কোটা আন্দোলন কবে থেকে গণ-অভ্যুত্থান হলো? উত্তরটা হলো – ১৮ জুলাই। ১৮ জুলাই আমাদের কোটা সংস্কার আন্দোলন হয় গেছিল হাসিনাশাহী পতনের আন্দোলন, এক দফা যেদিনই আসুক না কেন। হাসিনা বেছে নিয়েছিল অস্ত্র আর লাশ, আর আমরা পেতে দিয়েছিলাম বুক, শ্লোগান দিছিলাম – বুকের ভেতর দারুণ ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর। আমরা শহীদ মুগ্ধকে পেয়েছিলাম, শহীদ ইয়ামিনকে পেয়েছিলাম, শহীদ ফারহান ফাইয়াজকে পেয়েছিলাম। আমরা যুদ্ধে নেমেছিলাম।
১৮ তারিখ অফিসে যাইনাই আমি, সকালে বিছানা থেকে উঠতেও কষ্ট হচ্ছিল। একেতো সোজা হয়ে শুইতে পারিনা, এক পাশ হয়ে শুইতে হইতেছে, তার ওপর আগের দিনের শারীরিক ও মানসিক শক থেকে রিকভার করতেছি। আগের দিন রাতে সিপিজের সোনালী ধাওয়ানের সাথে কথা হচ্ছিল, উনি জিজ্ঞেস করেছিলেন – আপনি দুইদিন আগে আহত হওয়ার পর আবার ফিল্ডে গেছেন কেন? এখন উনারে আমি এটার কী ব্যাখ্যা দেব, জানিনা। আমি বলছিলাম – ইটস মাই ডিউটি।
এরপর শুনলাম মিরপুর-১২ এর বিএফসির সামনে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা ছাত্রছাত্রীদের পিটাচ্ছে। আমি দ্রুত সেখানে পৌঁছালাম, আর দেখলাম পুলিশ ও ক্যাডাররা এক হয়ে কাজ করছে। আমার বাসার কাছেই ঘটনাস্থল। আমাকে পরে একটা ভিডিও পাঠায় এক ফ্রেন্ড, সেইখানে আমি দেখি, পল্লবী থানার ততকালীন ওসি অপূর্ব হাসান ১২ নাম্বারের আন্দোলনকারীদের বলতেছে, ‘মাইরা তো আমরা ফেলছি এখন কী করবা?’ অপূর্ব হাসানকে ভালোমতই চিনতাম, আমার রাগে গা জ্বলে গেল হারামজাদার ঔদ্ধত্যে।
আমার কাছে খবর আসতে শুরু করল, উত্তরায় আন্দোলন শুরু হইছে। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির কাছে পুলিশ, র্যাব ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলার খবর পেতে থাকলাম। প্রথম দিকে হতাহতদের ছবি আসতে শুরু করল, যা দেখে বলা যায়—অবস্থা ছিল ভয়াবহ। আমার বড়ভাই সালমান আবদুল্লাহ তখন ব্র্যাক জেপিজিতে। উনি প্রাইভেটের স্টুডেন্টদের ওপর হামলার পর পরই ছুটে যান তাদের চিকিতসা দিতে। উনার মাধ্যমে জানতে পারি, পুলিশ পেলেট গান ব্যবহার করছে। কী বীভৎস সেসব ছবি! একটা ছবি আমার মনে থাকবে আজীবন – ছেলেটার বুকের ছাতি মৌমাছির চাকের মত কালো কালো ফুটোয় ভরে গেছিল। এসব ছবি সালমান ভাই তার বন্ধুদের মাধ্যমে ডব্লিউএইচও-তে পাঠান।
এরপর আমার কাছে আসে উত্তরায় র্যাবের গাড়ি দিয়ে আন্দলনকারীদের চাপা দেয়ার ভিডিও। ভয়াবহ! এর চেয়েও ভয়ানক ছিল সেই গাড়ি আটকে যাওয়ার পর জনতার রিয়্যাকশন, তারা নির্মমভাবে প্রতিশোধ নিতে থাকে র্যাবের সদস্যের ওপর। লোকটা বেঁচে গেছে বোধহয়। কিন্তু মেসেজ চলে গেছিল ল এনফোর্সমেন্টের কাছে – গুলি শেষ হয়ে যাবে, জনতার ঢেউ শেষ হবেনা। ওয়িটা ছিল আপকামিং লড়াইয়ের ট্রেইলার – জনতাকে মেরে কেউ পার পাবেনা। কয়টাকে মারবে? জনতার প্রতিশোধ আসবেই, আর সেই প্রতিশোধ আগে কখনো এই দেশ দেখেনি, আল্লাহ না করুক ভবিষ্যতেও যেন কেউ না দেখে।
আমি এরপর চলে যাই মিরপুর দশের দিকে। ২০ তারিখ পর্যন্ত আমি দশেই ছিলাম। সেখানে ছাত্রদের রাস্তায় নেমে আসতে দেখলাম। বিশাল বিক্ষোভ চলছিল ছাত্র-জনতার, আর অচিরেই পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলা শুরু হয়ে গেল। টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট আর সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়া হচ্ছিল। ছাত্ররা লাঠি দিয়ে প্রতিরোধ করছিল। সারাদিন মিরপুর-১০ মোড় যুদ্ধক্ষেত্রের মতো ছিল। আমি দেখলাম স্থানীয় দোকানদার, দোকানের কর্মচারী, শ্রমিকসহ সাধারণ মানুষ বিক্ষোভে যোগ দিচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা মিরপুর-১০ সড়কদ্বীপে অবস্থান নিল। পুলিশ রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল ছুড়ছিল। দুপুর তিনটার দিকে যুবলীগের সন্ত্রাসীরা গুলি চালায়। আমি গোলচক্কর ক্রস করতে আর পারিনাই, আজমল হাসপাতাল থেকে পুলিশ বক্স পর্যন্ত গেছি। শরীরের ব্যথার জন্য বেশি দৌড়াদৌড়ি করতে পারছিলাম না। তার ওপর লাইভ বুলেট ফায়ার করা হচ্ছে।
আমি কিছু পথচারীর সাথে এক দোকানের ভেতরে আশ্রয় নিলাম। আমার এক বন্ধু তার বয়স্ক বাবাকে চেকআপের জন্য হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিল। রাবার বুলেট লাগায় তার বাবার বাঁ পায়ে আঘাত লেগেছিল। আরেক কিশোরের পেটে রাবার বুলেট লাগায় প্রচুর রক্তপাত হচ্ছিল। দোকানদার আমাদের নিরাপদে রাখতে দোকানের শাটার বন্ধ করে দিয়েছিল। শত শত আহত হচ্ছে, কিন্তু হাসপাতাল ভয়ে চিকিতসা দিচ্ছেনা। একসময় জনতা গেল ক্ষেপে, ভেঙে ফেলা হলো আলোক আর পপুলার হাসপাতাল।
বিকেলের দিকে অবিশ্বাস্য এক ঘটনা ঘটল। প্রায় ৪:৪০ বা ৪:৫০টার দিকে বিক্ষোভকারীরা মেট্রোরেল স্টেশনের নিচের পুলিশ বাক্সে আগুন ধরিয়ে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আগুন ছড়িয়ে পড়ল ওভারব্রিজে। ওভারব্রিজটি সম্পূর্ণ পুড়ে ছাই হয়ে গেল। আমি হা করে দেখতেছিলাম, কালো কালো ধোঁয়ার সমুদ্রের ভেতর দিয়ে ট্রেন যাচ্ছে – ঠিক যেন ‘২০১২’ এর মতো কোনো অ্যাপোক্যালিপ্টিক মুভি। এই আগুনের কারণে মেট্রোরেল সাড়ে ৫টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেল।
আগুনের পর পুলিশের হামলা আরও তীব্র হলো, বিক্ষোভকারীরাও পিছু হটল না। তারা ইট-পাথর দিয়ে বুলেট ও টিয়ার গ্যাসের মোকাবিলা করছিল। মনে হচ্ছিল যেন গাজার রাস্তা। মেট্রোরেলে আগুনের পর আমি বাসায় ফিরে এলাম, আমার মনে কু ডাক দিচ্ছিল – যুদ্ধ মাত্র শুরু হচ্ছে।
বেলা গড়ানোর সাথে সাথে নৃশংসতার খবর আসতে শুরু করল। আমি একের পর এক নিউজ পেতে লাগলাম, শহীদ মুগ্ধ, শহীদ ইয়ামিন, শহীদ ফাইয়াজ। আমি হতবাক হয়ে দেখতে লাগলাম – কী হচ্ছে! আমার মনে আছে, ফাইয়াজের ফেসবুক প্রোফাইল দেখে আর তার খালার লেখা পড়ে আমি ডুকরে কাঁদছিলাম। মনে হচ্ছিল – আমার ভাইটাকে মেরে ফেলা হইছে। ইয়ামিনকে যখন বস্তার মত এপিসি থেকে ফেলে দেয়া হয়, তখনো তার জান ছিল। আমি ভিডিওতে দেখলাম, কী বর্বরতা! শহীদ মুগ্ধের সেই ভিডিও – আহা! মুগ্ধ আর আমার ইন্টারমিডিয়েটের ব্যাচ সেইম। ওর আর আমার লাইফস্টাইল সেইম, পরিবারও সেইম, এমনকি সোশ্যাল ক্লাসটা পর্যন্ত সেইম। নরসিংদীতে দুইজন মারা গেল – একজনের বয়স ১৫, আরেকজনের ১৮। মাদারীপুরে পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে পানিতে ডুবে মারা গেল একজন ছাত্র। আমি না মানতেই পারছিলাম না। আমার সমবয়সী, আমার চেয়ে ছোট মানুষগুলো কেন গুলি খেয়ে মরবে। এটা তো কোনো সেন্স মেক করতেছে না আমার কাছে। এই জিনিসগুলো এত কঠিনভাবে আমাকে নাড়া দিচ্ছিল।
বহু মানুষ আহত হয়েছে, নিহতের সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন গুজব ছড়াল। প্রথম আলো ১৯ জনের মৃত্যুর খবর দিল, ডেইলি স্টার লিখল ২৩ জন। বিবিসি ২৫ জন। তবে, আমার এক সাংবাদিক বন্ধু ব্যক্তিগতভাবে বলেছিল, ওই রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ডিউটি করার সময় সে অন্তত ৮০টা লাশ দেখেছে, বেশিরভাগের মাথায় গুলিবিদ্ধ।
বিটিভি আর সেতু ভবনে আগুন লাগানো হলো। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল – এগুলা সরকারের কাজ। মেট্রোরেল, সেতুভবন নিয়ে যে যাই বলুক, আমি এখনো বলব – এগুলা সরকারের কাজ। এক্সপ্রেসওয়ের টোলপ্লাজার পাশের বাসাবাড়ির দারোয়ানদের কাছ থেকে আমার এক কলিগ শুনেছিলেন, এগুলা ছাপড়ি টোকাইরা করেছে। পুলিশ কাছেই ছিল, কিছু করেনাই। মেকস সেন্স, কারণ খুনকে ধামাচাপা দিতে তো হাসিনার কিছু একটা লাগবে।
আমি ঠিক আন্দাজ করেছিলাম, সেতুপূজারী, উন্নয়নপূজারী হাসিনা আর তার স্যাঙাতরা মরাকান্না করবে এগুলার জন্য। তাদের কাছে মেট্রোরেলের ভাঙা কাচের দাম আমার ভাইদের লাশের চেয়ে বেশি। এবং সেটাই হইছিল পরে। আর আওয়ামীদের ম্যাতকার তো ছিলই – আহারে আমার মেট্রোরেল শহীদ হইয়া গেল রে, আহারে আমার টোলপ্লাজা শহীদ হইয়া গেল রে! এইজন্য কি আমি তোদের উন্নয়ন দিছিলাম (যেন বাপের টাকায় এইগুলা বানাইছে।)
জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকে তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলল, আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি সরকার। আমার মনে আছে, আমি তখন লিখছিলাম- Bring back the dead, then we will talk.
আর, বিকালের দিকে হাসিনার পালায়ে যাওয়ার গুজব ছড়ায়ে পড়ল। এই গুজবটার কথা কারো মনে আছে কি? এপিসি কুর্মিটোলা এয়ারপোর্টের দিকে যাচ্ছিল। এই গুজবটা খুবই কার্যকর ছিল – হাসিনা নিজে পযর্ন্ত এটা ডিবাংক করছে টিভিতে এসে – ভাগ্যিস করছিল। নাইলে আমরা হাসিনা পালায় না মিমটা কই থেকে পাইতাম?
আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম, এইবার ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হবে। বিএনপির সমাবেশের সময় এইটা খুবই কমন টেকনিক। সেই ২০১৮ এর নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় থেকে দেখতেছি – সেইম ট্রিক। রাতের বেলা যেমন আশা করছিলাম, সরকার ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিল। তবে এই প্রথমবার ইন্টারনেট সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হলো, লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশীকে ডিজিটাল কারাগারে বন্দী করে রাখা হলো। আমার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা ফোন করতে থাকলেন। সবাই উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত। কিছু প্রবাসীও ফোন করলেন, কিন্তু আন্তর্জাতিক কলেও গোলমাল হচ্ছিল, শেষে সেগুলোও বন্ধ হয়ে গেল। আমি প্রচুর টকটাইম আর টেক্সট মেসেজ কিনে রেখেছিলাম, পর্যাপ্ত টাকা তুলে রেখেছিলাম। যত রাত বাড়তে লাগল, আমার অস্থিরতা বাড়তে লাগল। দেশের নানা জায়গা থেকে ইনফরমেশন পাচ্ছিলাম। বুঝতে পারলাম, আন্দোলন থামেনাই। যাত্রাবাড়ী তখনো জনতার দখলে। থেমে থেমে লড়াই চলছে ঢাকার নানা জায়গায়।
এভাবেই শুরু হলো বাংলাদেশে পাঁচ দিনব্যাপী ইন্টারনেট বন্ধের অধ্যায়—ইতিহাসের দ্বিতীয় দীর্ঘতম রাষ্ট্রীয় ইন্টারনেট শাটডাউন। ব্ল্যাকআউট, কারফিউ, ব্লক রেইড… কিন্তু তাতে জনতাকে কেউ দমাইতে পারেনাই।
শহীদ কাদরীর খুব সুন্দর একটা কবিতা আছে, ব্ল্যাকআউটের পূর্ণিমা, একাত্তর নিয়ে লেখা। কিন্তু আমাদের জুলাইয়ের জন্য একদম প্রাসঙ্গিক।
“যদিও বধ্যভূমি হলো সারাদেশ, রক্তপাতে আর্তনাদে/হঠাৎ হত্যায় ভ’রে গেল বাংলার বিস্তীর্ণ প্রান্তর,/অথচ সেই প্রান্তরেই একদা ধাবমান জেব্রার মতো/জীবনানন্দের নরম শরীর ছুঁয়ে উর্ধ্বশ্বাস বাতাস বয়েছে।… আবাল্য তোমার যে নিসর্গ ছিলো নিদারুণ নির্বিকার,/সুরক্ষিত দুর্গের মতন আমাদের প্রতিরোধে সে হলো সহায়,/ব্ল্যাকআউট অমান্য করে তুমি দিগন্ত জ্বেলে দিলে/বিদ্রোহী পূর্ণিমা। আমি সেই পূর্ণিমার আলোয় দেখেছি।/আমরা সবাই ফিরছি আবার নিজস্ব উঠোন পার হ’য়ে/নিজেদের ঘরে।”
১৮ জুলাই ব্ল্যাকআউটের রাতে আমরা আকাশে জ্বেলে দিয়েছিলাম বিদ্রোহী পূর্ণিমা।
সাদিক মাহবুব ইসলাম,সাংবাদিক।