স মতে প্রফেসর ইউনূস তার ক্লোজ সার্কেলে রিজাইন করার কথা বলেছেন, যেটা মনে হচ্ছে অনেক বুঝিয়ে উনাকে ঠেকানো হয়েছে ।
জেনারেল কামরুলকে সরানো নিয়ে নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানের সাথে জেনারেল ওয়াকারের এই দ্বন্দ্ব বাংলাদেশের রাষ্ট্রের জন্যে একটা খারাপ টার্ন। কারণ আমরা চাই, আর্মি ৯০-এর পর থেকে যেভাবে সিভিলিয়ান শাসনের প্রতি লয়াল থেকেছে, সেই লয়ালিটি মেইনটেইন করুক। আমরা চাই না বাংলাদেশে আর্মি পাকিস্তানের মতো একটা ছায়া সরকার হয়ে উঠুক।
আমি মনে করি রোহিঙ্গা ইস্যু বা মানবিক করিডোর একটা সাইড শো। চাপে পড়লে সরকার এমনিতেই এসব থেকে সরে আসবে বা ইতোমধ্যে সরে আসছে।
কিন্তু ইস্যুটা ছিল জেনারেল কামরুলকে নিয়ে টানাপোড়েনের মধ্যে জেনারেল ওয়াকারের টার্মিনেশন অ্যাটেম্পট নিয়ে একটা গুজব, যেটা আর্মি মনে করেছে গুজব নয়, আসলেই একটা চিঠি পাঠানো হয়েছে।
এখন পুরো ঘটনায় আমার আরগুমেন্ট হলো- বাংলাদেশের মানুষকে কি এতোটাই বোকা বানিয়ে রাখা হয়েছে যে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা অনেকেই জানা সত্ত্বেও, মিডিয়ার বেশ কিছু সিনিয়ার ব্যক্তিদের নলেজ থাকা সত্ত্বেও কোনো মিডিয়া ঘটনাটা লিখেনি, কোন ইউটিবার ভিডিও বানায়নি আর আমার মতো একজন ইকোনমিস্টকে এটা লিখতে হচ্ছে এজ ইফ আমি গোপন কোনো খবর প্রকাশ করছি।
কিয়েক্টা অবস্থা।
জিয়া হাসান একজন অর্থনীতিবিদ ও লেখক